প্রাপ্তি আদায়ের পথ খুঁজছে সংগীতাঙ্গন
করোনা যেমন ভুগিয়েছে, তেমনি শিখিয়েছেও অনেক। দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ার পরিস্থিতিতে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার কথা ভেবেছে সংগীতাঙ্গন। অধিকার আদায়ের তাগিদে কণ্ঠশিল্পী, সুরকার, গীতিকারেরা এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি সচেতন। সংগীতচর্চা ও পরিবেশনের পাশাপাশি তাঁরা এখন নিজেদের ন্যায্য প্রাপ্তির পথ খুঁজছেন। অনেকে নিয়মিত রেমিট্যান্সও পাচ্ছেন। সম্ভাবনাময় এ অঙ্গনের দুর্নীতি দূর করে স্বচ্ছ, সুন্দর পরিবেশ বজায় রাখার লক্ষ্যে মিউজিক বোর্ড গঠনের প্রয়োজনীয়তার কথা বলছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
ইতিমধ্যে এ অঙ্গনের বেশ কিছু জটিলতার মীমাংসা হয়েছে। নতুন আঙ্গিকে সংগঠিত হয়েছেন শিল্পীরা। ১৯৭৭ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে ফিডব্যাক ব্যান্ডের সদস্যদের মধ্যে কখনোই কোনো লিখিত চুক্তি হয়নি। ব্যান্ডের অন্যতম সদস্য মাকসুদ একসময় সেই দল ছেড়ে গড়েন আরেকটি ব্যান্ড। নতুন দলটি যখন মঞ্চে ফিডব্যাকের গান পরিবেশন শুরু করে, তৈরি হয় স্বত্ব নিয়ে জটিলতা, যা চলতে থাকে বছরের পর বছর। অবশেষে গত ২৫ আগস্ট বাংলাদেশ কপিরাইট অফিসের মধ্যস্থতায় ফিডব্যাকের গানগুলোর বাণিজ্যিক স্বার্থ সুরক্ষার পাশাপাশি রয়্যালটির সুষম বণ্টন নিশ্চিতে ফিডব্যাক ও মাকসুদের মধ্যে সমঝোতা হয়।
‘যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতে কপিরাইট ক্লেইম বোর্ড নামে একটি প্রতিষ্ঠান আছে। আমাদেরও সব সংগঠনের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে মিউজিক বোর্ড গঠন করতে হবে।’জাফর রাজা চৌধুরী
এভাবে মাইলস, শিরোনামহীন, ওয়ারফেজ, সরলপুর ব্যান্ড এবং ‘আমি তো ভালা না’ গানের বিষয়ে গীতিকার ও সুরকার টিটু পাগলের স্বীকৃতিরও সমাধান হয়। এ–সংক্রান্ত অভিযোগ দিয়ে বিভিন্ন সময় সমাধান পেয়েছেন ফরিদা পারভীন, দিলরুবা খান, শুভ্র দেব, সেলিম চৌধুরী, মনির খানসহ আরও বেশ কয়েকজন জনপ্রিয় শিল্পী।
স্বীকৃতি বা অধিকার আদায় বা প্রাপ্তি নিশ্চিতে কখনো কখনো আনুষ্ঠানিক প্রমাণপত্র জরুরি। কয়েক বছর আগেও এ বিষয়ে উদাসীন ছিলেন শিল্পীরা। এখন তাঁরা সচেতন। বাংলাদেশ কপিরাইট অফিস সূত্রে জানা গেছে, ২০১৭ সাল পর্যন্ত বছরে গড়ে রেজিস্ট্রেশনের সংখ্যা ছিল মাত্র সাড়ে ৫০০। ক্রমেই সেটা বেড়েছে। পরের বছর রেজিস্ট্রেশন বেড়ে হয় ১ হাজার ৭৯৫টি, গত বছর হয় ৩ হাজার ২০৫টি। চলতি বছরের আগস্ট মাস পর্যন্ত রেজিস্ট্রেশন সংখ্যা ১ হাজার ৭১১টি। এ প্রসঙ্গে রেজিস্ট্রার অব কপিরাইটস (যুগ্ম সচিব) জাফর রাজা চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, রয়্যালটি নিয়ে শত শত অভিযোগ ছিল। গীতিকার-সুরকারেরা প্রায়ই অভিযোগ দিতেন, তাঁরা রয়্যালটি পাচ্ছেন না। নিজের গান নিজে ইউটিউবে আপলোড করতে বাধার মুখে পড়ছেন। এ বিষয়ে সবাইকে বুঝিয়ে সচেতন করতে তিন বছর লেগে গেছে।
