৬৪ জেলার হাজার শিশু-কিশোরের ৯৪ নাটকের মহোৎসব
গ্রামবাংলা স্পেশাল। বাসের গায়ে লেখা ‘চট্টগ্রাম-ফেনী-কুমিল্লা’। গত সোমবার রাত সাড়ে নয়টায় শিল্পকলা একাডেমি প্রাঙ্গণে থাকা সেই বাস থেকে ভেসে আসছিল শিশু–কিশোরের উল্লাসধ্বনি। কাছাকাছি আরও বেশ কয়েকটি বাস। প্রতিটির নম্বরপ্লেট আর বাসের গায়ে লেখা দেখে বোঝা গেল, সব কটিই ঢাকার বাইরে থেকে এসেছে। কুষ্টিয়া, নেত্রকোনা, বগুড়া, ঠাকুরগাঁও, সিরাজগঞ্জ—নানান জেলার।
রাজধানীর সেগুনবাগিচা এলাকার বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে ২০ সেপ্টেম্বর শুরু হয়েছে চতুর্দশ জাতীয় শিশু–কিশোর নাট্য ও সাংস্কৃতিক উৎসব। আয়োজনটি যথেষ্ট বড়। যেখানে দেশের ৬৪ জেলার ৩ থেকে ১৫ বছর বয়সী ১০ হাজার শিশু এসেছে। তারা নিয়ে এসেছে ৯৪টি নাটক। এ ছাড়া রয়েছে সমবেত ও একক গান, নৃত্য পরিবেশনা, অ্যাক্রোবেটিক প্রদর্শনী। নানা রঙে শিশু–কিশোরেরা ছবি আঁকছে প্রতিদিন। শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালা, চিত্রশালা, সংগীত ও নৃত্যকলা কেন্দ্র মিলনায়তন, একাডেমি প্রাঙ্গণসহ আটটি ভেন্যুতে প্রতিদিন চলছে পরিবেশনা। মিলনায়তন, ভবনের ভেতরে করিডর, বাইরের প্রাঙ্গণে দারুণ সাজসজ্জা। সন্ধ্যায় বর্ণিল আলোয় ঝলমল করে চিত্রশালার প্রাঙ্গণ। সব মিলিয়ে একে মহোৎসব বললে বাড়াবাড়ি হবে না।
‘ভাই, একটু দেকপেন, আমাগের শোটা ঠিক কয়টায় শুরু হবে’— জাতীয় চিত্রশালার নিচে তথ্যকেন্দ্রে এসে জানতে চাইল ঢাকার বাইরে থেকে আসা একটি দলের প্রতিনিধি। তথ্যকেন্দ্রে বসে থাকা রনজু ল্যাপটপে সূচি দেখে জানিয়ে দিলেন সঠিক সময়। তথ্যকেন্দ্রটির কথা না বললেই নয়, বেশ জাঁকজমক। এখান থেকে বিভিন্ন মিলনায়তনে অংশগ্রহণকারী শিল্পী ও অতিথিদের জন্য শুভেচ্ছা ও সম্মাননা স্মারক চলে যাচ্ছে। নিবন্ধন ও উপহারসামগ্রী দেওয়ার কাজটি এখানেই হয়। একাডেমির নয়টি মহড়াকক্ষও প্রাণচঞ্চল। বিভিন্ন জেলা থেকে আসা শিশু–কিশোরেরা সেখানে পর্যায়ক্রমে বিশ্রাম নিচ্ছে।
রোদ–বৃষ্টি মাথায় নিয়ে প্রতিদিন রোভার স্কাউটের ২০ জন তরুণ কাজ করছেন উৎসব প্রাঙ্গণে। শিল্পী ও দর্শনার্থীদের প্রাথমিক চিকিত্সাসেবা দিচ্ছে রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির একটি দল। উত্সবে শৃঙ্খলার দায়িত্বে থাকা রোভার স্কাউটের সদস্য আজিজুল আবেদীন বলেন, ‘আমার দেখামতে এখানে শুধু গান, নাটক কিংবা অভিনয় নয়, এই উত্সবে শিশুরা একটি প্ল্যাটফর্ম পাচ্ছে, যেখানে তারা একে অপরের সঙ্গে পরিচিত হতে পারছে। নিজেদের মধ্যে আলোচনা করতে পারছে, নিজেকে আগামীর জন্য প্রস্তুত করছে।’
নরসিংদীর বাঁধনহারা থিয়েটার স্কুলের শিল্পীরা মঞ্চস্থ করে দৈত্য হলো খেলার সাথী নাটকটি। এ দলের নির্দেশক কামরুজ্জামান বলেন, ‘এর আগে নরসিংদীর বাইরে, এমনকি ঢাকাতে এই নাটকের প্রদর্শনী হয়েছে। তবে জাতীয় নাট্যশালায় এই প্রথম। বড় মঞ্চে কাজ করলে শিশুদের আত্মবিশ্বাস বাড়ে। ঢাকার বাইরের শিশু–কিশোরদের জন্য এটা বিশাল অনুপ্রেরণা।’
রাজা ও রাজদ্রোহী নাটকটি নিয়ে এসেছে ঢাকার পিপলস থিয়েটার। এ দলের সদস্য টইটই হিলালী বলেন, ‘এই উৎসবেই আমরা অন্য বন্ধুদের কাজ দেখি। নিজেদের কাজও দেখানোর সুযোগ পাই। এই বিনিময়ের তুলনা হয় না। সারা বছর আমরা অপেক্ষায় থাকি এই উৎসবের।’
বাবার সঙ্গে উৎসবে নাটক দেখতে এসেছিল সাজিয়া শিল্পী। আহ্লাদভরা কণ্ঠে বলল, ‘আমাদের বাসা সেগুনবাগিচায়। প্রায়ই আসি এখানে। কিন্তু ছোটদের জন্য কোনো অনুষ্ঠান থাকে না। আমার খুব ভালো লাগছে এই অনুষ্ঠানটা দেখে। উৎসবের পর আমাদের জন্য শুক্র-শনিবারও যদি এমন কোনো অনুষ্ঠান থাকে, তাহলে খুব ভালো হতো।’
উৎসবের আয়োজক পিপলস থিয়েটার অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠাতা ও একাডেমির মহাপরিচালক
লিয়াকত আলী বলেন, ‘দেশের জনসংখ্যার প্রায় ৩৫ শতাংশ শিশু। শিশুদের বাদ দিয়ে শিল্পকলা একাডেমির কোনো কার্যক্রম পরিচালিত হতে পারে না । শিশুদের নিয়ে বড়সড় আয়োজন ছাড়া শিল্পের বিকাশ সম্ভব নয়। আমরা শিশুবান্ধব সমাজ নির্মাণ করতে চাই।’