অভিনেতা থেকে যেভাবে নির্মাতা হলেন মাজিদ মাজিদি
ইরানের চলচ্চিত্র ইতিহাসে ১৯৯৯ সালটা গুরুত্বপূর্ণ। সে বছর দেশটির সিনেমা অস্কারে মনোনয়ন পায়। তার আগে সিনেমাটি নিয়ে তুমুল আলোচনা হয়। সিঙ্গাপুর চলচ্চিত্র উৎসব থেকে এশিয়ান ফিচার ফিল্ম শাখায় পুরস্কার জয় করে। মস্কো থেকে পায় পুরস্কার। সেই সিনেমার নাম ‘চিলড্রেন অব হেভেন’। সিনেমাটি দিয়ে বিশ্বজুড়ে নতুন করে আলোচনায় আসে ইরানি নয়া বাস্তবতার গল্প। এসব সিনেমা দিয়ে ইরানের সমাজকে যিনি ভিন্নভাবে দর্শকদের কাছে তুলে ধরেছেন, সেই পরিচালক মাজিদ মাজিদির আজ জন্মদিন। ১৯৫৯ সালে তাঁর জন্ম।
ইরান ছাড়িয়ে সারা বিশ্বের সিনেমাপ্রেমীদের কাছে পরিচিত নাম পরিচালক মাজিদ মাজিদি। যাঁর মিডিয়া অঙ্গনে পথচলা শুরু হয়েছিল অভিনয় দিয়ে। তেহরানের মধ্যবিত্ত সমাজে বেড়ে ওঠা মাজিদি স্কুলে পড়াশোনা অবস্থাতেই অভিনয়ের প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠেন। মাত্র ১৪ বছর বয়সে তিনি মঞ্চে অভিনয় শুরু করেন। পেশা হিসেবে অভিনয় কেমন, তা যাচাই করতে চেয়েছিলেন। পরে তিনি ইনস্টিটিউট অব ড্রামাটিক আর্টস ইন তেহরানে ভর্তি হন। কৈশোরে অভিনয়ের প্রেমে পড়লেও অভিনেতা তাঁর হওয়া হয় না।
ইরান সে সময় নানা রকম সামাজিক জটিলতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল। মাথা চড়া দিয়ে উঠেছিল সামাজিক আন্দোলন। ১৯৭৯ সালের দিকে ইরানের বিপ্লবের পর তিনি সিনেমায় নিয়মিত অভিনয় শুরু করেন। এসব সিনেমা বেশির ভাগই ছিল বিখ্যাত পরিচালক মোহসেন মাখমালবাফ পরিচালিত। ‘বয়কট’ সিনেমায় হতাশায় থাকা একজন কমিউনিস্টের চরিত্রে অভিনয় করে তত দিন কিছুটা পরিচিত পেতে শুরু করেন মাজিদি। কিন্তু অভিনয়ের প্রতি ঝোঁক কমতে শুরু করে তাঁর।
পরবর্তী সময়ে তিনি লেখালেখিতে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। সেই সময়ে ইরানে স্বাধীন মতামত প্রকাশের সুযোগ তেমন ছিল না। সরকারবিরোধী কোনো কিছু লিখলে বা সরকারের সমালোচনা করলেই জেলে যাওয়ার মতো ঘটনা ঘটত। এই ঘটনাগুলো তাঁকে আহত করে। ইরানি সমাজবাস্তবতার গল্পগুলো তিনি নিজেই বলতে চান। এ জন্য চিত্রনাট্যকার ও পরিচালক হিসেবে স্বল্পদৈর্ঘ্য সিনেমা দিয়ে আত্মপ্রকাশ করেন। সর্বশেষ তিনি ১৯৯৩ সালে ‘দ্য লাস্ট ভিলেজ’ সিনেমায় অভিনয় করেন। এরপর শুরু হয় পরিচালনার পালা।
মাজিদি প্রথম চলচ্চিত্র ‘বাদুক’ বানান ইরানি সমাজের দরিদ্রতা ও এর সঙ্গে একটি শিশুর জীবিকা নির্বাহ করার গল্পকে উপজীব্য করে। যা ছিল সমাজব্যবস্থাকে কটাক্ষ করে নির্মাণ করা। এর মাধ্যমে তিনি প্রশ্ন তুলেছিলেন শিশুদের ভবিষ্যৎ নিয়ে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সেভাবে সাড়া না ফেললেও ইরানের দর্শক নিজেদের খুঁজে পান এই সিনেমায়। পরবর্তী সময়ে তিনি দ্বিতীয় সিনেমা ‘দ্য ফাদার’ বানিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পরিচিতি পেতে শুরু করেন। সিনেমাটি সাও পাওলো, সান সাবস্টিয়ান, ফজরসহ বেশ কিছু চলচ্চিত্র উৎসব থেকে প্রশংসা ও সেরা সিনেমার পুরস্কার পায়।
‘দ্য ফাদার’ সিনেমায়ও উঠে এসেছে ইরানি সমাজের আড়ালে থাকা গল্প। এটি মূলত পিতৃহীন ১৪ বছরের কিশোর মেহেরুল্লাহর কাহিনি। বাবার মৃত্যুর পর তাকেই পরিবারের দায়িত্ব নিতে হয়। অন্যদিকে গ্রামে কোনো কাজ নেই। বাধ্য হয়েই তাকে কাজ খুঁজতে বাড়ি থেকে বের হতে হয়। ইরানের দক্ষিণে সে কাজ খুঁজতে যায়। কাজ থেকে মায়ের কাছে ফেরার পর সে অদ্ভুত এক ঘটনার মুখোমুখি হয় বাড়িতে।