পরিস্থিতি বিবেচনায় কিছু কিছু ক্ষেত্রে এখনো সংস্কার এবং বাড়তি উদ্যোগের প্রয়োজন। যেমন শিল্পীদের রয়্যালটি বাস্তবায়নে সরকার অনুমোদিত সিএমও বাংলাদেশ লিরিসিস্টস কম্পোজার্স অ্যান্ড পারফরমার্স সোসাইটি (বিএলসিপিএস) ২০১৪ সালে গঠিত হয়। গত ছয় বছরে প্রতিষ্ঠানটির কোনো কার্যক্রম ছিল না। আবার সরকারি অনুমোদন ছাড়া বাংলাদেশে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান অবৈধ ব্যবসা করছে গানের বাজারে। জাফর রাজা চৌধুরী মনে করেন, এসব থেকে উত্তরণের উপায় হচ্ছে মিউজিক্যাল বোর্ড গঠন। তিনি বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতে কপিরাইট ক্লেইম বোর্ড নামে একটি প্রতিষ্ঠান আছে। আমাদেরও সব সংগঠনের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে মিউজিক বোর্ড গঠন করতে হবে।’
বর্তমান বাজারে সংগীতচর্চা শুধু শখ নয়, পেশা হিসেবে নেওয়ার সময় এসেছে। কিন্তু নানা রকম অনিয়মের কারণে এত দিন একে পেশা হিসেবে নেওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়নি। সম্মিলিতভাবে ক্ষেত্র তৈরি করে পরের প্রজন্মের জন্য ন্যায্য প্রাপ্তির পথ বের করতে হবে।আসিফ ইকবাল
সংগীতাঙ্গনে নীতিমালা গঠনের কথাও বলছেন কেউ কেউ। সদ্য সংগঠিত কণ্ঠশিল্পী পরিষদ বাংলাদেশের আহ্বায়ক রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা বলেন, বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ৫০ বছরও অবহেলিত সংগীতাঙ্গনের কোনো সুষ্ঠু নীতিমালা করা যায়নি। অথচ সংস্কৃতির অন্য প্রায় সব শাখার রয়েছে শক্তিশালী সংগঠন।
গীতিকবি আসিফ ইকবাল বলেন, ‘বর্তমান বাজারে সংগীতচর্চা শুধু শখ নয়, পেশা হিসেবে নেওয়ার সময় এসেছে। কিন্তু নানা রকম অনিয়মের কারণে এত দিন একে পেশা হিসেবে নেওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়নি। সম্মিলিতভাবে ক্ষেত্র তৈরি করে পরের প্রজন্মের জন্য ন্যায্য প্রাপ্তির পথ বের করতে হবে।’
সংগীতাঙ্গনের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যে পারস্পরিক যোগাযোগ থাকলেও অধিকার এবং প্রাপ্তির জায়গায় গরমিল ছিল। এ নিয়ে নানা সময়ে নতুন নতুন সংকট, জটিলতা তৈরি হতো। সম্প্রতি সেসব নিরসনে শিল্পীদের তৎপরতার পাশাপাশি কপিরাইট অফিসের উদ্যোগও ইতিবাচক ভূমিকা রাখছে বলে মনে করছেন অনেকে। সংগীতাঙ্গনে এখন পালাবদলের সময় যাচ্ছে। ইতিবাচক মানসিকতা নিয়ে এগিয়ে গেলে প্রাপ্তির পথ মসৃণ হবে।