>ঈদে মুক্তি পেয়েছে পাঁচটি চলচ্চিত্র চিটাগাইঙঙ্গা পোয়া নোয়াখাইল্লা মাইয়া, সুপার হিরো, পাংকু জামাই, পোড়ামন ২ ও কমলা রকেট। পাঁচটি ছবির জোরেই খুলেছে বেশ কিছু নতুন সিনেমা হলও। ছবি দেখতে দর্শক সমাগমও কম নয়। কিন্তু সমালোচকেরা কী বলেন? গত সপ্তাহে পোড়ামন ২ ও কমলা রকেট-এর সমালোচনার পর আজ ছাপা হলো বাকি তিনটি ঈদের চলচ্চিত্রের সমালোচনা।
ইদানীং কিছু প্রযোজক ও পরিচালক গল্প লেখার পর এসে বলেন, ‘ভাই, গল্পটা খুবই পছন্দ হয়েছে, দারুণ লিখেছেন, তবে...।’ থমকে তাকাতাম, তবে আবার কী। দারুণ লেখার পরও তবে। একটু চিন্তিত হতাম। লজ্জা-শরমের মাথা খেয়ে তবে বলতেন তাঁরা, ‘গল্পে একটা দ্বিতীয় নায়িকা একটু ঢুকিয়ে দিন।’ সেটা বলেও ক্ষান্ত হতেন না, সঙ্গে পরামর্শ দিয়ে দিতেন কীভাবে রাখা হবে, ‘বেশি দৃশ্য দিতে হবে না। চার-পাঁচটা মাত্র। সুন্দর নতুন একটা মেয়ে পেয়েছি, তাকে একটা সুযোগ দেব। প্রধান নায়ক-নায়িকা তো আছেই, তার সঙ্গে একটা নতুন নায়িকা যদি নিয়ে আসি, তবে চলচ্চিত্রের এই নায়িকাসংকটে একটা নতুন মেয়ে পেতাম।’
আমি যা বোঝার বুঝে ফেলেছি। কিন্তু তাঁরা বোঝেননি যে একজন নতুন নায়িকা প্রতিষ্ঠা করতে হলে দু-চারটা দৃশ্যে হয় না। জানি না পাংকু জামাইর পরিচালক-প্রযোজক ওই রকম গল্পকার মোজাম্মেল হককে কিছু বলেছিলেন কি না! গল্পকারও তাঁর চাকরি বজায় রাখতে একটা সুন্দর রানিং গল্পের মধ্যে পুষ্পিতা পপিকে ঢোকাতে গিয়ে একটা বেহুদা ফ্ল্যাশব্যাক তৈরি করেছে কি না।
যত্সামান্য ভুলভ্রান্তি বাদ দিয়ে নতুন ধরনের একটা গল্পের টেস্ট নিয়ে মজা করেই পাংকু জামাই ছবিটা দেখছিলাম। নতুনত্ব দেখিয়ে একটু মোচড় দিয়ে আবার তা-ই হয়েছে। ভালোও লেগেছে কিন্তু বিয়ের আসরে কাবিলা ঢুকে যখন বললেন, শাকিব খুনি এবং পুলিশ আনতে চলে গেলেন, তখন শাকিব পিস্তল ধরে অপুকে বাসরঘরে নিয়ে গিয়ে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করার জন্য গল্পের শেষের দিকে যে ফ্ল্যাশব্যাক গল্পটা ফাঁদলেন, তাতেই ছবিটা ফাঁদে পড়ে গেল। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পাংকু জামাই গল্পের সঙ্গে এই ফ্ল্যাশব্যাকটা কিছুতেই মিলল না। তাড়াহুড়া করে ঘটনা বোঝানোর জন্য ‘ধর তক্তা মার পেরেক’জাতীয় একটা ফ্ল্যাশব্যাক দাঁড় করিয়ে দেওয়া হলো।
