জাহিদ হাসানের অভিনয় কেন ভালো লাগে

জাহিদ হাসানছবি: প্রথম আলো

স্কুল, কলেজ শেষ করে ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলেন তিনি। কিন্তু পড়ালেখায় মন বসে না। ঢাকা যেতে হবে। ঢাকায় না গেলে স্বপ্ন পূরণ হবে না। অগত্যা বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে ঢাকা শহরে পাড়ি দেন। কেন পাড়ি দেন? আর তাঁর স্বপ্নই বা কী ছিল যে বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়তে হলো?

তিনি বড় হয়েছেন সিরাজগঞ্জ শহরে। তখন মঞ্চনাটকের পসার ছিল। শহরের দলগুলোর অংশগ্রহণে প্রায়ই নাটক মঞ্চস্থ হতো। আগ্রহের সঙ্গে নাটক, যাত্রাপালা দেখতেন তিনি। দেখতে দেখতে ভালো লাগার শুরু। স্কুলে ছাত্র অবস্থায়ই ‘ভাসানী’ নাটকে অভিনয় করে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন। এলাকাবাসীর প্রশংসা পেয়েছিলেন।
কলেজে ভর্তি হওয়ার পর অভিনয়ের নেশা পেয়ে বসে তাঁকে। যোগ দেন ‘তরুণ সম্প্রদায়’ নাট্যদলে। অভিনয় করেন বেশ কিছু নাটকে। তার মধ্যে ‘সাত পুরুষের ঋণ’ নাটকটি বিটিভিতে সরাসরি প্রচারিত হয়েছিল।

অভিনয়ের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে দেওয়ার মতো দুঃসাহসী সিদ্ধান্ত নেওয়া মানুষটা আর কেউ নন, জনপ্রিয় অভিনেতা জাহিদ হাসান। ১৯৬৭ সালের ৪ অক্টোবর সিরাজগঞ্জে তাঁর জন্ম। অভিনয়ের জন্য পেয়েছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। দীর্ঘ ক্যারিয়ারে অভিনয়–নৈপুণ্য দিয়ে জিতেছেন দর্শকের ভালোবাসা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, যেমন ফেসবুকের রিল ও ভিডিওতে বিভিন্ন নাটক থেকে নেওয়া তাঁর অভিনয়ের দৃশ্য ঘুরে ফেরে। এই যে দীর্ঘদিন ধরে দর্শকের ভালোবাসায় থাকতে পারা, তার নেপথ্য কারণ কী?

উত্তর অনুসন্ধানের শুরুতে বিভিন্ন সময়ে পত্রপত্রিকায় দেওয়া সাক্ষাৎকারে অভিনয়জীবন নিয়ে জাহিদ হাসানের বলা কিছু কথা জেনে নেওয়া জরুরি।
জাহিদ হাসানের মতে, ‘কোনো অর্জনই সহজ নয়। অভিনয়ের শুরুতে ধৈর্য না ধরলে পথ পেরোনো সহজ হতো না। অভিনয়ের প্রতি ভালোবাসা তৈরি হওয়ার পরে অনেক ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে একটু একটু করে নিজেকে তৈরি করতে হয়েছে।’

জাহিদ হাসান
ছবি: সংগৃহীত

তবে সফলতার পেছনে ছোটেননি তিনি। তারকা হবেন, এমনটাও কোনো দিন ভাবেননি।
জাহিদ হাসান আরও বলেছেন, ‘তাচ্ছিল্য যেমন অনেক পেয়েছি, লড়াইও করেছি। এই তাচ্ছিল্য বা অবহেলার সময় কেউ না কেউ সঙ্গী হয়ে আসে। হয় মানুষ, নাহয় বই কিংবা একটা গান। আটাশি সালের বন্যার সময় টিএসসি থেকে হেঁটে হেঁটে রামপুরায় যাই। কারণ, পকেটে টাকাপয়সা নেই। পানি মাড়িয়ে ওখানে যাই। বলা যায়, আমার দীনহীন অবস্থা। ১৯৯০-৯১ সালে মানসিকভাবেও জর্জরিত অবস্থা। এরপর কোথায় যেন কী পড়লাম, তারপর আর হতাশ হইনি। সত্যি কথা বলতে, যদি জীবনে সৎ থাকা যায়, নিজের মধ্যে কোনো না কোনো একটা শক্তি থাকেই, যা সেই মানুষকে এগিয়ে নিয়ে যায়।’

জাহিদ হাসানের বক্তব্য থেকে অভিনয়ের প্রতি তাঁর ভালোবাসার ব্যাপ্তি কতটা প্রবল ছিল, তা অনুমান করতে কষ্ট হয় না। পাশাপাশি এ কথাও প্রতীয়মান হয়, ভালোবাসা, পরিশ্রম, ধৈর্য—সব বিনিয়োগ করেই তিনি সফল হয়েছেন। কিন্তু তাঁর অভিনয়ের জাদুটা ঠিক কী, কেন তাঁর অভিনয় আমাদের ভালো লাগে?
‘জীবন যেমন’ নাটকে অভিনয়ের মধ্য দিয়ে টিভি নাটকে অভিষেক হয় জাহিদ হাসানের। সিনেমায় যাত্রা শুরু করেন ১৯৮৬ সালে ‘বলবান’ চলচ্চিত্রে কাজ করার মধ্য দিয়ে। তারপর ধাপে ধাপে এগিয়েছেন তিনি। ‘হালদা’, ‘সাপলুডু’ ইত্যাদি তাঁর উল্লেখযোগ্য সিনেমা।

