বিশ্ববিখ্যাত গায়ক জন লেননের মৃত্যু

জন লেনন (১৯৪০–১৯৮০)
ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস

জন লেননকে গুলি করেও পালিয়ে যাননি তিনি। পাশেই লাইটপোস্টের নিচে দাঁড়িয়ে ছিলেন। পুলিশ যখন তাঁকে খুঁজে বের করে, তখন তাঁর হাতে ছিল জন লেননের সদ্য প্রকাশিত ‘ডাবল ফ্যান্টাসি’ অ্যালবামের এলপি রেকর্ড। সেদিন বিকেলে স্টুডিওতে যাওয়ার পথে অটোগ্রাফের জন্য লেননকে ঘিরে ধরেছিল ভক্তরা। এক ভক্ত এগিয়ে দেন একটি এলপি রেকর্ড, লেনন তাতে সই দেন। এই ভক্তই ছিলেন জন লেননের হত্যাকারী মার্ক চ্যাপম্যান। ছোটবেলা থেকেই লেননের ভক্ত ছিলেন মার্ক!

জন লেনন ছিলেন একাধারে গায়ক, গীতিকার, সুরকার, চিত্রশিল্পী, লেখক ও শান্তিকর্মী। তাঁর জন্ম ১৯৪০ সালের ৯ অক্টোবর ইংল্যান্ডের লিভারপুলে। লেননের জন্মের আগেই শুরু হয়ে গেছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিভীষিকা। ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল তাঁর দক্ষ নেতৃত্ব আর পরিকল্পনায় ঠেকিয়ে রেখেছেন হিটলারের জার্মান বাহিনীকে। দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে মা প্রধানমন্ত্রীর নামের সঙ্গে মিল রেখে সন্তানের নাম রাখেন ‘জন উইনস্টন লেনন’।

লেননের বাবা ছিলেন জাহাজের নাবিক। অধিকাংশ সময় থাকতেন দেশের বাইরে। লেননের মা দ্বিতীয় বিয়ে করলে লেনন বড় হতে থাকেন তাঁর খালা মিমি স্মিথের কাছে। মা জুলিয়া লেননকে মাঝেমধ্যে দেখতে যেতেন। ছোটবেলা থেকে ছবি আঁকা ও গানের নেশা ছিল লেননের। লেনন তাঁর মায়ের কাছে একটা গিটারের জন্য আবদার করেন। লেননের জীবনের প্রথম গিটার কিনে দেন মা। এরপর গিটারকেই সব সময়ের সঙ্গী হিসেবে বেছে নেন লেনন। খালা মিমি পড়াশোনা শেষ করার অনুরোধ করলেও তিনি তা মানেননি।

১৯৬৪ সালে জন এফ কেনেডি বিমানবন্দরে দ্য বিটলসের সদস্যরা
ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস

১৭ বছর বয়সে লেনন একটা ব্যান্ড গঠন করেন, দলটির নাম দেন ‘দ্য কোয়ারিমেন’। সঙ্গে ছিলেন তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু পল ম্যাকার্টনি। এর পরের বছর সড়ক দুর্ঘটনায় মাতৃহারা হন লেনন। তত দিনে সংগীতশিল্পী হিসেবে এলাকায় লেননের বেশ নামডাক। মায়ের মৃত্যুশোক কাটিয়ে ওঠার অবলম্বন হিসেবে গানকে আরও আঁকড়ে ধরেন তিনি। এ সময় লেনন লিখে ফেলেন তাঁর প্রথম গান ‘হ্যালো লিটল গার্ল’। সে বছর লিড গিটারিস্ট হিসেবে ‘দ্য কোয়ারিমেন’ দলে যোগ দেন জর্জ হ্যারিসন। দলবল নিয়ে গান গাইতে যান জার্মানির হামবুর্গে। ১৯৬০ সালে দলটির নাম পাল্টে রাখা হয় ‘দ্য বিটলস’। ১৯৬৩ সালে দ্য বিটলস ‘প্লিজ প্লিজ মি’ গান দিয়ে ব্রিটেনে ঝড় তোলে। এর পরের বছর ‘আই ওয়ান্ট টু হোল্ড ইয়োর হ্যান্ড’ প্রকাশের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে তাঁদের। সে বছরই তাঁরা যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান।