গল্পটা শুরু হয়েছিল অপুর বাবা ঠিকাদার ববিকে দিয়ে। তাঁর কথার কিউতে যথারীতি অপুর ইন্ট্রোডাকশন। অপু তাঁর গাড়ির ড্রাইভারকে আইসক্রিম কিনতে পথে নামিয়ে দিয়ে নিজেই ড্রাইভ করে গরিব মানুষের সঙ্গে অ্যাকসিডেন্ট করেন। এরপর নায়কের সঙ্গে অ্যাকসিডেন্ট করেন। যথারীতি শাকিবের আগমন। আমরা আমাদের ছবিতে দেখেছি, নায়ক দৌড়ে এসে ধরে গরিবের পক্ষে কথা বলে নায়িকাকে শায়েস্তা করে, জেদাজেদি প্রেমের গল্প শুরু হয়। এখানে তা নয়, নায়ক নায়িকাকে ধরে তার ক্ষতি করার জন্য তিন শ টাকা না পেয়ে নায়িকার হাতের আংটি খুলে নেয়। আর সেই আংটি স্যাকরার দোকানে বেচতে গিয়ে যখন শোনে আংটির দাম ১৫ লাখ টাকা, তখন তার আক্কেলগুড়ুম হয়ে যায়। দৈনিক মজুরি খাটা নায়ক বেচারা মহা চিন্তিত হয়ে পড়ে এই ১৫ লাখ টাকার আংটি নিয়ে। নায়িকাকে স্বপ্নে দেখে গানও করে, ‘আলতা দুধে কে মেশালো সোনার বরন/ কে বানাল আপনমনে এমন গড়ন।’ নায়ক চমকিত হয়ে ঘুম ভেঙে আংটিটা নায়িকাকে ফেরত দিতে চায় কিন্তু নায়িকার সাফ কথা, তালুকদারবাড়ির মেয়ে যা দেয়, তা কখনো ফিরিয়ে নেয় না এবং শেষে বলে, ‘যদি তুমি পারো সবাইকে ফাঁকি দিয়ে রাতে আমার ঘরে গিয়ে আমার হাতে আংটি পরিয়ে আসতে...।’ আমি একটু নড়েচড়ে বসলাম। এবার নায়ক সবাইকে ফাঁকি দিয়ে পাইপ বেয়ে নায়িকার বেডরুমে হাতে আংটি পরিয়ে আসবে। হিরোর মতো মন জয় করে নেবে। কিন্তু আমার তথাকথিত চিন্তাকে মিথ্যা প্রমাণ করে দিয়ে এক নতুন বেশে নায়ক ইন করল হেকিমি দাওয়া নিয়ে। বেশ মজা লাগল। দাদা, দাদি ও নায়িকাকে হেকিমি দাওয়ার নামে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে নৃত্য করিয়ে অচেতন করে নায়িকার হাতে আংটি পরিয়ে দেয় হিরো। ঘুম ভেঙে তাই দেখে নায়িকা আরও রেগে নায়ককে বলে, ঘুমের মধ্যে নেশা করিয়ে হাতে আংটি পরানোর মধ্যে কোনো বাহাদুরি নেই। ওটা কাপুরুষের কাজ। আংটি ছুড়ে দিয়ে যায়। খুব জমে গিয়েছিল গল্প। অপেক্ষা করছি, এবার নায়ক কীভাবে নায়িকার মন জয় করবে। আগে থেকে কিছু ধারণা করছি না। কারণ, নতুনত্ব পাব। কিন্তু এবার নতুনত্বের নামে যে ফ্ল্যাশব্যাক গল্প এল, তার কোনো কারণ বোধগম্য হলো না। এত সুন্দর একটা গল্প ছেড়ে এ কী রকম সারপ্রাইজ? শেষ ভালো যার সব ভালো, এই শেষটাই খুব অগোছালো হয়ে গেল।
গল্পের সঙ্গে পাংকু জামাই নামটাও সামঞ্জস্যহীন। একটা চমক নাম দিলেই হবে না, তা গল্পের সঙ্গে মেলাতে হবে। এই গল্পে পাংকু জামাইয়ের কিছুই নেই। পরিশ্রমী মা, ভাইবোন ও মানুষের জন্য দরদি, অন্যায়ের বিরোধী টগবগে তরুণের আচরণে নায়ক আবির্ভূত। নায়িকার মন জয় করতে যখন শ্বশুর নায়ককে স্মার্ট সেজে আসতে বলে, তখন পাংকু সেজে আসে এবং যখন বিয়ে হয়, তখন গল্প ফ্ল্যাশব্যাক।
