
শহরে বাঁশরিয়া আসবেন। সে জন্য কত তোড়জোড়! ভোরের রাগ বাজিয়ে তিনি শহরে একটি সকাল ফোটাবেন, তার অপেক্ষায় হাজার হাজার তরুণ-তরুণী জড়ো হয় এক খোলা ময়দানে।
অনেকটা রূপকথার মতো মনে হলেও এই গল্প আমাদের প্রিয় রাজধানী ঢাকারই। আর সত্যিই গতকাল ২ ডিসেম্বরের ভোরটা ফুটেছিল পণ্ডিত হরিপ্রসাদ চৌরাশিয়ার বাঁশিতে ভাটিয়ালি সুরের মধ্য দিয়ে। রাজধানীর আর্মি স্টেডিয়ামের গ্যালারি, মাঠ উপচে পড়া নানা বয়সী দর্শক তার সাক্ষী।
উৎসব শেষ হয়েছে। কিছু রেশ রেখে গেছে। সেসবের ছুঁয়ে যাওয়া কিছু অনুভূতি ভাগাভাগি করে নেওয়া যাক। আপনার সঙ্গে যদি মিলে যায়, তাহলে ধরে নেব আমরা এক গোত্রের লোক।
‘বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসব ২০১৫’-এর চতুর্থ এই আয়োজনের শুরুটা করা যাক মাঠের ঘাসে পেতে রাখা বেঞ্চগুলো দিয়ে। বিদেশি সিনেমাগুলোতে এমন বেঞ্চ দেখা যায়। অনুষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠান ব্লুজ কমিউনিকেশনস বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ঘুরে দেখে বানিয়ে এনেছে এসব। আর বেঞ্চগুলো পছন্দ করেছেন দর্শকেরা।
উৎসবের প্রথম দিন গাইবেন কৌশিকী চক্রবর্তী। স্যাটেলাইট চ্যানেলের কল্যাণে তিনি আমাদের চেনামুখ। নানা অনুষ্ঠানে প্রায়ই এ দেশে আসেন। তা ছাড়া বিখ্যাত পণ্ডিত অজয় চক্রবর্তীর কন্যা হিসেবে আমাদের কাছে তিনি একটু বেশিই কদর পান। কিন্তু এই উৎসবে তিনি এবার গাইতে এসে ঢাকাবাসীর প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেননি। তাঁর কণ্ঠই বলে দিচ্ছিল খানিকটা অমনোযোগী আর বিষণ্নতা ভর করেছে তাঁর ওপর। প্রত্যাশা পূরণ না হওয়ায় ঢাকাবাসী যে খানিকটা ব্যথিত, তা কিন্তু নয়। প্রত্যাশা আর সব বিষণ্নতাকে ঝেড়ে ফেলুন। হয়ে উঠুন সেই আগের মতো।
উৎসবের তৃতীয় দিন আর্মি স্টেডিয়ামে এত মানুষ এলেন যে সবার সঙ্গে সবার গায়ে গায়ে ধাক্কা লেগে যাচ্ছিল। কাউকে বলতে শোনা গেছে, ‘কী ব্যাপার, আজ এলেন যে!’ উত্তরও প্রস্তুত, ‘আজ যে ওস্তাদ জাকির হোসেন বাজাবেন। তাই ভোরে অফিসের তাড়া উপেক্ষা করে চলে এলাম।’ যদিও এই দিনে শিব কুমার শর্মার বাদন আচ্ছন্ন করে রেখেছিল মাঠভর্তি দর্শকদের। ওস্তাদ জাকির হোসেন তাঁর সেই নিজস্ব রীতিতেই বায়া-তবলার ঝড় তুললেন।

আর উৎসবের শেষ রাতের কথা একটু বলার লোভ সামলে রাখা যাচ্ছে না। প্রকৃত অর্থেই সেদিন তিল ধারণের জায়গা ছিল না মাঠে। মাত্র কদিন আগে পূর্ণিমা গেছে বলে আকাশে একটা ক্ষয়িষ্ণু চাঁদ ছিল বটে। সে সময় এই বাঁশরিয়া বাজিয়ে শোনান রাগ কিরওয়ানি। এরপর রাগ জৈত রূপক ও তিনতাল। এরপর তিনি ভাটিয়ালি ধুন বাজিয়ে শেষ করেন। তাঁর সঙ্গে তানপুরাতে ছিলেন পুষ্পাঞ্জলী, তবলায় শুভংকর ব্যানার্জি এবং পাখওয়াজে পণ্ডিত ভবানী শংকর।

এবারের উৎসবে শিল্পীসংখ্যা আগের তুলনায় কম থাকলেও বেড়েছে বৈচিত্র্য। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগীত বিভাগ এবং বেঙ্গল পরম্পরা সংগীতালয়ের শিক্ষার্থীরা দর্শক-শ্রোতার অভিবাদন কুড়িয়েছে। আর বাংলাদেশের পল্লবী ড্যান্স গ্রুপ এবং মণিপুরি নাচের জন্য অভিনন্দিত হয়েছেন ওয়ার্দা রিহাব ও তাঁর দল। এ ছাড়া রাজা ও রাধা রেড্ডির কুচিপুড়ি নাচ এবং বিদুষী আলারমেল ভাল্লীর ভরতনাট্যম উৎসবকে দিয়েছে অসাধারণত্ব।
এবার ব্যতিক্রম আয়োজন ছিল পারিবারিক পরিবেশনা। যেমন একই মঞ্চে সুরেশ তালওয়ালকার ও তাঁর কন্যা সাওয়ানি তালওয়ালকারের অনবদ্য বাজনা। আবার এন রাজমের পাশে বসে বাজিয়েছেন তাঁর কন্যা ও দুই নাতনি। একই সঙ্গে না বাজালেও এই মঞ্চে এভাবে বাজিয়েছেন, গুরু-শিষ্য, পিতা-পুত্র। স্মৃতিধন্য এই মঞ্চ উপলব্ধি করিয়েছে, শাস্ত্রীয় সংগীত সবার জন্য। শোনা যায়, তানসেনের বাদন সম্রাট আকবর ছাড়া খুব বেশি মানুষ শোনার সৌভাগ্য অর্জন করেননি। কিন্তু তানসেনের মতো গুণবান শিল্পীকে আমরা পাচ্ছি এই মঞ্চে, সে আমাদের সৌভাগ্য।
এভাবে নানা মাত্রা যুক্ত করে এই উৎসবকে মহিমামণ্ডিত করেছে বেঙ্গল ফাউন্ডেশন। তাই বলা যায়, এবারের উৎসবে যাঁরা যেতে পারেননি, তাঁরা আসলে খানিকটা বঞ্চিতই হয়েছেন। আয়োজকদের প্রত্যাশা, শাস্ত্রীয় সংগীত মানুষের কান থেকে হৃদয়ে পৌঁছে যাক, স্থায়ী আসন করে নিক। এতে তাঁদের হাতে অন্তত কোনো অনৈতিক কাজ হবে না।