ভালোবাসা পেতে উত্তমকুমারকেও দিতে হয়েছিল পরীক্ষা

উত্তমকুমারফেসবুক থেকে সংগৃহীত

তখনো সিনেমার কিংবদন্তি উত্তমকুমার হয়ে ওঠেননি তিনি। উপেক্ষা, অবহেলা আর বেকারত্বই ছিল সঙ্গী! অভিনয় করার নেশা আর গান—এটাই যেন ছিল তাঁর অবলম্বন। কিন্তু এভাবে তো আর চলে না। চাকরি দরকার। খুঁজতে খুঁজতে পেয়েও গেলেন জীবনের প্রথম চাকরি। পোর্ট কমিশনার্স অফিসের ক্যাশ ডিপার্টমেন্টে। তেমন ব্যস্ততা নেই। প্রতিদিন সময়মতো অফিসে যান আর ছুটি হলে বাড়িতে এসে বিশ্রাম নেন। বাকিটা সময় অভিনয়ের স্বপ্নে বিভোর থাকেন। তেমনই একদিন অফিস থেকে বাড়িতে ফিরে বিশ্রাম নিচ্ছেন। হঠাৎ চোখ ছুটে যায় সদর দরজার দিকে। জ্যাঠাতো বোন অন্নপূর্ণার সঙ্গে একজন মেয়েকে দেখতে পান। মেয়েটা দেখতে সুশ্রী। তার চেয়ে মিষ্টি তাঁর হাসি। মেয়েটিকে দেখে মুগ্ধ হন উত্তমকুমার। একেবারে লাভ অ্যাট ফার্স্ট সাইট যাকে বলে।
এরপর অতিবাহিত হলো কয়েকটা দিন। কিন্তু অনেক চেষ্টাচরিত্র করেও মেয়েটার মুখ ভুলতে পারলেন না তিনি। অগত্যা অফিস ছুটি হলে যথাসম্ভব দ্রুত বাড়িতে ফিরে অপেক্ষা করতে শুরু করলেন। আবার যদি মেয়েটা আসে, এই আশা নিয়ে। একদিন সত্যি সত্যি মেয়েটি আবার তাঁদের বাড়িতে এল। অন্নপূর্ণাও সঙ্গে ছিল। তার সঙ্গে কথা বলতে ব্যর্থ হয়ে নিজেকে আর নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেন না উত্তম।

সে চলে যেতেই অন্নপূর্ণাকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোকে কে পৌঁছে দিয়ে গেল রে?’ দুষ্টুমির স্বরে বোন পাল্টা প্রশ্ন করল, ‘কে বল দিকিনি?’ ‘ওই যে এখুনি এসেছিল তোর সঙ্গে?’ বললেন উত্তম। ‘ও তো গৌরী... গৌরী রানী গাঙ্গুলী। অ্যাস্টন আর ল্যান্সডাউন রোডের মুখে থাকে।’