পরিচালক আবদুল মান্নান ছবির শেষের আগপর্যন্ত খুব ভালো বানিয়েছিলেন। হলের দিকে তাকিয়ে খারাপ লাগছিল, এত সুন্দর হাস্যরসে টইটম্বুর একটা ছবি দেখতে সোমবার ম্যাটিনি শোতে ডিসিতে মাত্র জনা তিরিশেক লোক, ঠিক তখনই আমার খারাপ লাগাটাকে হাস্যকর প্রমাণ করে দিয়ে এল ফ্ল্যাশব্যাক। গোলাগুলি, নির্বাচন, খুনোখুনি, পুলিশের ধাওয়া এবং পরে ফুড়ুৎ করে এত বড় একটা সমস্যার সহজ দ্রুত সমাপ্তি পুরো গল্পটার অবয়বকে দ্বিখণ্ডিত করে দিল। অথচ মজা করে টান টান উত্তেজনা রেখে ছবিটা দর্শককে আপ্লুত করে শেষ করা যেত।
অভিনয়ে দারুণ শাকিব খান। তোতলা একটা চরিত্র করে যেভাবে সংলাপ ডেলিভারি করেছেন, তা একমাত্র জাত অভিনেতারাই পারেন। সুদর্শন জাত অভিনেতা শাকিব খান যে বাংলাদেশ চলচ্চিত্রের প্রাণপুরুষ, সেটা বুঝিয়ে দিয়েছেন। সঙ্গে আছেন শক্তিমান অভিনেতা মিশা সওদাগরের দারুণ অভিনয়। এই দুজনই যে বাণিজ্যিক ছবির খুব প্রয়োজনীয় ফ্যাক্টর, তা প্রমাণিত। ছবির শেষে মিশার ভিলেন থেকে ভালোতে রূপান্তর নতুনত্বের দাবি রাখে। অপু, এ টি এম শামসুজ্জামান, সাদেক বাচ্চু, ববি, দুলারি, জ্যাকি, রেবেকা, কাবিলা, খালেদা আক্তার কল্পনা, ডি এস চুন্নু, শিবা শানু, দুলাল সরকার, অলকা সরকারসহ আর সবাই চরিত্রানুযায়ী।
পাংকু জামাই সম্পর্কে যে কথাটা একেবারে না বললেই নয় তা হচ্ছে এই ছবির নামকরণ। আগে আমরা যখন ছবি বানাতাম, সেন্সর বোর্ডে ফরম পূরণ করার সময় আমাদের লিখতে হতো ‘টার্গেট অব অডিয়েন্স’ কারা। আপনি আপনার ছবিটা কোন দর্শকদের জন্য বানিয়েছেন। এখন এটা আছে কি না, জানি না বা থাকলেও সেটা এখনকার অনেক পরিচালক-প্রযোজক ঠিকমতো দেখেন বলে মনে হয় না। শাকিবের ছবি মানে পরিবারের ছবি। সেখানে পাংকু জামাই নামটা কি পরিবারকে আকর্ষণ করবে বা আপনি পরিচালক বা প্রযোজক বুক ফুলিয়ে সমাজে আপনার মেয়ে, ভাইবোন, মাকে বলতে পারবেন, আমি একটা ছবি বানিয়েছি। তার নাম পাংকু জামাই? ব্যস, এই একটা সদুত্তর যদি আপনি আপনাকে দিতে পারেন, তবে ছবি না চলার দুঃখ জীবনেও থাকবে না। এই কথাটা এ জন্য বললাম, আমিও আমার বউকে বলে যেতে পারিনি আমি পাংকু জামাই দেখতে যাচ্ছি। লজ্জা এসে আমার আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছিল।
এখন ছবি রিলিজও একটা ব্যাপার। প্রচুর টাকা লগ্নি করে পাংকু জামাইর মতো বিগ কাস্টিং ছবিকে যদি এক রাজমণি হলে রিলিজ করতে হয়, তবে প্রযোজকের টাকা ঘরে তোলা হবে কী করে, সেটাও একটা প্রশ্ন।
লেখক: চলচ্চিত্র পরিচালক