ঋণ করে ঘি খাওয়ার বিষয়টি খারাপ না। জড়বাদী চার্বাক দর্শনে লেখাই আছে যে ‘ঋণং কৃত্বা ঘৃতং পিবেৎ, যাবৎ জীবেৎ সুখং জীবেৎ।’ এর অর্থ হলো, ‘ঋণ করে হলেও ঘি খাও, যত দিন বাঁচো সুখে বাঁচো।’ সমস্যা হচ্ছে এ সুখ নিয়েই। সব সময় আবার সব সুখ ঠিক সহ্য হয় না। তাই তো নীলুফার ইয়াসমীন গেয়েছিলেন, ‘এত সুখ সইব কেমন করে’।
আমাদের অবস্থা হয়েছে এ রকমই। এর বড় কারণ, ঋণ করে কিছু ঘি খাওয়া হয়েছে ঠিকই, তবে এর মধ্যে ভেজাল ঘির পরিমাণই বেশি। তাতে শরীর খারাপ হয়েছে। আবার কেনার সময় ঘির আড়ালে নানা ধরনের লেনদেনও হয়েছে। এখন সব হিসাবই চুকাতে হবে আমাদের।
মোহাম্মদ নাসির আলীর লেখা অনেকেই পড়েছেন। তিনি লিখতেন ছোটদের জন্য। ‘ঋণ পরিশোধ’ নামে তাঁর একটা গল্প ছিল। বাদশাহ আকবরের রাজসভায় একজন ব্রাহ্মণ ছিলেন। বাদশাহ তাঁর ওপর একবার বেজায় খুশি হয়ে পুরস্কার দিতে চাইলেন। সেই ব্রাহ্মণ পুরস্কার হিসেবে চেয়েছিলেন ১০০ ঘা চাবুক। বাদশাহ কিছুতেই রাজি নন, কিন্তু ব্রাহ্মণও নাছোড়বান্দা। অগত্যা চাবুকের ঘা। কিন্তু ৫০ ঘা খেয়েই থামতে বললেন ব্রাহ্মণ। কারণ, ঋণ পরিশোধের ব্যাপার রয়েছে। রাজদরবারের যে পাহারাদার, তার কাছে ঋণী এই ব্রাহ্মণ। তাকে কথা দিতে হয়েছিল, রাজা যে পুরস্কার দেবেন, তার অর্ধেক তাকে দিতে হবে। এ শর্তেই প্রথমবার রাজার দরবারে ঢুকেছিলেন ব্রাহ্মণ। অতঃপর বাকি চাবুকের ঘা সেই পাহারাদারের প্রাপ্য।
এখানেই সমস্যা। পাহারাদার তো পালিয়ে গেছে। সুতরাং পুরস্কার বা তিরস্কার যা–ই হোক, চাবুকের ঘা পিঠ পেতে আমাদেরই খেতে হবে। শিবরাম চক্রবর্তীরও একটা গল্প আছে, ‘ঋণং কৃত্বা’। বাড়িভাড়া পরিশোধে ৫০০ টাকা ধার নিয়েছিলেন দুই ভাই হর্ষবর্ধন ও গোবর্ধনের কাছ থেকে। বুধবার হর্ষবর্ধনের কাছ থেকে টাকা নিয়ে গোবর্ধনকে দিতেন আর শনিবার গোবর্ধনের কাছ থেকে টাকা নিয়ে হর্ষবর্ধনকে দিতেন। এভাবে ভালোই চলছিল। কিন্তু ঝামেলা দেখা দিয়েছিল একদিন দুই ভাই মুখোমুখি হওয়ায়। শিবরাম সমাধান দিয়েছিলেন এভাবে—‘গোবর্ধন প্রত্যেক বুধবার হর্ষবর্ধন বাবুকে পাঁচ শ টাকা দেবে, আর হর্ষবর্ধন প্রত্যেক শনিবার পাঁচ শ টাকা গোবর্ধনকে দেবে।’ সবশেষে শিবরাম লিখেছিলেন, ‘ব্যাপারটা আমি একেবারে মিটিয়ে ফেলতে চাই। আপনাদের দুজনের মধ্যে আমি আর থাকতে চাই না।’
সমস্যা এখানেই। যিনি বা যাঁরা ঋণ নিয়েছেন, তাঁরা ঋণ পরিশোধের ব্যাপারটা জনগণের ওপর ছেড়ে দিয়ে পালিয়ে গেছেন, আর বলছেন, তাঁরা আর এসবের মধ্যে থাকতে চান না। সুতরাং প্রশ্ন হচ্ছে, এই ঋণ আমরা পরিশোধ করব কেমন করে? সব ঋণ হয়তো পরিশোধ করা যায় না বা উচিত নয়। কিন্তু ১৮ লাখ কোটি টাকার এই ঋণ পরিশোধ করতেই হবে।
