টাকাতো মারিয়াছির সঙ্গে যেভাবে আমার পরিচয় হলো
‘অ্যাই! আরে আস্তে…!’
বলতে না বলতেই ঠপাক! গলির মুখ থেকে আচমকা বেরিয়ে আসা গাড়িটার বাম্পার আমার বাইকের সঙ্গে লেগে গেল। তাল রাখতে না পেরে পড়ে গেলাম হুড়মুড় করে।
কোথাও ব্যথা পেয়েছি কি না, কেটেছে–ছড়েছে কি না, অত সব দেখার সময় নেই। উঠে দাঁড়ানোর আগেই আমি শার্টের হাতা গুটিয়ে ফেললাম। আইজ একটা বিরাট ফাটাফাটি হইব। ‘ওই ব্যাটা, নাম গাড়ি থেইকা…’
আমাকে অবাক করে দিয়ে গাড়ি থেকে নেমে এলেন এক বিদেশি ভদ্রলোক। মাথা নুইয়ে কী সব হাবিজাবি বলতে শুরু করলেন। একবিন্দু বুঝলাম না। শুধু বুঝলাম, বেচারা খুবই অনুতপ্ত।
বিদেশি মানুষ এবং দেশি পেঁয়াজ, এই দুইয়ের প্রতি বাঙালির বিশেষ অনুরাগ আছে। অতএব মুহূর্তে আমার রাগ পানি হয়ে গেল। হাঁটুতে হালকা জ্বলুনি উপেক্ষা করে গদগদ হয়ে বললাম, ‘নো নো। নাথিং। ফাইন ফাইন। ভেরি ফাইন।’
ভদ্রলোক ভাবলেন, আমি বোধ হয় তাকে ফাইন, মানে জরিমানা দিতে বলছি। তিনি পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে টাকা দিতে উদ্যত হলেন। বিনয় দেখে আমি মুগ্ধ! বললাম, ‘নো নিড! নো নিড!’
ভদ্রলোক কিছুতেই ছাড়লেন না। রীতিমতো জোর করেই নিয়ে গেলেন পাশের টংদোকানে, অন্তত এককাপ চা খাওয়াবেন বলে।
‘মাইসেলফ টাকাতো মারিয়াছি। আপনার কোথাও লাগেনি তো?’
তাজ্জব ব্যাপার! ‘আপনি বাংলা জানেন!’
ভদ্রলোক স্মিত হাসলেন। ‘ভয় পেয়ে জাপানি ভাষা বলা শুরু করেছিলাম। প্লিজ ডোন্ট মাইন্ড!’
‘নো নো। ইটস ফাইন!’ বিনে পয়সায় আইইএলটিএসের স্পিকিং মক টেস্ট দেওয়ার সুযোগটা হাতছাড়া হলো বলে একটু হতাশই হলাম। তাই বলে হাল ছাড়লাম না। ‘সো ইউ ফ্রম জাপান? হোয়াট ডু ইউ ডু?’
আমার ছেঁড়া প্যান্টের দিকে তাকিয়ে টাকাতো একমুহূর্ত কী যেন ভাবলেন। বললেন, ‘আপনার কাছে মিথ্যা বলব না ব্রাদার। আমাকে আপনি একজন অভিনেতা বলতে পারেন।’
‘ফ্যান্টাস্টিক! হোয়াট ফিল্ম?’
‘না না, ফিল্ম না। ব্যাপারটা…আসলে…আচ্ছা আপনাকে বুঝিয়েই বলি।’
টাকাতো মারিয়াছির ঝকঝকে বাংলা শুনে এমনিতেই যথেষ্ট অবাক হয়েছি। তবে জানতাম না, আমার জন্য আরও বড় বিস্ময় অপেক্ষা করছে। টাকাতো বললেন,
‘আমার কাজ হলো ব্রাদার একেক সময় একেক কনসালটেন্টের অভিনয় করা। সরকারি, বেসরকারি, নানা রকম প্রজেক্ট পাওয়ার জন্য লোকে আমাকে হায়ার করে নিয়ে যায়।’
‘বলেন কী! বাট হোয়াই?’
