আন্দোলনটা ছিল নিছকই বাসভাড়া বাড়ানোর বিরুদ্ধে, দাবি ছিল ‘স্টুডেন্ট পাস’ দিতে হবে, যাতে কম ভাড়ায় যাতায়াত করা যায়। সময়টা ১৯৭৬ সালের শুরুতে। জায়গাটা হচ্ছে আর্জেন্টিনার লা প্লাতা শহর। বুয়েনস এইরেস প্রভিন্সের রাজধানী লা প্লাতা।সরকার বাসভাড়া বাড়ালে এর প্রতিবাদ করে ইউনিয়ন অব হাই স্কুল স্টুডেন্টস, স্থানীয় ভাষায় সংক্ষেপে বলা হতো ইউইএস। আন্দোলনটি শিক্ষার্থীদের মধ্যে জনপ্রিয় হয়। রাস্তায় নামে তারা। পুলিশের মার খায়। শেষ পর্যন্ত দাবি মেনে নিতে বাধ্য হয় সরকার।
১৯৭৬ সালের আর্জেন্টিনাকে এখন জানা দরকার। দেশটিতে বরাবরই ছিল সামরিক শাসনের প্রাধান্য। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের কিছু সময় বেসামরিক সরকার থাকলেও, তারা ছিল দুর্বল। ফলে ঘুরেফিরে বারবারই সামরিক শাসকেরা ক্ষমতা দখল করেন। সামরিক শাসকদের মধ্যে কর্নেল জুয়ান পেরন ক্ষমতাচ্যুত হয়ে অনেক বছর নির্বাসিত থাকার পরে ১৯৭৩ সালে দেশে ফিরে আসেন এবং রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচিত হন। এক বছর পরেই তিনি মারা গেলে তাঁর তৃতীয় স্ত্রী মার্টিনেজ দে পেরন নতুন রাষ্ট্রপতি হন। তাঁর সময়টি ভালো যায়নি। এই সুযোগে ১৯৭৬ সালের ২৪ মার্চ লেফটেন্যান্ট জেনারেল জর্জ রাফায়েল ভাইদেলারের নেতৃত্বে সামরিক সরকার ক্ষমতা দখল করে।
ক্ষমতা দখল করেই সামরিক সরকার ন্যাশনাল রি-অর্গানাইজেশন প্রসেস বা জাতীয় পুনর্গঠনপ্রক্রিয়া নামে একটি কর্মসূচি শুরু করে। এটি ছিল মূলত বামপন্থী গেরিলাসহ সরকারবিরোধীদের নিশ্চিহ্ন করার একটি কর্মসূচি। সন্দেহ হলেই যখন-তখন তুলে নেওয়া, অপহরণ, আটক, নির্যাতন, ধর্ষণ, খুন বা অদৃশ্য হওয়া ছিল নিত্যদিনের ঘটনা। এ ঘটনাকে বলা হয় ডার্টি ওয়ার বা নোংরা যুদ্ধ। ফকল্যান্ড যুদ্ধে হেরে যাওয়ার পরে ১৯৮৩ সালে সামরিক সরকারে পতন ঘটলে বের হতে থাকে নোংরা যুদ্ধের নানা তথ্য। সেই নোংরা যুদ্ধের সময় প্রায় ৩০ হাজার আর্জেন্টিনাবাসী গুম, নির্যাতন আর নিহত হয়েছিলেন। বলা হয়, ওই সময়ে হত্যার শিকার হয়েছিল এমন ২৫০ জন, যাদের বয়স ছিল ১৮ বছরের নিচে। এমনকি একজন ১৩ বছরেরও ছিল।
এবার সেই ছাত্র আন্দোলনের ঘটনায় ফিরে যাই। এসব শিক্ষার্থীর বয়স ছিল ১৬ থেকে ১৮ বছরের মধ্যে। একদল আদর্শবাদী ছেলেমেয়ে ওরা। তবে ধারণাও ছিল না, সামান্য এক বাসভাড়া কমানোর আন্দোলন করতে গিয়ে কী ভয়াবহ পরিণতি অপেক্ষা করে আছে। সামরিক সরকার ক্ষমতা নেয় ১৯৭৬ সালের মার্চে। আরও অনেকের মতো এর প্রতিবাদ করে শিক্ষার্থীরাও। স্কুলে কঠোর নিয়ম জারি করে কর্তৃপক্ষ। এরও প্রতিবাদ করে শিক্ষার্থীরা। আবার সামরিক সরকার ঘোষণা দেয়, বামপন্থীদের কোনো ধরনের আন্দোলন সহ্য করা হবে না। এরপর শুরু হয় বামপন্থীদের খুঁজে খুঁজে বের করা। এরই মধ্যে ১৯৭৬ সালের ৮ থেকে ২১ সেপ্টেম্বরের মধ্যে আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া ১০ জন শিক্ষার্থীকে মুখোশ পরা একদল লোক বিভিন্ন স্থান থেকে তুলে নেন। তাঁরা সবাই ছিলেন পুলিশ ও সামরিক বাহিনীর সদস্য।
অপহরণের পরে শিক্ষার্থীদের জায়গা হয় গোপন সেলে, জায়গাটার নাম আরানা। এরপরে ভয়াবহ অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হয় তাদের। ইলেকট্রিক শক, নানাভাবে নির্যাতন, অভুক্ত রাখা, ধর্ষণ—সবকিছুরই মুখোমুখি হয় তারা।
অপহৃত হওয়া ১০ জন ছিল ১৬ বছরের মারিয়া ক্লডিয়া ফ্যালকন, মারিয়া ক্লারা (১৮), প্যাট্রিশিয়া মিরান্ডা (১৭), এমিলি মোলার (১৭), ক্লডিও ডি আচা (১৭), গুস্তাভো কালোত্তি (১৮), পাবলো দিয়াজ (১৮), ফ্রান্সিসকো লোপেজ মুনটানের (১৬), ড্যানিয়েল এ রোচেরো (১৮) ও হোরাসিও উনগারো (১৭)।