ঋণ পরিশোধের একটা পথ কিন্তু দক্ষিণ কোরিয়ার নাগরিকেরা দেখিয়ে দিয়ে গেছে। আমরা জানি, সেই ষাটের দশক থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত কোরিয়া ছিল নানা আবরণে সামরিক সরকারের কবলে। দীর্ঘ সংগ্রামের পর সামরিক শাসক থেকে মুক্ত হয়েছিল দেশটি। এ জন্য রক্তও কম দিতে হয়নি। এই কোরিয়াসহ পূর্ব এশিয়ার আরও কয়েকটি দেশ বড় ধরনের আর্থিক সংকটে পড়েছিল ১৯৯৭ সালে, যাকে বলা হয় ‘ইস্ট এশিয়ান ক্রাইসিস’। প্রায় দেউলিয়া হয় যায় দক্ষিণ কোরিয়া। সংকট কাটাতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছ থেকে বড় অঙ্কের ঋণ নিতে হয় কঠিন সব শর্তে। এ জন্য অনেক আর্থিক প্রতিষ্ঠান বন্ধ করতে হয়, ছাঁটাই করা হয় বিপুল পরিমাণ শ্রমিক। এতে অর্থনৈতিক সংকটের সঙ্গে যুক্ত হয় চরম সামাজিক অসন্তোষ। আইএমএফের ঋণ পরিশোধ ছাড়া এখান থেকে বের হওয়ার আর কোনো পথ ছিল না। সেখান থেকে বের হওয়ার অভিনব এক উপায় বের করেছিল দেশটির সাধারণ নাগরিকেরা। তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, নিজেরাই অর্থ সংগ্রহ করে ঋণ পরিশোধ করে দেবে। এর নাম দেওয়া হয়েছিল ‘জাতীয় ঋণ পরিশোধ আন্দোলন’। শুরু হয়েছিল ১৯৯৮ সালের ৬ জানুয়ারি, শেষ হয় এপ্রিলের ৩০ তারিখ। রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন থেকে আহ্বান জানানো হয়েছিল, যে যার সাধ্যমতো সোনা জমা দিলে তা বিক্রি করে ঋণ পরিশোধ করা হবে। বিপুল সাড়া পড়েছিল। ৩৫ লাখের বেশি মানুষ ৬টি ব্যাংকে ঘরে থাকা সোনার গয়না বা স্বর্ণপিণ্ড (বার) জমা দিয়েছিল। মোট জমা পড়েছিল ২২৭ টন সোনা, তখন যার মূল্য ছিল ২১৩ কোটি ডলার। শুধু সাধারণ জনগণই নয়, দেশটির প্রেসিডেন্টসহ বড় বড় কোম্পানিও এই আন্দোলনে যোগ দিয়েছিল। গড়ে প্রত্যেক নাগরিক ৬৫ গ্রাম সোনা জমা দিয়েছিল।
২০১৭ সালে এ নিয়ে দেশব্যাপী একটি সমীক্ষা করে কোরিয়া ডেভেলপমেন্ট ইনস্টিটিউট। সেই জরিপে অংশ নিয়ে ৫৪ শতাংশ মানুষ বলেছিল, সংকট থেকে দেশকে বের করে আনতে জাতীয় একতাবোধ থেকে তারা সোনা জমা দিয়েছিল। ৪২ শতাংশ বলেছিল, আইএমএফের শর্ত থেকে বাঁচতেই আন্দোলনে অংশ নেয় তারা। আর ১৫ শতাংশ বলেছিল, দেশকে পুনর্গঠন ও সংস্কার করাও তাদের উদ্দেশ্য ছিল।
বাংলাদেশও এখন সংকটে। ঋণ পরিশোধ করতে হবে। পুনর্গঠনে সংস্কার চাই। আবার সংকট থেকে বের হতে, গণতন্ত্র ফিরে পেতে সবাই যে একতাবদ্ধ, সেটাও প্রমাণ করতে হবে। সে জন্য সবাইকে সোনা জমা দিতে হবে তা নয়, মনটা দিলেই হবে।