ঢাকায় জাহিদ হাসানের মেসজীবন যেমন ছিল
পড়াশোনা বা চাকরি, কোনো স্বপ্ন বাস্তবায়নে তরুণ বয়সে যাঁরাই ঢাকা শহরে আসেন, তাঁদের অনেকেরই সঙ্গে হোস্টেল ও মেসজীবনের নিবিড় ‘সম্পর্ক’ থাকে। এই হোস্টেল ও মেসজীবন কারও জন্য লড়াই–সংগ্রামের। তেমনই একটা জীবন কাটিয়েছেন দেশের জনপ্রিয় অভিনয়শিল্পী জাহিদ হাসান। সফল এই অভিনয়শিল্পীর একটা সময় কেটেছিল ঢাকার ধানমন্ডির ১৫ নম্বরের একটি মেসে। মা-বাবার আদরের ছেলে জাহিদ হাসানের মেসজীবন কেমন ছিল, তা–ই শুনিয়েছেন তিনি।
মঞ্চ, টিভি ও চলচ্চিত্র অভিনেতা জাহিদ হাসানের ৪ অক্টোবর ছিল জন্মদিন। পরিবারের ছোট ছেলে ছিলেন জাহিদ হাসান, তাই সবারই আলাদা একটা নজর ছিল। তবে ঢাকার মেসজীবনে সেভাবে কোনো আয়োজন ছিল না।
আশির দশকের শেষ দিকে সিরাজগঞ্জ থেকে ঢাকায় আসেন জাহিদ হাসান। ধানমন্ডি ১৫ নম্বরে একটা মেসে ওঠেন। একটা ঘরে থাকতেন চার থেকে পাঁচজন। ওই সময়ের এক জন্মদিন প্রসঙ্গে জাহিদ বলেন, ‘আমি পরিবারের ছোট ছেলে। তাই আলাদা একটা নজর সবারই ছিল। ছোটবেলায় এই দিনে মা পায়েসসহ সুন্দর সব খাবার রান্না করতেন। কেক আনা হতো, চানাচুর, কলা আরও কত কী! ঢাকা শহরে আসার পর শুরু হয় মেস ও হলজীবন। ’৮৯ সালে তেমনই একদিন মেসের ঘর ঝাড়ু দিচ্ছিলাম। তখন আমার মেসের এক সঙ্গীর বাবা বেড়াতে আসেন। তিনি আইনজীবী। আমার জন্মদিন শুনে বলেছিলেন, “মন খারাপ কোরো না পুলক (জাহিদ হাসানের ডাকনাম), এমন একটা দিন আসবে, যেদিন সারা দেশের মানুষ তোমার জন্মদিন পালন করবে।” এখন যখন জন্মদিনে রেডিও, টেলিভিশন, পত্রিকায় আমাকে নিয়ে আলোচনা হয়, তখনই ওই আঙ্কেলের কথা খুব মনে পড়ে।’
মা–বাবার আদরের পুলক ঢাকায় এসে খেতে পারতেন না। মেসজীবনের সেই খাবারের অভিজ্ঞতা বললেন এভাবে, ‘আমরা একটা ঘরে চার-পাঁচজন থাকতাম। বুয়া রান্না করতেন। প্রায় সময়ই খাবার মুখে তোলা যেত না। পরে নিজেরা ভাজিটাজি রান্না করে খেয়ে নিতাম। তবে কষ্টের মধ্যেও একধরনের শান্তি আছে, আবার কষ্টের মধ্যে অশান্তিও আছে। জীবনে কোনো কিছুই সহজে পাওয়া যায় না। তাই কষ্টের পরের সুখটা আসলে অন্য রকম।’
অভিনয়ের স্বপ্ন নিয়ে ঢাকায় এসেছিলেন জাহিদ হাসান। সিরাজগঞ্জেও থিয়েটার করতেন। ঢাকায় থিয়েটারে এসে শুরুতে ঘর মোছার কাজও করতেন। এ রকম করতে করতে একটা সময় নাট্যকেন্দ্র গঠনের কথা বলেন। ঢাকায় কষ্টের জীবন জাহিদ হাসানকে অনেক কিছু শিখিয়েছে। সেই গল্প বললেন, ‘অনেক সময় ছাড় দিতে শিখিয়েছে। শেয়ারিং শিখিয়েছে। মেসজীবনের শুরুতে এমনও দেখেছি যে বাথরুমে সাবান, শ্যাম্পু রেখে আসতাম, পরে আরেকজন এসে বলত, ‘বাথরুমে রেখে এসেছ কেন, আরেকজন তো ব্যবহার করবে।’ আমি বলতাম, ‘করুক। সমস্যা কী? অথচ সাবান পাতলা কাগজের মতো হয়ে যেত। শ্যাম্পু বোতল থাকত না।’
মানুষের জীবন অনেক চড়াই-উতরাইয়ের। জাহিদ হাসানেরও তেমন। এত কিছুর পরও জীবনটাকে কীভাবে দেখেন, এমন প্রশ্নে জাহিদ হাসানের উত্তর, ‘জীবনটা আসলে আয়নার মতো। আয়নায় আমি ভেঙচি কাটলে আয়নাও ভেঙচি কাটবে। হাসলে আয়নাও হাসবে। আবার অনেক সময়, আসলে জীবনটা কাঁঠালের মতো, কোনো কিছুই ফেলনা নয়। এই জীবনে দুঃখ, কষ্ট, ভালোবাসা, শ্রদ্ধা, অবহেলা, তাচ্ছিল্য—সবই পেয়েছি। সবাই পায়, কমবেশি। সঠিকভাবে সামলে নিতে পারলেই হয়। কম্প্রোমাইজ করা, শেয়ার করা, ক্ষমা করে দেওয়া, মানুষের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করা—এসবই শিখেছি। এটাই করে যাওয়ার চেষ্টা করছি। তবে হতাশও হয়েছি। আবার কাটিয়ে উঠেছি। তাচ্ছিল্য যেমন অনেক পেয়েছি, লড়াইও করেছি। এই তাচ্ছিল্য বা অবহেলার সময় কেউ না কেউ সঙ্গী হয়ে আসে। হয় মানুষ, না হয় বই কিংবা একটা গান। ’৮৮ সালের বন্যার সময় টিএসসি থেকে হেঁটে হেঁটে রামপুরায় যাই। কারণ, পকেটে টাকাপয়সা নেই। পানি মাড়িয়ে ওখানে যাই। বলা যায়, আমার দীনহীন অবস্থা। ৯০-৯১ সালে মানসিকভাবেও জর্জরিত অবস্থা। এরপর কোথায় যেন কী পড়লাম, তারপর আর হতাশ হইনি।’
(প্রথম আলোতে দেওয়া জাহিদ হাসানের সাক্ষাৎকার থেকে সংকলিত)