মুক্তিযুদ্ধ, কাননবালা ও 'ফ্রম বাংলাদেশ'
: আপনি নাকি নতুন ছবির শুটিং করছেন?
: কে বলেছে?
: শুনলাম।
: হ্যাঁ, ১০ অক্টোবর থেকে শুটিং শুরু করব।
: কোথায় কাজ করবেন?
: মানিকগঞ্জে। এখানে পুরোনো এক জমিদারবাড়িতে।
পরিচালক শাহনেওয়াজ কাকলীর কাছ থেকে এভাবেই জানা গেছে তাঁর নতুন ছবির খবর। ছবির নাম ‘ফ্রম বাংলাদেশ’। শুটিং দেখার আমন্ত্রণ জানিয়ে বললেন, ‘১৯ অক্টোবর চলে আসুন। সেদিন ছবির বেশির ভাগ শিল্পী থাকবেন।’
নির্ধারিত দিন সকালে শুটিং স্পটের ঠিকানা পাঠালেন। জানালেন, মানিকগঞ্জ হলেও যেতে হবে হেমায়েতপুরের রাস্তা দিয়ে। বেতিলা, সতুবাবুর বাড়ি।
বাংগড়া সড়ক দিয়ে যাচ্ছি, পাশে কালীগঙ্গা নদী। ইট বিছানো রাস্তা। দুধারে বাঁশঝাড়। রাস্তার এক পাশে ১৮ শতকের মাঝামাঝি সময়ে তৈরি কয়েকটি বড় বাড়ি যেমন আছে, তেমনি আছে কয়েক বছর আগে তৈরি অনেক নতুন বাড়ি। চারদিক খুব নিরিবিলি। একসঙ্গে অনেক পাখির ডাক। রাস্তায় তেমন মানুষজন নেই।
বাংগড়া সড়কের পাশে একটি পুরোনো জমিদারবাড়ি। সবার কাছে এটা ‘সতুবাবুর বাড়ি’। বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছেন প্রাণ রায়। স্বাগত জানালেন। সঙ্গে তাঁর পোষা কুকুর। বললেন, ‘ওর নাম বাটার। ও কিন্তু এই ছবিতে অভিনয় করছে।’
বাড়ির ভেতরে শুটিং হচ্ছে, তা বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই। ভেতরে ঢুকেই বোঝা গেল, এখানে চলছে মহাযজ্ঞ।
বাড়ির উঠান পেরিয়ে রান্নাঘর। রান্নাঘরের বাইরে থেকে শাহনেওয়াজ কাকলী দৃশ্য বুঝিয়ে দিচ্ছেন। চলছে শুটিংয়ের মহড়া। পরিচালক নিজেই অভিনয় করে দেখিয়ে দিচ্ছেন, আবার ক্যামেরায় চোখ দিয়েও দেখছেন। গিয়ে বসছেন মনিটরের সামনে। দৃশ্য ধারণের আগে চলছে চূড়ান্ত প্রস্তুতি। এভাবেই টুকরো টুকরো দৃশ্য ধারণ করা হচ্ছে। এরপরও প্রতিটি শট ১০-১৫ বার করে নেওয়া হচ্ছে। ততক্ষণে ভেতরে থাকা শিল্পীরা গরমে ঘেমে গেছেন। একটি শট ‘ওকে’ হতেই বাইরে বেরিয়ে এলেন ঊর্মিলা শ্রাবন্তী কর আর তমালিকা কর্মকার। দূর থেকে হাত নেড়ে শুভেচ্ছা জানিয়ে আবার দ্রুত ঢুকে যান রান্নাঘরের ভেতরে।
রান্নাঘরের এক পাশে বসে তরকারি কেটেই যাচ্ছেন তমালিকা কর্মকার। বললেন, ‘ছবি দেখে সবাই ভাববে, আমি কত সবজি কাটতে পারি।’
মহড়ার জন্য সবজি কাটতে কাটতে এমন অবস্থা হলো, চূড়ান্ত শট নেওয়ার সময় সবজি শেষ। নতুন সবজি আনার জন্য প্রোডাকশনের একটি ছেলেকে পাঠানো হলো বাজারে। ছেলেটি সবজি নিয়ে দ্রুত ফিরে আসে। তার ফাঁকে চলছে মাটির চুলায় ঊর্মিলা শ্রাবন্তী করের বেগুন ভাজা আর ইলিশ মাছ ভাজা। কাঁসার বড় থালায় এগুলো জমিয়ে রাখা হয়। এদিকে এই থালার ক্লোজ শট নিতে গিয়ে দেখা গেল, ততক্ষণে ভাজা মাছের সংখ্যা একেবারেই কমে গেছে।
শাহনেওয়াজ কাকলী চিৎকার করে উঠলেন, ‘এখান থেকে এতগুলো মাছ খাইছে কে?’
