‘কিছু নির্বোধের হঠকারিতায় এই আন্দোলন যেন বিফলে না যায়’

ইমতিয়াজ বর্ষণ
ছবি : প্রথম আলো
ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে প্রধানমন্ত্রীর পদে ইস্তফা দিয়ে দেশ ছেড়েছেন শেখ হাসিনা। গত সোমবার হাসিনার পতনের পর দেশজুড়ে বিজয়োল্লাসে মেতেছেন নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ। এর মধ্যে সরকারি স্থাপনা ভাঙচুর, আওয়ামী লীগের দলীয় কার্যালয়ে অগ্নিসংযোগ ও সাম্প্রদায়িক হামলার খবরে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন শিল্পীরা। তাঁদের মধ্যে একজন অভিনেতা ইমতিয়াজ বর্ষণ। তাঁর বক্তব্য তুলে ধরা হলো।

শিক্ষার্থীদের দাবির সঙ্গে সংহতি জানিয়ে পাশে ছিলাম। কারণ, তাঁদের পাশে থাকাটা নৈতিক দায়িত্ব মনে হয়েছে আমার। এই ছোট ছোট শিক্ষার্থীর দাবিকে নানাভাবে অবহেলা করা হচ্ছিল, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা হচ্ছিল। এমনকি শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে ছাত্রকে দাঁড় করিয়ে দিয়ে, সন্ত্রাসী লেলিয়ে দিয়ে সংঘাতের দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। যেদিন নিরস্ত্র আবু সাঈদকে একদম সবার সামনে দিনে দুপুরে প্রকাশ্যে গুলি করে মেরে ফেলা হলো, সেটা দেখে আর ঘরে বসে থাকতে পারছিলাম না। সেদিনই সারা দেশে পাঁচজনের নিহতের খবর প্রকাশ পায়। উল্টো ইন্টারনেট বন্ধ করে দিয়ে দেশবাসীকে অন্ধকারে ঠেলে দিল সরকার। এই হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে প্রতিবাদস্বরূপ গত ১৯ জুলাই বেলা ১১টায় সংসদ ভবনের সামনে প্রায় শতাধিক নাট্যাভিনেতা, পরিচালক, থিয়েটারকর্মীসহ আমরা অবস্থান নিই।

ইমতিয়াজ বর্ষণ। ছবি: ফেসবুক

ইন্টারনেট বন্ধ রেখে, কারফিউ দিয়ে, প্রতিদিন পুলিশ দিয়ে শত শত ছাত্র, শিশু, সাধারণ মানুষকে খুন করেছে সরকার। বিশ্ববাসীর কাছে প্রচার করেছে অন্য গল্প সরকারের মন্ত্রীরা। থামছে না, উল্টো মানুষের মৃত্যু যেন তাদের কাছে সংখ্যা ছাড়া আর কিছু নয়। শত শত মানুষ মেরে হলেও ছাত্রদের দাবিয়ে দেবে। জীবনের কোনো মূল্য নেই। রাতের অন্ধকারে পাকিস্তানি হানাদারদের মতো পুলিশ, গোয়েন্দা বিভাগ ছাত্রদের তুলে নিচ্ছে, নির্যাতন করছে। ডিবি অফিসে তুলে নিয়ে গিয়ে চাপ দিয়ে বিবৃতি আদায় করে ভাত খাওয়ানোর দৃষ্টিকটু নাটক টিভিতে প্রচার করে আন্দোলনকে দমিয়ে দেওয়ার অপচেষ্টা করছে। ওরা ভুলে গেয়েছিল এই দেশে ছাত্ররাই ১৯৫২, ১৯৬৯, ১৯৭১-এর নায়ক। এমনকি ১৯৯০-এর গণ-অভ্যুত্থান ছাত্রদের আন্দোলনের ফসল। ১৯৮৭ সালের ১০ নভেম্বর সচিবালয় ঘেরাও কর্মসূচিতে বুকে-পিঠে নূর হোসেন লিখে এনেছিলেন ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক’। আওয়ামী লীগের কর্মী ছিল। সব ইতিহাস যেন ক্ষমতার ভারে ভুলে গেছে।
এই ফাঁকে মেট্রোরেল, বিটিভি, সেতু ভবনসহ নানা জায়গায় হামলা হলো, সব দোষ দেওয়া হলো ছাত্রদের। অথচ সিসিটিভি ক্যামেরা ফুটেজে যাদের দেখা যাচ্ছে, তাদের কোটা আন্দোলনের ছাত্র মনে হচ্ছিল না। যে সম্পদ আবার গড়া যায়, তার জন্য এত মায়াকান্না তাদেরই থাকে, যাদের কাছে মানুষের প্রাণের কোনো দাম নেই। ১৫ বছর ধরে এমন একটা ভয়ের রাজত্ব কায়েম করেছিল, সেটার অবসান কখনো হবে, ভাবেনি আওয়ামী লীগ সরকার। কারণ, গত ১৫ বছরে হয় ভয় দেখিয়ে, নয়তো জামায়াত-বিএনপি-রাজাকার ট্যাগ লাগিয়ে, মিথ্যা মামলা দিয়ে নানা অপকৌশলে সব বিরোধী মতকে দমিয়ে রাখার এক কৌশল বের করেছিল। যেটা দিয়ে আগামী দিনেও ভোট চুরি করে ক্ষমতাকে চিরকাল ধরে রাখবে বলে বিশ্বাস করত। তাদের সেই সব অপকৌশল এবার ব্যাক ফায়ার করেছে।