২১ বছর বয়সে লেনন সিনথিয়া পাওয়েলকে বিয়ে করেন। যদিও লেননের খালা সিনথিয়াকে পছন্দ করতেন না, তিনি সিনথিয়াকে মনে করতেন ‘ডাকাবুকো’। ১৯৬২ সালে জন্ম নেয় তাঁদের সন্তান জুলিয়ান লেনন। ১৯৬৮ সালে বিয়ে ভেঙে যায়। ব্যক্তিত্বের সংঘাতের জেরে ১৯৭০ সালে ভেঙে যায় ‘ফোর ফ্যাভস’ নামে খ্যাত ব্যান্ড দ্য বিটলস। এরপর লেনন একক সংগীতের পাশাপাশি সামাজিক কাজে অংশ নিতে শুরু করেন। বিটলসের বাইরে গিয়েও তিনি উপহার দেন একের পর এক হিট গান।

লেনন ছিলেন শান্তিপ্রিয় মানুষ। সব সময় যুদ্ধের বিরুদ্ধে অবস্থান ছিল তাঁর। ভিয়েতনাম যুদ্ধের বিরোধিতা করায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন তাঁকে ইল্যান্ডে ফেরত পাঠাতে চেয়েছিলেন। পরে অবশ্য তিনি যুক্তরাষ্ট্রে গ্রিনকার্ড পান। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’–এ বিটলসের জর্জ হ্যারিসন ও রিঙ্গো স্টার অংশ নেন। কনসার্টে জন লেননের অংশ নেওয়ার কথা ছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত অংশ নিতে পারেননি তিনি।

১৯৬৮ সালে জন লেনন ধনী জাপানি পরিবারের মেয়ে ইয়োকো ওনোকে বিয়ে করেন। ইয়োকো ওনো ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী মানবতাবাদী অ্যাকটিভিস্ট। ১৯৭৫ সালে লেননের জন্মদিনে পৃথিবীর মুখ দেখে তাঁদের সন্তান সিন লেনন। ছেলে সিনের জন্মের পর সংগীতজীবন থেকে অবসর নেন লেনন। ব্যবসায়িক বিষয়গুলো ছেড়ে দেন স্ত্রী ওনোর ওপর। তারপর অনেকটা নিভৃত জীবনযাপন শুরু করেন তিনি।

১৯৬৬ সালে এক সাক্ষাৎকারে বিটলস সম্পর্কে লেনন বলেছিলেন, ‘আমরা এখন যিশুর চেয়ে বেশি জনপ্রিয়।’ তখন যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে তাঁর এই কথার ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। অনেক গোঁড়া ধার্মিক ব্যক্তির মতো মার্ক চ্যাপম্যানও লেননের এই কথায় ক্ষুব্ধ হন। তা ছাড়া তিনি লেননের বিলাসী জীবনযাপনে অসন্তুষ্ট ছিলেন। চ্যাপম্যান ছিলেন মূলত ‘বর্ডারলাইন সাইকোটিক’ ব্যক্তি বা সোজা কথায় মানসিক ব্যাধিতে আক্রান্ত ব্যক্তি।

লেননের খুনী মার্ক চ্যাপম্যান
ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস

৫ বছর বিরতির পর ১৯৮০ সালে গানের জগতে ফিরে আসেন লেনন। ফলে গণমাধ্যমে তাঁর উপস্থিতি বাড়তে থাকে। একই সঙ্গে বাড়তে থাকে চ্যাপম্যানের ক্ষোভ। লেননকে হত্যার উদ্দেশ্যে হাওয়াই থেকে চলে আসেন নিউইয়র্কে। ১৯৮০ সালের ৮ ডিসেম্বর রিভলবার পকেটে নিয়ে লেননের বাসার সামনে অপেক্ষা করেন ২৫ বছর বয়সী মার্ক। রাত প্রায় ১১টায় রেকর্ডিং থেকে ফেরার পথে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে নিজ বাসভবনের সামনে গুলিবিদ্ধ হন লেনন। অনেক কাছ থেকে পয়েন্ট থ্রি এইট ক্যালিভারের রিভলবার দিয়ে লেননকে চারটি গুলি করেন চ্যাপম্যান। হাসপাতালে নেওয়ার পথেই মৃত্যু হয় লেননের।

রাত শেষ না হতেই দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে লেননের মৃত্যুসংবাদ। নিউইয়র্কের সেন্ট্রাল পার্কে বের হয় ১০ হাজার মানুষের মৌন মিছিল। বরফ ঝরা শীতের রাতে টরন্টো শহরে লেননের স্মৃতির উদ্দেশ্যে মোমবাতি জ্বালান ৩৫ হাজার ভক্ত। সারা বিশ্বের কোটি কোটি ভক্ত হয়ে পড়েন শোকবিহ্বল। বিচারে চ্যাপম্যানকে ২০ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। ১৯৮১ সাল থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত কারাগারে থাকার পর চ্যাপম্যান এখন যুক্তরাষ্ট্রের একটা সংশোধনাগারে বন্দী আছেন।