কিছু একটা হতেই হবে, এমন তাড়না ছাড়াও জীবনযাপন সম্ভব: আফজাল হোসেন
৭০ বছর বয়সে এসে ‘দ্বিতীয় ইনিংস’ খেলছেন আফজাল হোসেন। কোভিডের পর এই নতুন শুরু। এই সময়ে যতগুলো ‘ম্যাচ’ খেলেছেন, দর্শক তাঁকে নতুন করে আবিষ্কার করেছেন। সম্প্রতি বঙ্গতে মুক্তি পেয়েছে তাঁর অভিনীত সিরিজ ‘মেসমেট’। চরকিতে আসছে ‘ষ’-এর দ্বিতীয় মৌসুম, এ ছাড়া ব্যস্ত চলচ্চিত্র নিয়ে। অভিনেতার ‘দ্বিতীয় ইনিংস’-এর খবর জানতে গত মঙ্গলবার তাঁর ধানমন্ডির কার্যালয়ে গিয়েছিলেন মনজুর কাদের
নির্ধারিত সময়ে পৌঁছে যাই। আগের দিন রাতে ফোনে বলেছিলেন, কী যেন সম্পাদনা করছেন। নতুন কিছু বানিয়েছেন? আফজাল হোসেন বললেন, ‘চুপচাপ বসে থাকতে পারি না। মাথায় কিছু না কিছু চলতেই থাকে। গতকাল রাতে (সোমবার) আমারই লেখা কবিতার ভিডিও চিত্র বানাচ্ছিলাম। কবিতা পড়ায় উৎসাহ কম, সেটা দেখা ও শোনার উপযুক্ত করে সামনে এগিয়ে দিলে অনেকে হয়তো আগ্রহ নিয়ে শুনবেন এবং দেখবেন।’ কবিতা দিয়ে শুরুর পর আলাপে আলাপে চলে আসে নানা প্রসঙ্গ।
আর্ট কলেজ থেকে অভিনয়ে
ছোটবেলা থেকে ছবি আঁকতে ভালোবাসতেন। শিল্পী হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে ১৯৭০ সালে আফজাল হোসেন ঢাকায় আসেন। ভর্তি হন আর্ট কলেজে। ব্যাচেলর অব ফাইন আর্টস ডিগ্রি নেন। তখন মাস্টার্স করার সুযোগ ছিল না। কলেজ থেকে বেরিয়ে ঢাকা থিয়েটারে যোগ দেন। একই বছরে টেলিভিশনে অভিনয় করার সুযোগ করে দেন আবদুল্লাহ আল মামুন। ক্রমে হয়ে ওঠেন জনপ্রিয় টেলিভিশন অভিনেতা, নায়ক। সেই সময়ের আরেক জনপ্রিয় অভিনয়শিল্পী সুবর্ণা মুস্তাফা আর আফজাল হোসেন একের পর আলোচিত নাটকে অভিনয় করে জনপ্রিয় জুটি হিসেবে প্রতিষ্ঠা পান। আগামী বছর অভিনয়ের চতুর্থ দশকে পা দেবেন আফজাল হোসেন।
নানা রকম আফজাল হোসেন
ছাত্রজীবন থেকে বইয়ের প্রচ্ছদ আর রেখাচিত্র আঁকতে শুরু করেন। দুই বিষয়েই লক্ষণীয় বদল আনেন তিনি। টেলিভিশনের জন্য অনেক নাটক রচনা করেছেন। তাঁর লেখা ‘পারলে না রুমকি’ এখনো জনপ্রিয় রোমান্টিক নাটক। টেলিভিশন উপস্থাপক হিসেবেও তাঁর খ্যাতির কথা সবার জানা।
আফজাল হোসেন কবিতা লেখেন, পাঁচটি কবিতাগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। প্রথম কবিতাগ্রন্থ ‘তিন নারীর পাঠশালা’ ২০০৭ সালে প্রকাশিত হয়। চার বছর পর আসে দ্বিতীয় কবিতাগ্রন্থ ‘শুধু একটাই পা’। এই দুটি গ্রন্থের জন্য সিটি আনন্দ আলো সাহিত্য পুরস্কার পান। প্রকাশিত অন্যান্য কবিতাগ্রন্থ ‘কোনো জোনাকি এ অন্ধকার চেনে না’, ‘১৯ নং কবিতা মোকাম’, ‘আমরা ধুলোকাদার আমরা আদর্শলিপির’।
