‘তো ইয়াংম্যান, কী করা হয়? চাকরি না বিজনেস?’ কফির মগটা টেবিলে রাখতে রাখতে পিটারকে প্রশ্নটা করলেন লিমুর বাবা ভিক্টর ডি কস্তা। পিটার এখন বসে আছে ভিক্টর প্রপার্টিজের মিটিং রুমে। লিমুর বাবা এই কোম্পানির চেয়ারম্যান।
পিটারের কফিটা একটু আগেই শেষ হয়েছে। কফির সঙ্গে দেওয়া চকলেট চিপ কুকিগুলোর একটা বেশ আরাম করেই সে খাচ্ছিল। আধখাওয়া কুকিটা হাতে ধরেই বলল, ‘আঙ্কেল, আমি একজন বেকার।’
চোখ-মুখ কুঁচকে গেল ভিক্টর ডি কস্তার, ‘তুমি কী? বেকার?’
: জি, আঙ্কেল। আমার একটা...।
: ওয়েট, ওয়েট, ওয়েট। বেকার হয়ে তুমি এসেছ আমার মেয়েকে বিয়ে করতে?
: আঙ্কেল, আমি বোধ হয় বোঝাতে পারিনি। আমি...।
: দেখো ছেলে, লাভ ম্যারেজ-ট্যারেজ আমি এমনিতেই পছন্দ করি না। শুধু লিমুর পীড়াপীড়িতে তোমার সাথে দেখা করতে রাজি হয়েছিলাম। এখন শুনি, তুমি বেকার!
: আঙ্কেল, আমার কথাটা শেষ করি!
: সরি, মাই বয়। অলরেডি আমার অনেক সময় নষ্ট হয়ে গেছে। তোমার সাথে কথা বলব বলে দুই-দুইটা মিটিং আজকে ক্যানসেল করেছি। সরি, কোনো বেকারের সাথে আমি আমার মেয়েকে বিয়ে দিতে পারি না।
: আঙ্কেল, আপনি ভুল বুঝছেন। বলছিলাম আমি আসলে...।
: সরি, আমাকে এখন ব্যাংকে যেতে হবে। তুমি কুকিগুলো শেষ করে উঠতে পারো।
মিটিং রুমের কাচের দরজা ঠেলে বেরিয়ে গেলেন ভিক্টর। মুখে লেগে থাকা চকলেট চিপ কুকির স্বাদ পিটারের কাছে ঘাসের মতো মনে হতে থাকল। শুধু কথা গুছিয়ে বলতে না পারার কারণে কি সে লিমুকে হারিয়ে ফেলল? না, লিমুর বাবার ভুল ভাঙাতেই হবে। কিন্তু আপাতত এই বিষয়ে ভাবার উপায় নেই। আজ তার কাজ আছে। অনেক কাজ। আধখাওয়া কুকিটা রেখেই বেরিয়ে গেল পিটার।
এক সপ্তাহ পর
এই এলাকায় ভিক্টর খুব একটা আসেন না। দোকানটা খুঁজে পেতে তাই একটু সমস্যা হচ্ছে। কিন্তু দোকানটা খুঁজে বের করতেই হবে। বড়দিন উপলক্ষে এবার একটা এক্সক্লুসিভ ডিজাইনের কেকের অর্ডার দেওয়ার ইচ্ছা তার। অর্ডারটা ওই দোকানেই দিতে চান। ‘সুইটস অব নেচার’ নামে দেশে কোনো বেকারি আছে বলেই তিনি জানতেন না। এবারের বিজয় দিবস উপলক্ষে তার কোম্পানির পক্ষ থেকে ক্লায়েন্টদের কেক পাঠানো হয়েছিল। একটা কেক অফিসেও কাটা হয়েছিল। মুখে দিতেই মনে হলো যেন অমৃত! স্বাদে-গন্ধে মুগ্ধ ভিক্টর ম্যানেজারকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কেকটা কোথা থেকে নিয়েছিলে?’
: ‘সুইটস অব নেচার’ থেকে স্যার। আমার ভার্সিটির এক ছোট ভাইয়ের স্টার্টআপ। সব ফ্রেশ জিনিস দিয়ে কেক বানায়। কালারগুলোও একদম ন্যাচারাল। কৃত্রিম ফুড কালার মেশায় না।
ন্যাচারাল কালার শুনে একটু আস্থা পেলেন ভিক্টর। কী সব রং যে মেশায় আজকাল কেক-বিস্কুটে! সেদিন একটা রেড ভেলভেট কেক খেয়ে সেকি বমি শুরু হলো বড় নাতনিটার!
