ঘটনার পর আমি জাহিদকে ক্ষমা চেয়ে এসএমএস করি: মাহফুজ আহমেদ
চার মাস দেশে ব্যস্ত সময় পার করে আজ শুক্রবার রাতে অস্ট্রেলিয়ায় উড়াল দিচ্ছেন মাহফুজ আহমেদ। স্ত্রী ও সন্তানদের সঙ্গে সময় কাটাতে ছুটে যাচ্ছেন। আগামী দুই তিন মাস সেখানেই থাকবেন। এদিকে দেশে থাকতে ‘প্রহেলিকা’ চলচ্চিত্রের জন্য দর্শকের কাছে হয়েছেন দারুণ প্রশংসিত। আবার ‘অদৃশ্য’ নামের ওয়েব সিরিজের কাজ করে সন্তুষ্টি কথাও বলেছেন। কিন্তু এর মধ্যে ফেসবুক লাইভে অভিনয়শিল্পী জাহিদ হাসানকে উদ্দেশ্য করে একটি কথার কারণে বেশ আলোচনা হচ্ছে মাহফুজ আহমেদকে নিয়ে। মাহফুজ আহমেদও উপলব্ধি করেছেন, জাহিদ হাসানকে নিয়ে এভাবে প্রকাশ্যে কথা বলাটা মোটেও ঠিক হয়নি। এ কারণে অনুতপ্তও তিনি। জাহিদ হাসানের কাছে ক্ষমা চেয়ে খুদেবার্তাও পাঠিয়েছেন।
প্রথম আলোর ফেসবুকে লাইভে সেদিন জাহিদ হাসান প্রসঙ্গে কথা বলা এবং পরবর্তী উপলব্ধি নিয়ে আজ শুক্রবার দুপুরে কথা হয় মাহফুজ আহমেদের সঙ্গে। তিনি বললেন, ঘটনার পর আমি জাহিদকে ক্ষমা চেয়ে এসএমএস করি, যা বলার সেই এসএমএস এ বলেছি। ‘প্রহেলিকা’ ছবির প্রচারণায় চট্টগ্রামে থাকাকালীন জাহিদ ফোন করেছিল। আমি ধরতে পারিনি। আমি আবার ফোন করেছি, সেও ধরতে পারেনি। আমার কাছে মনে হয়েছে, কথাটা বলা মোটেও ঠিক হয়নি। তাই দুঃখপ্রকাশ করে মেসেজ দিয়েছি।’
সেদিনের ফেসবুক লাইভে মাহফুজ আহমেদের অভিযোগ ছিল, প্রয়াত কথাসাহিত্যিক ও নির্মাতা হুমায়ূন আহমেদের একটি সিনেমায় তাঁর চরিত্রে জাহিদ হাসানকে নিয়ে নেয়। মাহফুজ আহমেদের ভাষ্য ছিল, ‘আমার আছে জল’ সিনেমায় জাহিদ হাসান যে রোলটা করেছেন, এই রোল নিয়ে আমার সঙ্গে সবকিছু ফাইনাল। আমি অস্ট্রেলিয়া গিয়েছি স্ত্রীর কাছে। এসে শুনি আমি রোলটা করছি না। ফেরদৌস যে রোলটা করেছে, ওটা আমি করব। আমি বলেছি, আমি করব না। পরে জানলাম জাহিদ হাসান খাসি জবাই করে খাইয়ে বলছে যে এটা আমার স্বপ্নের ক্যারেক্টার স্যার। বিষয়টা জাহিদ আমাকে বললে ভালো হতো। জাহিদ যদি বলত মাহফুজ আমি এটা করতে চাই, তুই ওটা কর। তাহলে আমি খুশি হতাম!