ছাত্রজীবন থেকে কবিতা পড়ার অভ্যাস। আফজাল বললেন, ‘আর্ট কলেজে পড়ার সময় বন্ধুবান্ধব সবাই একত্রিত হলেই আমার কাছ থেকে কবিতা শুনতে চাইত। তার মানে, কবিতার প্রতি একটা আগ্রহ মানুষের আছে। তখন পরিবেশটা এমন ছিল, এক বন্ধু গিটার বাজাচ্ছে, আমরা গোল হয়ে বসে আছি। হঠাৎ আমাকে বলত, “তুই একটা কবিতা পড়”। দেখা গেল, আমি কবিতা পড়ছি, আরেক বন্ধু গিটার বাজাচ্ছে। এভাবেই আমাদের আড্ডা চলত। আমারও আস্তে আস্তে কবিতা পড়ার আগ্রহটা বাড়তে থাকে।’
ওই সময় বেশ কয়েকজন কবির কবিতা এই অভিনয়শিল্পীকে আলোড়িত করত। আফজাল হোসেনের প্রিয় কবির তালিকায় আছেন জীবনানন্দ দাশ, নির্মলেন্দু গুণ, আবুল হাসান, শামসুর রাহমান, সৈয়দ শামসুল হক। এই সময়ে যাঁরা কবিতা লেখেন, তাঁদের সঙ্গে যদিও খুব একটা সংযোগ নেই। তারপরও যাঁদের কবিতা পড়ার সুযোগ হয়, তাঁদের মধ্যে ইরাজ আহমেদ ও আলতাফ শাহনেওয়াজের কবিতা ভালো লাগে। আলাদা লাগে তারিক সুজাতের কবিতা।
বাংলাদেশের বিজ্ঞাপন জগতে যে ব্যাপক পরিবর্তন, সেটার পেছনেও রয়েছে আফজাল হোসেনের অবদান। আফজাল হোসেন এখন নিয়মিত লেখেন, নিয়মিত আঁকেন। বললেন, এই দুটো কাজ অনেক আনন্দের, তাঁর একান্ত নিজের। কোনোটা করতে মন চাইলে যখন-তখন শুরু করে দেওয়া যায়, কাউকেও প্রয়োজন পড়ে না। এটা একটা বড় সুবিধা।
কী নিয়ে লেখালেখি করছেন এখন? জানালেন, বিজ্ঞাপনচিত্র নিয়ে একটা দীর্ঘ লেখা লিখছেন। অনেক দিন ধরে একটা উপন্যাস লেখার চেষ্টা করছেন। কখনো গড়গড় করে লেখা যায়, কখনো যায় না। ‘উপন্যাস ভেবেচিন্তে, হিসাব–নিকাশ করে লিখতে হয়। কবিতা কখনো ভেবেচিন্তে আয়োজন করে লিখতে পেরেছি, মনে পড়ে না। একটা কবিতা লিখব—ভেবে লিখতে বসি না। কবিতা শূন্য থেকে এসে মনের দরজায় কড়া নাড়ে, দরজা খুলে দিই। কবিতা আমার বাধ্য নয়। দেখা যায় চার দিনে ছয়টা কবিতা লিখে ফেলতে পেরেছি, আবার এমনও হয়, পুরো মাসে কোনো কবিতা আসেনি।’ বললেন আফজাল হোসেন।
আরও জানালেন, আগামী বছর নিজের ছবির প্রদর্শনী করার ইচ্ছা আছে তাঁর।
দ্বিতীয় ইনিংস
কোভিডের পর যেন নতুন করে শুরু আফজাল হোসেনের। মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর ‘লেডিস অ্যান্ড জেন্টেলমেন’, অমিতাভ রেজার ‘বোধ’, সৈয়দ আহমেদ শাওকির ‘কারাগার’, নুহাশ হুমায়ূনের ‘পেট কাটা ষ’; টেলিভিশন, চলচ্চিত্রের পর ওটিটিতে তাঁকে নতুনভাবে আবিষ্কার করেন দর্শক। কেমন উপভোগ করছেন এই দ্বিতীয় ইনিংস? আফজাল বললেন, ‘একটা ইনিংস কেটে গেছে চমৎকারভাবে। পরের ইনিংসটা আরেক রকমভাবে কাটুক; যেকোনো অভিনেতার এমনই চাওয়া। ভালো কাটছে। নুহাশ হুমায়ূনের ‘ষ ২’-তে অভিনয় করলাম। সেদিন সে বলল, এটা আগের চেয়েও পছন্দ করার মতো হয়েছে। উত্তেজনায় আছি।’
সম্প্রতি নতুন একটি চলচ্চিত্রের শুটিং শুরু করেছেন। একদল তরুণ সিনেমাটি বানাচ্ছেন। ‘শিল্পজীবি’ নামে ছবিটির পরিচালক মুকিতুল বারী। আফজাল জানালেন, এটা একজন লেখক ও তাঁর লিখতে চাওয়া এবং লিখতে না পারার সংকট ও সংগ্রামের গল্প। এই সংকট ও সংগ্রামের পাশাপাশি আরও একটি গল্প চলতে থাকে। এখানে আফজাল হোসেনের বিপরীতে অভিনয় করেছেন আফসানা মিমি। দুই দশক আগে ‘ভোকাট্টা’ নাটকে তাঁদের প্রথম একসঙ্গে কাজ করা। এরপর কয়েকটি কাজ করলেও চলচ্চিত্রে এবারই প্রথম বলে জানালেন আফজাল হোসেন।