এরপর সিনেমাপ্রেমীরা মাজিদ মাজিদিকে নতুন করে আবিষ্কার করেন। তাঁর হাত ধরে চলচ্চিত্র অঙ্গন সমৃদ্ধ হতে থাকে।
তিনি এবার নির্মাণ করেন ‘চিলড্রেন অব হেভেন’-এর মতো সিনেমা। বাস্তবতা কতটা কঠিন হতে পারে, সেই গল্প মন ছুঁয়ে যায় দর্শকদের। দরিদ্র একটি পরিবারের আলী ও জাহারা নামে দুই ভাই–বোনের মানবিক সংকট এতে উঠে এসেছে। এক জোড়া জুতা নিয়ে দুই ভাই–বোনকে স্কুলে যেতে হয়। আলীর ক্লাস শেষ হলে দৌড়ে সে চলে আসে বোনকে তার পায়ের জুতা দিতে। সেই জুতাও অনেকটাই ছেঁড়া। সময়মতো বোনকে জুতা পৌঁছে দিতে নানান ঝক্কি পোহাতে হয় ভাইকে। একদিন সেই জুতা হারিয়ে যায়। হারানো জুতার খোঁজে দুই ভাই-বোনের ‘অভিযান’ দেখতে দেখতে দর্শকদের ভালোবাসায় আপন হয়ে ওঠে খুদে দুই শিশুশিল্পী। অস্কারে মনোনয়ন পায় সিনেমাটি। আরও বেশি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ছড়িয়ে পড়ে ইরানি এই পরিচালকের নাম। আর পেছনে তাকাতে হয়নি মাজিদ মাজিদিকে। তাঁর নামের আগে ‘ইরানি সিনেমার সুলতান’-এর মতো উপাধি যোগ হয়।
মাজিদ মাজিদি সাধারণ মানুষের মনোজগৎ বুঝতে পারতেন। যে কারণে তাঁর সিনেমায় একের পর এক ধরা দিতে থাকে সাধারণ জীবনের গভীর অনুভূতি। ইরানের মানুষের দৈনন্দিন জীবন। পিছিয়ে থাকা সংগ্রামী মানুষের জীবন। ফ্রেমে ফ্রেমে উঠে আসে বাস্তবতার লুকিয়ে থাকা গল্পগুলো, যা খালি চোখে দেখা যায় না। এসব দেখার জন্য শৈল্পিক মন থাকা জরুরি। একই কারণে ইরানের সিংহভাগ দর্শক সেই গল্পের সঙ্গে নিজেদের মেলাতে পারতেন। সিনেমাগুলো হয়ে উঠত সর্বজনীন।
কেন তিনি নিম্ন ও মধ্যবিত্তদের কেন্দ্রে রেখে সিনেমা নির্মাণ করেন, এমন প্রশ্নে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘সমাজে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত মানুষদের কথা বলার শক্তি কম। তারাও কথা বলে না। তাদের হয়েও কথা বলার মানুষের সংখ্যা কম। যে কারণে আমি তাদের দুঃখ–দুর্দশার গল্পগুলো সামনে নিয়ে আসি, এমনকি তাদের সুখের ঘটনাগুলোও আমি পর্দায় আনতে ভুলি না। এই শ্রেণির মানুষের সঙ্গে মিশতে, তাদের কথা শুনতে আমার ভালো লাগে। যেগুলো আমাকে উৎসাহিত করে পর্দায় তুলে ধরতে।’
পরবর্তী সময়ে ‘বারান’, ‘দ্য সং অব স্প্যারোস’, ‘দ্য উইলো ট্রি’, ‘মোহাম্মদ: দ্য মেসেঞ্জার অব গড’ সিনেমাগুলো দিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সমাদৃত হন। এই গল্পের মধ্য দিয়ে সমালোচনাকারীরা খুঁজে পেতেন রাজনৈতিক নানা প্রতিবন্ধকতার মধ্য দিয়ে গল্প বলার ছক। সেগুলো নিয়ে হয়তো ইরানে কথা বলা যেত না। কিন্তু কীভাবে সহজে গল্প বলা যায়, সেই পথে হেঁটেছেন এই পরিচালক। যে কারণে সিনেমাগুলো গভীর দৃষ্টিতে হয়ে উঠতে থাকে রাজনৈতিক, যা ইরানের সরকারব্যবস্থাকে ধাক্কা দেয়। সূক্ষ্মভাবে এসব গল্প দেখাতে তিনি মূল আলোকপাত করতেন শিশুদের ওপর।
মাজিদির পছন্দের পরিচালক ছিলেন সত্যজিৎ রায়। এই নির্মাতার ‘দ্য অপু ট্রিলজি’র কথা তিনি বহুবার বলেছেন। ‘চারুলতা’ তাঁর তরুণ মনে দাগ কেটেছিল, সেই কথাও বলেছিলেন। সমাজবাস্তবতার এই গল্পগুলো কি সত্যজিৎ রায়ের কাছ থেকে অনুপ্রাণিত? ভারতীয় গণমাধ্যম টেলিগ্রাফ ইন্ডিয়ার এমন প্রশ্নের উত্তরে মাজিদ মাজিদি বলেন, ‘সত্যজিৎ রায়ের সিনেমাগুলো সামাজিক নানা ইস্যু নিয়েই, যা বাস্তবে নিমজ্জিত। সিনেমা দেখার পর তাঁর চরিত্রগুলো স্মরণীয় হয়ে থাকে। যদি “পথের পাঁচালী”র কথা বলি, এটা আরও শত বছর মানুষ দেখবে। এমনকি শত বছর ধরেই সিনেমাটি নিয়ে আলোচনা হবে।’