প্রসঙ্গটি মনে করিয়ে দিতে মাহফুজ আহমেদ বললেন, ‘কথার পরিপ্রেক্ষিতে তাৎক্ষণিকভাবে মুখ ফসকে এমন কথা বের হয়ে গেছে। কিন্তু পরে মনে হয়েছে, কথাটা বলা মোটেও ঠিক হয়নি। আমি আবারও বলছি, আমি ভুল বলিনি। কিন্তু বলাটা আমার ঠিক হয় নাই। জাহিদ আমার প্রিয় বন্ধু, বড় ভাইতুল্য। আমি ভালোটাই সব সময় বলব। আমার মনে হয়েছে, সত্য হলেও সব সময় পাবলিকলি অনেক কথা বলতে হয় না। কেউ কষ্ট পাচ্ছে কি না, সম্মানহানি হচ্ছে কি না—এটাও দেখা উচিত।’
জাহিদ হাসানের কাছে কী বলেছেন, জবাবে তিনি কী বলেছেন? এমন প্রশ্নে মাহফুজ আহমেদ বললেন, ‘এই বিষয়ে আমি আর কখনো কাউকে ব্যাখ্যা দেব না। তবে এই কথার পরিপ্রেক্ষিতে বাকি সব সিদ্ধান্ত জাহিদের। জাহিদ বিষয়টা কীভাবে দেখবে, তা একদমই ওর ওপর ছেড়ে দিয়েছি। আমার সবারই পেশাদার জীবনে এ রকম অসংখ্য ঘটনা আছে। কিন্তু এসব ঘটনা পাবলিকলি বলতে নাই। একজন শিল্পীকে নিয়ে কথা বলা মোটেও ঠিক হয়নি।’
বর্তমানে পেশাগত কাজের বাইরে ব্যক্তি আক্রমণ, খুবই ব্যক্তিগত কথাগুলো জনসমক্ষে আসছে বা অনেকে আনছেন। অনেকের মতে, কাজের বাইরের নানা ঘটনা সামনে এনে আলোচনায় থাকার চেষ্টা। তাদের উদ্দেশ্যে কী বলবেন? ‘প্রশ্নটি শুনে হেসে ফেললেন মাহফুজ। বললেন, আট বছর পর কাজ করতে এসে বিষয়টা আমি খেয়াল করেছি। দীর্ঘ অভিনয়জীবনে এই ধরনের কথা প্রথমবার বলেছি। হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে আমি আসলে নস্টালজিক হয়ে যাই। কথাটা আবেগে বলে ফেলেছি। আমি আমার অভিজ্ঞতা দিয়ে পেছনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে ইমোশনালি যে কথাটা বলে ফেলেছি, তার পরিপ্রেক্ষিতে মনে হয়েছে, পাবলিকলি আমরা আমাদের ব্যক্তিগত অনেক কিছুই, ক্ষোভ, দুঃখ, অভিমান, যা কিছুই থাকুক না কেন—এসব পাবলিকলি আসলে মোটেও বলা যায় না। শিল্পীরা তো আরও নন। শিল্পীরা পরস্পর পরস্পরের ব্যাপারে এসব না বলাটাই সমীচীন।’
কথায় কথায় মাহফুজ আহমেদ বললেন, ‘জীবনের সবচেয়ে সুন্দর সময় বলি বা যৌবনকাল বলি না কেন—বেশির ভাগ সময় কাটাই সহকর্মীদের সঙ্গে। এতে সহকর্মীদের অনেক কিছুই আমরা কমবেশি সবাই জানি। সব পরিবারে কমবেশি মান, অভিমান, তিক্ততা, ক্ষোভের ঘটনা ঘটে। মা–বাবা, ভাইবোন সবার মধ্যে হয়। কিন্তু এসব কি আমরা পাবলিকলি বলে বেড়াই? উত্তর না। এটা তো উচিতও নয়। একইভাবে আমাদের শোবিজ অঙ্গনের সহকর্মীরা বর্ধিত পরিবার। কখনো কখনো নিজের পরিবারের চেয়েও বেশি সময় আমরা এখানে দিয়ে থাকি। আমাদের মধ্যে যদি তিক্ততা, মান-অভিমান, ক্ষোভ, ভুল–বোঝাবুঝি থেকে থাকে—নিজেদের মধ্যে বলাবলি করা ভালো। তা কোনোভাবেই পাবলিকলি বলা উচিত নয়। কারণ, এসব তো আজীবন থেকে যাবে। এটা যাঁরা বলেন, তাঁদের প্রতি সাধারণ মানুষের ভুল–বোঝাবুঝি তৈরি হবে। সাধারণ মানুষের কাছে শিল্পী কিংবা কলাকুশলীর ব্যাপারে ভুল বার্তা যায়। আমাদের সম্পর্কে মানুষ নেতিবাচক ধারণা পোষণ করে। মানুষ ভাববে, আমাদের নিজেদের মধ্যেই শ্রদ্ধাবোধ নাই, মায়া-মমতা বলে কিছুই নাই। তাহলে কী করে মানুষকে মায়া-মমতা, শ্রদ্ধা, ভালোবাসা, শিষ্টাচার শেখাব। ভদ্রতা-নম্রতা শেখাব।’