আফজাল অভিনয় করেন বিরতি দিয়ে দিয়ে। এটা কেন? ‘অভিনয় ভালোবাসি, কিন্তু তা আমার পেশা নয়; তাই নিয়মিত করা সম্ভব হয়ে ওঠে না।’ বললেন আফজাল হোসেন। নতুনদের পরিচালনায় কাজ করছেন, মনে দ্বিধা কাজ করে না? তাঁর সোজাসাপটা উত্তর, ‘না’। বললেন ‘এখনকার তরুণেরা মনে ইচ্ছা জেগেছে বা ঝোঁকের ঠেলায় চলচ্চিত্র নির্মাণে নেমে পড়েনি, পড়ে না। এরা অনেক জেনেবুঝে, স্বপ্ন পুষে আসে। বেশ কয়েকজনের সঙ্গে কাজ করে মনে হয়েছে, তরুণ প্রজন্মের জানা–বোঝা নতুন এবং আমাদের থেকে ভিন্ন, তাই নতুনদের সঙ্গে কাজ করার উত্তেজনা, আনন্দ আলাদা। নতুন করে অনেক কিছু শেখা–জানার সুযোগ হয়।’ নতুনদের শুধু একটা বিষয়ে তিনি খানিকটা শঙ্কিতও। সবাইকে নির্মাণের আগে সফল হওয়ার হিসাব কষতে দেখেন। এটা যুদ্ধে নামার পূর্বেই আত্মসমর্পণ বলে বিবেচনা তাঁর!
একুশে পদকপ্রাপ্ত এই অভিনেতা জানালেন, সম্পর্ক তাঁর প্রিয় বিষয়। মানুষে মানুষে সম্পর্ক কী বিচিত্র, আকর্ষণীয় আর গভীর। দেশের অধিকাংশ মানুষ সম্পর্ক যে ভাববার, অনুভব করার বিষয়; তা মনে করে না। বেশি বেশি সম্পর্কের গল্প দেখতে পেলে মানুষ অনেকটা সংবেদনশীল হতে পারত।
সিনেমা কি আসছে?
আলাপ তখন শেষের দিকে। আফজাল হোসেনের কাছে জানতে চাই, ‘চলচ্চিত্র নির্মাণের কথা ছিল, কী খবর?’ জানালেন, ছোটদের জন্য সিনেমা বানাতে চান। দীর্ঘদিন ধরে তিনি ছোটদের ধারাবাহিক ‘ছোটকাকু’তে ‘ছোটকাকু’র চরিত্রে অভিনয় করছেন। কিশোর-কিশোরীরা তাঁকে ছোটকাকু বলে সম্বোধন করেন, এটাও খুব উপভোগ করেন। ফরিদুর রেজা সাগরের কিশোর গোয়েন্দা গল্প নিয়ে ‘ছোটকাকু’ চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে চান। আগামী বছরের প্রথম দিকে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেবেন।
সবশেষে জানতে চাওয়া হয়, এত বছর ধরে এত এত বিষয় নিয়ে মেতে থাকলেন, কখনো মনে হয় না, এত কিছু করতে গিয়ে নিজের প্রতি সুবিচার করা হয়নি? শুনেই হাসলেন আফজাল হোসেন। ‘লাভের আশা যদি মনে থাকত, নিশ্চয় মনে হতে পারত—লোকসান হয়েছে। যখন যা করেছি, করেছি ভালোবেসে, জীবন উপভোগের আশা নিয়ে। মানুষ একবার বাঁচে, অতএব মানুষের উচিত, জীবনের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা। কিছু হওয়ার চেষ্টা করে, লাভের আশায় জীবনকে বেঁচে দিলে পাওয়া হয় না অনেক কিছু। এক কূল ভাঙে আরেক কূল গড়ে। কিছু একটা হতেই হবে, এমন তাড়না ছাড়াও অনবদ্য জীবন যাপন করা সম্ভব। যা যা করি, সবই জীবনকে সদা পূর্ণ রাখে। এর চেয়ে বেশি আর কী চাই?’