দুই দশকে ১২৬১টি হল বন্ধ
একে একে নিভেছে দেশের সিনেমা হলগুলোর বাতি। গত ২০ বছরে সারা দেশে ১ হাজার ২৬১টি হল বন্ধ হয়ে গেছে। বেশির ভাগ এলাকায় হলের মালিকেরা ভবনগুলো ভেঙে ফেলে বহুতল বিপণিবিতান গড়ে তুলছেন। দেশের এখন অনেক জেলা এমনকি বিভাগীয় শহর আছে, যেখানে একটিও সিনেমা হল নেই। গত ১০ বছরে এ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ৯০ শতাংশ কর্মী পেশা ছেড়ে দিয়েছেন। এ অবস্থায় আগামী ১২ এপ্রিল থেকে সারা দেশের প্রেক্ষাগৃহগুলো বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বাংলাদেশ চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতির নেতারা।
সমিতির উপদেষ্টা মিঞা আলাউদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, নব্বইয়ের দশকের শুরুতে সারা দেশে সিনেমা হল ছিল ১ হাজার ৪৩৫ টি। কমতে কমতে গত বছর ঈদে ৩০০-র বেশি সিনেমা হলে ছবি চলেছে। তবে ছয় মাসের মাথায় তা ২৫০-এ নেমে আসে। চলতি সপ্তাহের হিসাবে সারা দেশে সিনেমা প্রদর্শিত হচ্ছে এমন হলের সংখ্যা ১৭৪।
এই শিল্পে নিয়োজিত মানুষের সংখ্যাও ব্যাপকভাবে কমছে। প্রদর্শক সমিতির দেওয়া তথ্যানুযায়ী, মাত্র ১০ বছর আগেও সারা দেশে সিনেমা হলের সঙ্গে প্রায় ৫০ হাজার কর্মী জড়িত ছিলেন। এখন সেটা পাঁচ হাজারের নিচে নেমে গেছে।
ঢাকা ও আশপাশের এলাকায় একের পর এক সিনেমা হল বন্ধ হয়েছে। এর মধ্যে আছে পুরান ঢাকার গুলিস্তান, নাজ; সদরঘাটের রূপমহল, মুন, স্টার; আরমানিটোলার শাবিস্তান; এলিফ্যান্ট রোডের মল্লিকা; বাসাবোর অতিথি, আগমন; ইসলামপুরের লায়ন; চকবাজারের তাজমহল; পোস্তগোলার মেঘনা, যমুনা, ডায়না; শ্রীনগরের ঝুমুর; নারায়ণগঞ্জের মিনতি; কারওয়ান বাজারের পূর্ণিমা। সবশেষে বংশালের মানসী হলটির মূল মিলনায়তন ভেঙে সেখানে মার্কেট করা হয়েছে। এটি ঢাকার প্রথম ১০ হলের একটি। কর্তৃপক্ষ ছোট পরিসরে প্রদর্শনী কক্ষ তৈরির কথা বলেছে; তবে গতকাল শুক্রবার পর্যন্ত তেমন কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি।
রাজধানীর পরেই চলচ্চিত্রের বড় বাজার ছিল চট্টগ্রাম, টাঙ্গাইল, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, যশোর। চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতি চট্টগ্রামের সভাপতি ও সিনেমা প্যালেসের মালিক আবুল হোসেনের দেওয়া তথ্যমতে, গত দুই দশকে বন্দরনগরী চট্টগ্রামে বন্ধ হয়ে গেছে ২০টি প্রেক্ষাগৃহ। হারিয়ে গেছে অলংকার, লায়ন্স, সানাই, রঙ্গম, সাগরিকা, বনানী, নূপুর, জলসা, গুলজার, উপহার, রিদম, উজালা, আকাশ, মেলোডি, সিনেমা কর্ণফুলী।
বিভাগীয় শহর রাজশাহী ও কুমিল্লায় কোনো সিনেমা হল নেই। একসময় যশোরের পরিচিতি ছিল সিনেমা হলের শহর হিসেবে। ২১টি সিনেমা হল থেকে কমতে কমতে এখন মাত্র ২টি সিনেমা হল চালু আছে। খুলনায় সিনেমা হল ছিল ১১ টি। এখন আছে তিনটি। সিলেটের সাতটির মধ্যে একটি এবং রংপুরের পাঁচটি হলের মধ্যে একটি টিকে আছে।
পর্যটননগরী কক্সবাজারে আগে দুটি হল ছিল। রাঙামাটি শহরেও নেই সিনেমা হল। আগে এখানে তিনটি হল ছিল। নরসিংদী জেলা শহরের তিনটি সিনেমা হলের একটিও এখন চালু নেই। ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরে তিনটি হলের সব কটিই এখন বন্ধ। সিনেমা হল নেই ঝালকাঠি, নড়াইল, পঞ্চগড়, মুন্সিগঞ্জ, নেত্রকোনা জেলা শহরেও। এ ছাড়া পটুয়াখালী, দিনাজপুর, ফরিদপুর, মানিকগঞ্জ, নেত্রকোনা, জামালপুরে বর্তমানে মাত্র একটি করে হল চালু আছে।
কয়েকজন পরিচালক বললেন, একসময় ছবি প্রদর্শনের মধ্যে অশ্লীল ‘কাটপিস’ ভিডিও দেখাতেন কিছু হলমালিক। এ কারণে দর্শকের একাংশ হলবিমুখ হতে থাকে। অবশ্য প্রেক্ষাগৃহের মালিকেরা বলছেন, ছবির সংকটই দর্শক হারানোর মূল কারণ। শুধু দেশীয় ছবি দিয়ে এই মুহূর্তে হল চালানো সম্ভব নয়। চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতির সভাপতি ইফতেখার উদ্দীন নওশাদ বলেন, এখন হল চালু রেখে লাভের মুখ দেখা দূরে থাক, খরচও ওঠানো অসম্ভব হয়ে গেছে।