গলির মধ্যে ১০ মিনিট এদিক-ওদিক ঘুরতে থাকার পর গাড়ি থামল একটা ফিটফাট দোকানের সামনে। এলইডি ডিসপ্লেতে লেখা ‘সুইটস অব নেচার’। গাড়ি পার্ক করে দোকানে ঢুকলেন ভিক্টর। ইন্টেরিয়র রুচিসম্মত। সেলসম্যানরাও আন্তরিক। ক্যাটালগ থেকে ক্রিসমাস কেকের বেশ কিছু ডিজাইন দেখাল তারা। ভিক্টর হাসিমুখে বললেন, ‘আমি আসলে এক্সক্লুসিভ একটা কেক চাইছি আমার ফ্যামিলির জন্য। আমার নিজস্ব একটা আইডিয়া আছে। কাউকে একটু বুঝিয়ে বলতে পারলে ভালো হতো।’
: ওকে স্যার। তাহলে আমাদের সিইওর সঙ্গে কথা বলুন। উনি কিচেনে আছেন। ডেকে দিচ্ছি।
সিইও কিচেনে? কথাটা শুনে ভিক্টরের নিজের ব্যবসার শুরুর দিকের কথা মনে পড়ল। কখন যে কিচেন থেকে অ্যাপ্রন পরা সিইও বের হয়ে সামনে এসে দাঁড়িয়েছে, তিনি খেয়ালও করলেন না।
‘আঙ্কেল আপনি?’ পরিচিত কণ্ঠ শুনে মুখ তুলে তাকালেন ভিক্টর। সামনে দাঁড়িয়ে আছে হাস্যোজ্জ্বল পিটার!
: তুমি?
: আঙ্কেল, এটা আমার বেকারি। আপনাকে তো বলেছিলাম সেদিন। আমি একজন বেকার। বি এ কে ই আর। এই বেকারির মালিক, শেফ—সবই আমি।
নিজের নির্বুদ্ধিতার কথা ভেবে ভারি লজ্জা পেলেন ভিক্টর। তবু সেটা পিটারকে বুঝতে না দিয়ে বললেন, ‘ও আচ্ছা। আমাদের অফিসের বিজয় দিবসের কেকগুলো তোমাদের এখান থেকে নেওয়া হয়েছিল।’
: শুধু বিজয় দিবসের কেকই না আঙ্কেল। আপনার অফিসে সেদিন যে চকলেট চিপ কুকিজ খেয়েছিলাম, ওটাও আমার এখান থেকেই নেওয়া। আমার সিগনেচার রেসিপি। দেখেই চিনতে পেরেছিলাম।
সেদিনের কথা ভেবে আবারও লজ্জায় পড়লেন ভিক্টর। গম্ভীর মুখে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তা এই ব্যবসায় কত দিন ধরে আছ?’
: চার বছর ধরে। বিবিএ ফার্স্ট ইয়ারে থাকতে বাবা খুব অসুস্থ হয়ে পড়েন। কিডনি ডায়ালাইসিস বাবদ প্রচুর টাকা লাগত। আমি তখন বেকিংয়ের ওপর কিছু কোর্স করি। তারপর অনলাইনে পেজ খুলে বাসা থেকে কেক আর স্ন্যাকস বানিয়ে সেল করতে শুরু করি। ইউটিউবে আমার একটা চ্যানেলও আছে। বিভিন্ন ফল আর সবজি থেকে ন্যাচারাল খাবার রং তৈরি করে সেসব দিয়ে কেক বানানোর বেশ কিছু ভিডিও আছে আমার। ন্যাচারাল রং নিয়ে কাজ করার জন্য অনেকেই আমার ওপর ভরসা রাখে। এ বছর পাস করার পর সাহস করে দোকানটা খুলেই ফেললাম। ব্যবসা ভালোই চলছে। ঈশ্বরের কৃপায় বাবাও এখন সুস্থ। আঙ্কেল, আপনি কী চাইছিলেন? ক্রিসমাস কেক? আসুন, ডিজাইনটা বসে ফাইনাল করে ফেলি।’
পিটারের জীবনসংগ্রামের গল্প শুনতে শুনতে কেকের কথা ভুলেই গিয়েছিলেন ভিক্টর। দুজনে বসলেন কেকের ডিজাইন ফাইনাল করতে। পিটার খুব মনোযোগ দিয়ে ভিক্টরের আইডিয়া শুনল। কাগজে আঁকিবুঁকি করল। কোন ফ্লেভারের কেক হবে, কোন রং দিয়ে কোন ডিজাইনটা করা হবে, সব একেবারে ভালোভাবে লিখে নিল পিটার। অর্ডার ফাইনাল করার আগে ভিক্টরকে জিজ্ঞেস করল, ‘আঙ্কেল, আপনার কি আর কোনো রিকয়ারমেন্ট আছে?’
: আছে। বড়দিনে কেকটা তুমি নিজেই আমাদের বাসায় নিয়ে এসো। সাথে তোমার মা-বাবাকেও এনো। বিয়ের কথাটা সেদিনই পাকা করে ফেলি। শুভ কাজের শুরু শুভদিনেই হওয়া ভালো, কী বলো?
পিটার অবাক হয়ে তাকাল ভিক্টরের দিকে। এখন আর তাকে ভিক্টর প্রপার্টিজের ডাকসাইটে চেয়ারম্যান ভিক্টর ডি কস্তা মনে হচ্ছে না। মনে হচ্ছে, তিনি শুধুই লিমুর বাবা। একজন স্নেহশীল বাবা।