‘কারণ, সাথে একজন ফরেন বিশেষজ্ঞ থাকলে কাজ পাওয়া সহজ হয়। ধরেন, আজ আমি রোডস অ্যান্ড হাইওয়ে কনসালটেন্ট, কাল হয়তো গার্মেন্টস এক্সপার্ট, পরশু মশাবিশেষজ্ঞ, তার পরদিন রেলবিশেষজ্ঞ…এভাবেই চলছে।’
‘হাউ সাংঘাতিক!’ বিস্ময়ে আমার বাংলা, ইংরেজি গুলিয়ে গেল। ‘বাট হাউ? আই মিন…মানে…একেকবার একেক ক্যারেক্টারে গেলে মানুষ আপনাকে চিনে ফেলে না?’
টাকাতো হাসলেন, ‘নাহ। আপনাদের চোখে নাকি আমাদের সবার চেহারা একই রকম লাগে। এই বেনিফিট অব ডাউটই কাজে লাগাই। এমনও হয়েছে, একই মানুষের সঙ্গে দুপুরে একবার, বিকেলে আরেকবার মিটিং করেছি। দুইবার দুই ক্যারেক্টারে। ধরতেই পারেনি!’
‘কিন্তু এত এত টপিকে আপনি স্পেশালিস্ট কমেন্ট করেন কীভাবে!’
‘আমি তো জাপানি ভাষায় যা খুশি বলি। বাকিটা ওরা বুঝে নেয়।’
‘দিস ইজ অ্যামায়জিং!’ আমার বিস্ময় কাটে না। ‘কত দিন ধরে আপনি এই অভিনয় করছেন?’
‘অনেক দিন তো হলো। এবার ভাবছি বাড়ি চলে যাব। সামনে ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে আপনাদের দেশের একটা বিগ ইভেন্ট আছে শুনেছি। ওই ইভেন্টে কিছু খ্যাপ-ট্যাপ পাওয়ার কথা আছে। তারপর বাড়ি…’
টাকাতো কথা শেষ করতে পারেন না। তার আগেই আমাদের চমকে দিয়ে সামনের রাস্তায় দ্রুতগতিতে এসে ঘ্যাঁক করে ব্রেক কষে দাঁড়ায় একটা মাইক্রোবাস। কিছু বুঝে ওঠার আগেই আমাকে ঘিরে ফেলে একদল লোক। তাদের হাতে ওয়াকিটকি। কোমরে পিস্তল। ধমক মেরে বলে, ‘তোর সাথেরটা কই গেল?’
তা–ই তো! হতভম্ব হয়ে আশপাশে তাকিয়ে আমি মৃদুগলায় ডাকি, ‘টাকাতো ভাই! টাকাতো ভাই! কই গেলেন?’
‘টাকাতো ভাই না মামাতো ভাই, সেসব পরে হবে। অ্যাই, মালটাকে গাড়িতে তোল।’
চ্যাংদোলা করে আমাকে মাইক্রোবাসে তোলা হলো। চিৎকার করে বলার চেষ্টা করলাম, ‘আরে ভাই, ওনাকে আমি চিনি না।’
‘চোপ! জাপানির সাথে চা-পানি খাও, আবার বলো চেনো না!’
মাইক্রোতে তুলে ওরা আমাকে নিয়ে ঢাকার এ মাথা-ও মাথা ঘুরল। বলল, ‘পাঁচ লাখ টাকা দে, ছেড়ে দেব। নইলে কিন্তু জালিয়াতির মামলায় ফেঁসে যাবি…’ ইত্যাদি।
এরপর ম্যালা কাহিনি। টাকা-পয়সা দিয়ে ছাড়া পেয়েছি বটে। কিন্তু পরে খোঁজ-খবর নিয়ে জেনেছি, লোকগুলা আদৌ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নয়। এমনকি যার সঙ্গে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলাম, তিনি জাপানের নাগরিক নন। এমনকি তাঁর নাম টাকাতো মারিয়াছিও নয়।