জাহিদ হাসান। ছবি: সংগৃহীত

১৯৯৯ সালে ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’ চলচ্চিত্রের জন্য শ্রেষ্ঠ অভিনেতা ক্যাটাগরিতে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান জাহিদ হাসান। এ চরিত্রটির কথাই বলা যাক। এই সিনেমায় জাহিদ হাসান অভিনয় করেছেন গায়কের চরিত্রে। চরিত্রটির নাম থাকে মতি মিয়া। তবে সিনেমায় একটিবারের জন্যও তাঁকে জাহিদ হাসান মনে হয়নি। তিনি মতি মিয়াই হয়ে উঠেছেন। আবার ‘হালদা’ সিনেমায় নাদের চৌধুরী চরিত্রটিকেও আপন করে নিয়েছেন তিনি। এই সিনেমার জন্য খলনায়ক হিসেবে পেয়েছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। এই যে চলচ্চিত্র থেকে চলচ্চিত্রে, নাটক থেকে নাটকে প্রতিটি চরিত্রকে আপন করে নেওয়া, চরিত্রটি হয়ে ওঠা—এ জন্যই কি তাঁর অভিনয় আমাদের ভালো লাগে?

আজ রবিবার’, ‘গৃহসুখ প্রাইভেট লিমিটেড’, ‘পাথরে ফুটাব ফুল’, ‘অপু দ্য গ্রেট’, ‘আমি কিন্তু ভালো মানুষ’, ‘সু পাত্রের সন্ধানে’র মতো নাটক-টেলিফিল্মে জাহিদ হাসানের অভিনয়ে মুগ্ধ হননি, এমন নাটক-সিনেমাপ্রেমী মানুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। এই মুগ্ধতার নেপথ্যে কি কেবলই অভিনয়–নিপুণতা, নাকি চরিত্রের বৈচিত্র্য? প্রতিটি নির্মাণে নতুন নতুনভাবে জাহিদ হাসানকে দেখতে পায় বলেই কি তাঁর অভিনয়ে মুগ্ধ হই?

জাহিদ হাসান। ছবি: সংগৃহীত

রোমান্টিক চরিত্রে অভিনয়ের ক্ষেত্রেও মুনশিয়ানা দেখিয়েছেন জাহিদ হাসান। ‘আমার আছে জল’ চলচ্চিত্রে জামিল চরিত্রে তাঁর অভিনয় আমাদের মুগ্ধ করে। ‘প্রজাপতি’ সিনেমায় জাহিদ হাসানের চরিত্রটি একেবারে অন্য রকম। জুয়ার নেশায় স্ত্রীকে অন্যের হাতে তুলে দিতে দেখা যায়। তার পরের দৃশ্যগুলো এত হৃদয়গ্রাহী যে ভাষার মাধ্যমে বর্ণনা করা কঠিন।

অভিনয়–নৈপুণ্য, বৈচিত্র্যময় চরিত্র, বাচনভঙ্গির সারল্য, লুক, এক্সপ্রেশন—সবকিছুর পরেও অভিনয়ে মুগ্ধ হওয়ার ক্ষেত্রে বোধ হয় আরও কিছু বাকি থেকে যায়। সেই আরও কিছু কী? আবেগ, অনুভূতি, ব্যক্তিত্ব, প্রতিক্রিয়া দিয়ে দর্শকের ভাবনার সঙ্গে মিশে যেতে পারা। কারণ, দর্শকের যে প্রত্যাশা থাকে, তা কেবল তখনই পূরণ হওয়া সম্ভব যখন অভিনেতা সংলাপকে নিজের শরীরী ভাষায়ও প্রকাশ করার চেষ্টা করেন। যে কারণে কোনো দৃশ্য দেখে আমাদের হাসি পাই, কোনো দৃশ্য দেখে রাগ হয় আবার কোনো দৃশ্য দেখে চোখে জল আসে। কোনো চরিত্রকে আমরা ভালো বলি, কোনোটিকে খারাপসহ আরও নানা বিশেষণে বিশেষায়িত করি। এমন প্রতিটি বিষয়ই নিজের অভিনয়ে ফুটিয়ে তুলতে পেরেছেন জাহিদ হাসান। তাই কি তাঁর অভিনয়ে আমরা মুগ্ধ হই?

আরও পড়ুন

আজ এই অভিনেতার ৫৭তম জন্মদিন। তাঁকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা। তাঁর একটি কথা দিয়ে লেখাটা শেষ করি। প্রথম আলোকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে জাহিদ হাসান বলেছিলেন, ‘জীবনটা আসলে আয়নার মতো। আয়নায় আমি ভেংচি কাটলে আয়নাও ভেংচি কাটবে। হাসলে আয়নাও হাসবে। আবার অনেক সময়, আসলে জীবনটা কাঁঠালের মতো, কোনো কিছুই ফেলনা নয়।’