প্রোডাকশনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একজন এসে পরিচালকের কানের কাছে গিয়ে কিছু বললেন। এবার শাহনেওয়াজ কাকলী বললেন, ‘ঠিক আছে, আগে শট শেষ করি।’ হয়তো জানা গেছে, মাছগুলো কে খেয়েছেন।
শুটিং স্পটে এলেন ফেরদৌসী মজুমদার। প্রতিদিন ঢাকা থেকে গিয়ে তিনি সেখানে শুটিং করছেন। বললেন, ‘প্রতিদিন যাওয়া-আসা করছি। আমিই চেয়েছি। ওরা এখানে থাকতে বলেছিল। কিন্তু প্রথম দিনই বুঝেছি, আমি আসলেই হোমসিক। নিজের বিছানা ছাড়া ঘুমাতে পারি না। মনে হয়, যত রাতই হোক, বাসায় যাই।’
ফেরদৌসী মজুমদার এর আগে দুটি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। পরিচালক শিবলি সাদিকের ‘মায়ের অধিকার’ আর নারগিস আক্তারের ‘মেঘলা আকাশ’। বললেন, ‘আমি অনেকগুলো ভালো ভালো ছবি মিস করেছি। আবদুল্লাহ আল-মামুন আমাকে “সারেং বউ” করতে বলেছিলেন। তখন সংসার, স্বামী, সন্তান নিয়ে এত ব্যস্ত ছিলাম, করতে পারিনি। আমার কাছে সংসার আগে। “সূর্য দিঘল বাড়ী” করা হয়নি। পরে সেই চরিত্রটি করেছেন ডলি আনোয়ার। কারণ তখন ত্রপার বয়স ছিল ৫-৬ বছর।’
‘ফ্রম বাংলাদেশ’ ছবির গল্পের প্রেক্ষাপট মুক্তিযুদ্ধ। কিন্তু ছবির কোথাও সরাসরি মুক্তিযুদ্ধ নেই। মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের কোনো এলাকার এক হিন্দু পরিবারের বাড়ির ভেতরে কী পরিস্থিতির তৈরি হয়েছিল, তাই নিয়ে গল্প লিখেছেন মিশু মিলন। পরে তাঁর চিত্রনাট্য লিখেছেন ও পরিচালনা করছেন শাহনেওয়াজ কাকলী। সেই বাড়ির ৮০ বছর বয়সের বৃদ্ধা কাননবালা। বনেদি পরিবার। তাঁর চলাফেরা, কথা বলা, মেজাজ—সবকিছুতেই রয়েছে দোর্দণ্ড প্রতাপ। এই বৃদ্ধা শুচিবায়ুগ্রস্ত। নিম্ন বর্ণের হিন্দু কিংবা অন্য ধর্মের কাউকে সহ্য করতে পারেন না। একসময় তাঁর ছেলে পরিবারের অন্যদের নিয়ে ভারতে চলে যান। কিন্তু বৃদ্ধা যাননি। তিনি এই বাড়িতেই থেকে যান। এরপর তাঁর কী হয়, তা ফুটে উঠেছে গল্পে। আর দর্শক তা দেখতে পাবেন অনেক বছর পর তার ছেলের স্মৃতিচারণা থেকে।
ছবিতে এই ‘কাননবালা’ চরিত্রে অভিনয় করছেন ফেরদৌসী মজুমদার। পরিচালক কথা প্রসঙ্গে আগেই জানিয়েছেন, ছবিতে মোট দৃশ্য রয়েছে ৯৬টি। এর মধ্যে ৮০টি দৃশ্যের শুটিং হচ্ছে সতুবাবুর বাড়িতে। বাকি কাজ হবে পুবাইল আর আরিচা ঘাটে। সতুবাবুর বাড়ির বেশির ভাগ দৃশ্যেই আছেন ফেরদৌসী মজুমদার।
‘কাননবালা’ চরিত্রে ফেরদৌসী মজুমদার কেন? শাহনেওয়াজ কাকলী বললেন, ‘আমি চেয়েছিলাম, এই ছবির চরিত্রগুলোতে যাঁদের নেওয়া হবে, ১৯৭১ কী, তাঁরা সেটা জানেন। মনের মধ্যে অন্তত সেই সময়ের যন্ত্রণা কাজ করে। এখানে যুদ্ধ নেই, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ এর সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। একটা আবেগের জায়গা আছে। চেষ্টা করেছি, যাঁরা এখানে কাজ করবেন, তাঁরা হবেন মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের মানুষ। আর মুক্তিযুদ্ধকে নিজের মধ্যে ধারণ করেন। সে ক্ষেত্রে কাননবালা চরিত্রের জন্য ফেরদৌসী মজুমদার ছাড়া কে হতে পারে?’