সাংবাদিকতা ছেড়ে অভিনয়ে আসেন মাহফুজ আহমেদ। পার হয়ে গেছে তিন দশকের বেশি সময়। নাটকের পাশাপাশি চলচ্চিত্র আর বিজ্ঞাপনচিত্রেও কাজ করেছেন। মাঝখানে আট বছর সব ধরনের কাজ থেকে দূরে ছিলেন। গত ঈদে মুক্তি পাওয়া ‘প্রহেলিকা’ চলচ্চিত্র দিয়ে প্রশংসিত হচ্ছেন। যুক্ত হয়েছেন ওটিটিতে। গতকাল শেষ করেছেন প্রথম ওয়েব সিরিজ ‘অদৃশ্য’র শুটিং। এই দীর্ঘ অভিনয়জীবনে এমন পরিস্থিতি তাঁর জীবনে আসেনি। মাহফুজ বললেন, ‘আমি জীবনে প্রথম এই ধরনের কথা বললাম। ঠিক হয়নি বুঝতে পেরে ক্ষমা প্রার্থনা করে কথাটা প্রত্যাহার করে নিলাম। আমি মনে করি, এটা আমাদের কখনোই কারও করা উচিত নয়। অশ্রদ্ধা-অসম্মান তৈরি হয়। যাঁর উদ্দেশ্যে এমন কথা বলব, তাঁর প্রতি যেমন খারাপ ধারণা তৈরি হয়, তেমনি যে বলবেন, তাঁর প্রতি আরও বেশি খারাপ ধারণা তৈরি হয়।’
মাহফুজ আহমেদ জানালেন, নিজেদের মধ্যে কাজের ভালোমন্দ নিয়ে কথা বলার চর্চাটাই থাকা উচিত। উৎসাহ–অনুপ্রেরণা দেওয়া উচিত। শিষ্টাচারবহির্ভূত কিছুই করা উচিত নয়। বললেন, ‘আমাদের একে অপরের কাজ নিয়ে বিশ্লেষণ যেন করি। ভালোমন্দ বলি। শিল্পীদের ব্যক্তিগত বিষয়ে আক্রমণ শিষ্টাচারবহির্ভূত, অসম্মানজনক ও অশোভন। আমার অভিজ্ঞতা থেকে বলছি। পাবলিকলি কোনো কথা বললে তা কিন্তু ফেরানো যায় না। কথাটা বন্দুকের গুলির মতো। তা ছাড়া এখন সবার হাতে একটা করে মুঠোফোন, মানে একটা করে চ্যানেল, একটা করে মিডিয়া। তাই কিছু বলার আগে ভাবা উচিত। এখন হয়তো কেউ কেউ বলতে পারেন, উপস্থাপক জিজ্ঞেস করছেন, সাংবাদিকও জানতে চাইছেন। তাহলে কী করব? আমি বলব, অনেকে অনেক কিছুই জিজ্ঞেস করবেন। জিজ্ঞেস করলেই কি আমি বলব? এখানেই তো বাধে বিপত্তি। আমাকে হাজার প্রশ্ন যে কেউ করতেই পারে। আমি কি সব প্রশ্নের উত্তর দেব? এই ধরনের সাংঘর্ষিক প্রশ্নের জবাব তো আরও না। কারণ, প্রশ্নগুলো এমনভাবে আসে যে প্রশ্নগুলোর সঙ্গে আমি আদৌ কোনোভাবে জড়িত না। অদ্ভুত অদ্ভুত সব প্রশ্ন হয়। সবচেয়ে ভালো, আমি এড়িয়ে যাই। যখন এই ধরনের প্রশ্ন এড়িয়ে যাওয়া হবে, তখন প্রশ্নকর্তাও পরে তা আর করবেন না বা করলেও সুবিধা করতে পারবেন না। এই সহনশীলতা আমাদের দেখাতে হবে। পরিমিতিবোধ দেখাতে হবে। বিরতির পর শোবিজে এসে নতুন করে উপলব্ধি করলাম। আমরা একে অপরের কাজ নিয়ে আলোচনা করব। ভালো লাগলে বলব, না লাগলেও বলব। কিন্তু এসব ছাড়িয়ে কেন ব্যক্তিজীবনকে কখনোই সামনে আনব না।’