অপহরণের পরে শিক্ষার্থীদের জায়গা হয় গোপন সেলে, জায়গাটার নাম আরানা। এরপরে ভয়াবহ অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হয় তাদের। ইলেকট্রিক শক, নানাভাবে নির্যাতন, অভুক্ত রাখা, ধর্ষণ—সবকিছুরই মুখোমুখি হয় তারা। একদিকে গোপন সেলে সীমাহীন অত্যাচার, অন্যদিকে তাদের মা–বাবার ক্ষমতাসীনদের দরজায় দরজায় ধরনা দেওয়া। কিন্তু কোনো লাভই হয়নি। ১৯৮৩ সালে সামরিক সরকার বিদায় নেওয়ার পরে জানা যায় এসব ঘটনার বীভৎস বিবরণ।
সামরিক শাসকের বিদায়ের পর ছাড়া পায় পাবলো দিয়াজসহ এই দলের চারজন। অনেক পরে জানা যায়, ১৯৭৭ সালের জানুয়ারিতে বাকিদের ফায়ারিং স্কোয়াডে মেরে ফেলা হয়েছিল। তবে সহজে রেহাই পাননি এই গুম-খুনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। সামরিক সরকারের পতনের পর বিচার শুরু হয় হোতাদের। দীর্ঘ বিচারপ্রক্রিয়ার পরে অনেকরই সাজা হয়। বেশির ভাগেরই যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়, যদিও প্রায় সবারই তখন বয়স ছিল আশির বেশি। বিচার চলাকালে সাক্ষ্য দিতে পাবলো দিয়াজ আদালতে হাজির হয়েছিলেন ১৯৮৫ সালে। সেখানে পাবলো দুঃসহ সেই দিনগুলোর বর্ণনা দিলে সারা বিশ্ব বিস্তারিত জানতে পারে। পাবলো দিয়াজ অবশ্য বলতে পারেননি কেন তাঁকে হত্যা না করে বিনা বিচারে আটকে রাখা হয়েছিল, আর কেনই–বা বাকি ছয় বন্ধুকে মেরে ফেলা হয়।
আমি এমন কিছু করিনি, যাতে আমাকে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে। আর ওরাও এমন কিছু করেনি, যে কারণে ওদের মেরে ফেলা হলো।
সাক্ষ্য দিয়েছিলেন বেঁচে ফিরে আসা এমিলি মোলার। তিনি বলেছিলেন, ‘আমি এমন কিছু করিনি, যাতে আমাকে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে। আর ওরাও এমন কিছু করেনি, যে কারণে ওদের মেরে ফেলা হলো।’ আসলে আর্জেন্টিনাসহ বিশ্ববাসী আজও জানে না, ওই ১০ শিক্ষার্থীর কী দোষ ছিল।
এই যে ১০ শিক্ষার্থী অপহরণ ও গুম, পরবর্তী সময়ে এরই নামকরণ করা হয় ‘নাইট অব দ্য পেনসিলস’। এ নিয়ে পরে অনেক লেখালেখি হয়েছে, গান গাওয়া হয়েছে, হয়েছে সিনেমাও। এখনো প্রতিবছরের ১৬ সেপ্টেম্বর আর্জেন্টিনায় দিবসটি পালন করা হয়।
এবার সিনেমা প্রসঙ্গে আসি। সিনেমাটির নামও ‘নাইট অব দ্য পেনসিলস’। সিনেমার শুরুও বাসভাড়ার বিরুদ্ধে সেই আন্দোলন নিয়ে। তারপর আসে সফলতা। নতুন বাস কার্ড নিয়ে বন্ধুদের আলাদা আলাদা ছবি তোলা, বিজয়োৎসব, আড্ডা, খাওয়াদাওয়া—সবই আছে সিনেমাটিতে। তারপরই বদলে যেতে থাকে অনেক কিছু। ক্ষমতা নেয় সামরিক সরকার। মারিয়া ক্লডিয়ার বাবা ছিলেন পেরনের সময়কার সিটি মেয়র।
অপহরণের রাতে মারিয়া ক্লারা ছিল মারিয়া ক্লডিয়ার বাসাতেই। ১০ জনের মধ্যে গুস্তাভো কালোত্তিকে নিয়ে যাওয়া হয় ৮ সেপ্টেম্বর আর পাবলো দিয়াজ গুম হয় সবার শেষে, ২১ সেপ্টেম্বর। বাকি আটজনকে তুলে নেওয়া হয় ১৬ ও ১৭ সেপ্টেম্বর।
ভাগ্যবান ছিল পাবলো দিয়াজ, গুস্তাভো কালোত্তি, এমিলি মোলার ও প্যাট্রিসিয়া। তারা ফেরত এসেছিল। বাকি ছয়জনকে আর কখনোই খুঁজে পাওয়া যায়নি। মূলত পাবলো দিয়াজের দৃষ্টিকোণ থেকে গল্পটা বলা হয়েছে।
‘নাইট অব দ্য পেনসিলস’-এর পরিচালক হেক্টর অলিভিয়েরা। ১৯৮৬ সালে মুক্তি পাওয়ার পরেই সাড়া পড়েছিল সিনেমাটি নিয়ে।
সিনেমাটি হয়তো এখনো অনেকের কাছে প্রাসঙ্গিক। কারণ, সময় পাল্টালেও সরকারের আচরণ অনেক দেশেই খুব একটা বদলায়নি।