আর ফেরদৌসী মজুমদার বললেন, ‘খুবই কষ্ট, আমি এতটা কল্পনা করিনি। কষ্ট করলেও চরিত্রটার একটা আনন্দ আছে। সবাইকে বলি, আমাকে এমন চরিত্র দেবে, যেটা আমি নই। আমাকে কিছু করতে তো হবে। এখানে কাননবালার দোর্দণ্ড প্রতাপ, বয়স হয়ে গেছে, এখনো ছুৎ-অচ্ছুত, এ ছোঁবে না ও ছোঁবে না—এটা খুব ভালো লেগেছে। সে মুসলমান দেখতে পারে না, নিম্নবর্ণের হিন্দুদের দেখতে পারে না, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাদের সঙ্গে কাননবালার সম্পর্ক তৈরি হয়। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দারুণ উপস্থাপন।’
এই ছবির শিল্প নির্দেশক প্রাণ রায় বললেন, ‘আমরা এই গল্পের সঙ্গে মিলে যায়, এমন একটি পুরোনো বাড়ির জন্য কুষ্টিয়া, নড়াইল গেছি। কিন্তু গল্পের জন্য যা যা প্রয়োজন; এই যেমন বাথরুম, কুয়া, ঘর, রান্নাঘর, আবার ঘর থেকে সবকিছু দেখা যায়—সব মিলিয়ে পাচ্ছিলাম না। হঠাৎ এই বাড়ির খবর পেলাম। বাড়িটা তখন অনেক নোংরা ছিল। তারপর চিন্তা করলাম এটাকে যদি সংস্কার করে নেওয়া যায়, তাহলে কাজ করা সম্ভব হবে। প্রয়োজনীয় সংস্কারের পর বাড়িটি আমাদের শুটিংয়ের উপযোগী হলো। এখন মনে হচ্ছে, এই গল্পের জন্য এই বাড়িটার খুব প্রয়োজন ছিল।’
‘ফ্রম বাংলাদেশ’ ছবিতে অভিনয় করছেন গাজী আবদুন নূর। বাংলাদেশের দর্শকের কাছে তিনি জি বাংলার জনপ্রিয় সিরিয়াল ‘রাণী রাশমণি’র ‘বাবু রাজচন্দ্র’। ‘রাণী রাশমণি’র পর বাংলাদেশে এটা তাঁর প্রথম কাজ। বললেন, ‘আমার বাবা মুক্তিযোদ্ধা, কাকা মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হিসেবে অন্য রকম আবেগের জায়গা থেকে এই চলচ্চিত্রে কাজ করছি। ভালো লাগছে। মুক্তিযুদ্ধের গল্পকে গতানুগতিক একটা ধারা থেকে আমরা দেখি, কিন্তু এখানে প্রেক্ষাপটটা দেখানো হয়েছে অন্যভাবে।’
শুটিংয়ের ফাঁকে হঠাৎ দেখা গেল মৌসুমী নাগকে। জানালেন, সেদিন তাঁর অংশের কাজ শেষ হবে। কিছুক্ষণের মধ্যেই তৈরি হয়ে ক্যামেরার সামনে দাঁড়ালেন। যাওয়ার আগে বললেন, ‘খুব ভালো একটা কাজ হচ্ছে।’
তমালিকা কর্মকার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন আবু সাইয়ীদের ‘কীর্তনখোলা’ (২০০০) ছবির জন্য। এ ছাড়া তিনি আরও চারটি ছবিতে অভিনয় করেছেন। বললেন, ‘এই ছবিতে অভিনয় করছেন ফেরদৌসী মজুমদার আর ছবির গল্পটি মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে। আমি জানি শাহনেওয়াজ কাকলী ভালো কাজ করে। সব মিলিয়ে এই সুযোগ হাতছাড়া করতে চাইনি।’ ছবিতে আরও আছেন আশীষ খন্দকার, তমা মির্জা, হিল্লোল প্রমুখ।
এর আগে শাহনেওয়াজ কাকলীর ‘উত্তরের সুর’ (২০১২) ছবির জন্য সেরা ছবি, সেরা কাহিনি, সেরা পার্শ্বচরিত্র ও সেরা শিশুশিল্পী বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছে। দ্বিতীয় ছবি ‘নদীজন’ (২০১৫) পেয়েছে সেরা নায়িকা বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। এবার নতুন ছবির নিয়ে বললেন, ‘৮ বছর ধরে এরই ছবির পরিকল্পনা করছি। আর ১০ বছর যাবৎ এই ছবির সব প্রপস জোগাড় করছি। সাম্প্রদায়িক অশান্তির মধ্যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির গল্প খুবই প্রাসঙ্গিক বলে মনে হয়েছে। আর ছবিটি তৈরির জন্য আর্থিক সহযোগিতা করতে এগিয়ে এসেছেন আমার কয়েকজন ছাত্র। আমার কাছে এটা অনেক বড় পুরস্কার বলে মনে হয়েছে।’