শিক্ষার্থীদের পাশে একাত্মা প্রকাশ করতে এসেছিলেন বর্ষণ সহ অন্যরা। ছবি: ফেসবুক

মানুষ প্রতিবাদ করতে ভুলে গিয়েছিল। সবকিছু মেনেই নিয়েছিল, কিন্তু এসব ছাত্র প্রথমবারের মতো সব অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন সব ভয়ডরকে উপেক্ষা করে। তাঁদের ভয় দেখিয়েও দমাতে পারেনি, লোভ দেখিয়েও কিনতে পারেনি। গত ১৫ বছরে অসংখ্য প্রগতিশীল ব্যক্তিদের বিক্রি হতে দেখেছি, কিন্তু এসব ছাত্র এত দমন-নিপীড়নের পরও বিক্রি হননি। স্যালুট তাঁদের এই অনমনীয় দৃঢ় মনোবলকে। আশির দশকে থিয়েটার, কবিতা, ছড়া, গল্প, উপন্যাস, কার্টুন এমনকি রাজনীতিতেও এক নতুন সৃষ্টিশীল অধ্যায়ের সূচনা হয়েছিল স্বৈরাচার এরশাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ অস্ত্র হিসেবে। অথচ ১৫ বছরে এমন ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি হয়েছিল, একটা কার্টুন আঁকতেও পারছিল না কেউ। অন্যদিকে তৈরি করেছে এক নির্লজ্জ পা চাটা তোষামোদকারী গোষ্ঠী।

বিচার বিভাগকে ইচ্ছেমতো ব্যবহার করেছে। অথচ সংস্কৃতিকর্মী এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে আন্দোলনরতদের অন্যতম দাবি ’৭১-এ পাকিস্তানি বাহিনীর দোসর জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধ করা, সেটা তারা করেনি আদালতের দোহাই দিয়ে। আর মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নামে কাউকে কিছু বলতেই দেওয়া হচ্ছিল না। কিছু বললেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরিপন্থী। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কি লুটেরা রাজনীতির পক্ষে? দুর্নীতির পক্ষে? বিদেশে টাকা পাচারের পক্ষে? মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কি বাক্‌স্বাধীনতার বিপক্ষে? মেধা উপেক্ষা করে স্বজনপ্রীতির পক্ষে? আওয়ামী লীগের সব অপকর্মে ক্ষতি হয় জাতির পিতার সম্মান, তারা কি তা বুঝত না!

ইমতিয়াজ বর্ষণ
ছবি: ফেসবুক

অন্যায়কে অন্যায় বলার শক্তি হারিয়ে ফেলেছে যে দেশ, তাদের এই অচলায়তন থেকে বেরোনোর পথ দেখিয়েছেন এসব ছাত্র। এই বিজয় ছাত্রদের আন্দোলনের ফসল। এটা ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থান। পদত্যাগের পর সংসদ ভবন, প্রধানমন্ত্রীর অফিস, গণভবনকে এভাবে অরক্ষিত রেখে লুটপাট করতে দেওয়ার কোনো মানে খুঁজে পেলাম না। আমাদের দেশের ১০০% লোক জাপানিদের মতো সুসভ্য আচরণ করবে, তেমন আশা আমি করি না। আমি গতকাল এই লুটপাট দেখে মর্মাহত। ভাই ৩২ নম্বরের বাড়িটা তো ইতিহাসের সাক্ষী, বঙ্গবন্ধুর এই বাড়ি তো কোনো দোষ করেনি। গণভবন, সংসদ ভবন দেশের সার্বভৌমত্বের প্রতীক। এগুলোয় কত কত ইতিহাস সংরক্ষিত আছে। তার ওপর নানান জায়গায় মন্দিরে হামলা হচ্ছে শুনে কাল রাতে ঘুমাতে পারিনি।

অনেক আশার কথা যে ছাত্র ও সাধারণ জনতা মন্দির রক্ষায় এগিয়ে এসেছেন। ছাত্ররা সংসদ ভবনের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজ করেছেন নিজ হাতে, প্রধান সড়কে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে ট্রাফিক পুলিশের দায়িত্ব পালন করেছেন। এসব দেখে আশ্বস্ত, ভালো লাগছে। এই আন্দোলনে এক নতুন সৃষ্টিশীল প্রজন্মের জন্ম হয়েছে। যারা সত্যি কথা বলে। নতুন নতুন সংগীতশিল্পীর জন্ম হয়েছে, যারা গানে গানে প্রতিবাদ করে উদ্বুদ্ধ করে। কিছু নির্বোধের হঠকারিতায় এই আন্দোলন যেন বিফলে না যায়, সেই প্রত্যাশা রাখি। এই আন্দোলনের সব শহীদের প্রতি জানাই শ্রদ্ধা। বাংলাদেশ আজন্ম আপনাদের এই ত্যাগকে স্মরণ করবে। এই আন্দোলনের নেতৃত্বদানকারী সবাইকে আগামী দিনের নতুন বাংলাদেশ গড়ার জন্য আগাম শুভেচ্ছা। যে বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত চেতনায় এগিয়ে যাবে। দলমত-নির্বিশেষে সত্যিকারের জনগণের দেশ হবে।