সুচিত্রা সেন ও উত্তম কুমার
ইনস্টাগ্রাম

ঠিকানা শুনেই উত্তম বুঝে নিলেন, অভিজাত পরিবারের মেয়ে গৌরী। ভাবলেন, তাঁর সঙ্গে গৌরীর কোনো কিছু হওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু মন বড় বেসামাল, মনের সঙ্গে কে পারে! তাই পরবর্তীকালে গৌরী আবার যখন তাঁদের বাড়িতে এলেন, অন্নপূর্ণার বলা কথাগুলো মনে পড়ল, ‘গৌরীর সঙ্গে একটি গানের স্কুলে আমার পরিচয়। সে গান ভালোবাসে।’ আর কালক্ষেপণ করলেন না তিনি। নিজের ঘরে হারমোনিয়াম নিয়ে বসে পড়লেন। উদ্দেশ্য গৌরীকে গান শোনানো। গলা খুলে গান করছেন। হৃদয় আকুল হয়ে আছে গৌরীর জন্য। মন বলছে, এই বুঝি গান শুনতে শুনতে গৌরী এসে দাঁড়াবেন দরজার সামনে। কিন্তু তেমন কিছুই ঘটল না। অন্যান্য দিনের মতো অন্নপূর্ণার সঙ্গে আলাপ সেরেই গৌরী চলে গেলেন। কষ্ট পেলেন উত্তম। তাই কিছু সময় পর যখন অন্নপূর্ণা তাঁর কাছে এল, কিছুটা রাগী স্বরেই তিনি বললেন, ‘কী চাই’? ‘গৌরী বলল, ‘তোর দাদার গানের গলাটা তো বেশ।’ ও তোমার সঙ্গে দেখা করবে, আলাপ করবে বলেছে।’ অন্নপূর্ণার কণ্ঠে কথাটা শুনে হৃদয় নেচে উঠল তাঁর।

শুরু হলো অপেক্ষা। কিন্তু কিছুদিন অতিবাহিত হলেও গৌরী আর তাঁদের বাড়িতে এলেন না। রুপালি পর্দায় অভিনয়ের সুযোগ না পাওয়ার কষ্টের সঙ্গে নতুন করে যুক্ত হলো গৌরীকে কাছে পাওয়ার ব্যাকুলতা। মন নানা কথা বলে। গৌরী ধনীর দুলালি, তাঁকে কাছে পাওয়া দুরাশা ইত্যাদি। ভেবে আবারও ভুলে যেতে চেষ্টা করলেন তিনি। কিন্তু পারলেন না। কিছুদিন যেতেই মন ও জ্ঞানবুদ্ধির সঙ্গে একপ্রকার দ্বন্দ্ব করেই গৌরীর সঙ্গে দেখা করতে স্কুলের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। কিন্তু লাভ হলো না। গৌরীকে তাদের দারোয়ান স্কুলে পৌঁছে দিতেন, তাই আর কথা বলতে পারলেন না। ছুটির পর কথা বলার সুযোগ মিলতে পারে ভেবে গৌরীর বাড়ি ফেরার পথে গিয়ে দাঁড়ালেন। কিন্তু তখনো দারোয়ানকে সঙ্গে দেখে হতাশ হলেন উত্তম। তবে গৌরী তাঁকে নিরাশ করলেন না। দারোয়ানকে লুকিয়ে চুপি চুপি বললেন, ‘তুমি বাড়ি যাও, আমি দেখা করব তোমাদের বাড়িতে।’ উত্তম-গৌরীর মন দেওয়া-নেওয়া শুরু হলো।

আরও পড়ুন
‘অতি উত্তম’-এ উত্তম কুমার
ভিডিও থেকে নেওয়া

সেই সঙ্গে ভাগ্য খুলল। সিনেমায় অভিনয়ের সুযোগ পেলেন উত্তমকুমার। কথাটা প্রথমে মাকে জানালেন। তারপর গেলেন গৌরীর কাছে। বললেন, ‘আমি সিনেমায় নামছি, তোমার মত কী গৌরী?’ ‘বেশ তো, এতে আমার আবার মতামত কী?’ বললেন গৌরী। সুযোগ বুঝে ঝটপট কথাটি বলে ফেললেন উত্তমকুমার, ‘গৌরী, বিশ্বাস করো, আমি তোমাকে ভালোবাসি। আর ভালোবাসি বলেই তোমার মতামত আমার একান্ত দরকার।’ কথাটা শুনে হাসলেন গৌরী। হাসতে হাসতেই বললেন, ‘তুমি সিনেমায় নামলে আমি খুশি হব বেশি।’
ভালোবাসার মানুষের সঙ্গে দিনগুলো হাসি-গানে চলতে থাকল। এর মধ্যে ‘দৃষ্টিদান’ মুক্তি পেয়েছে। ইচ্ছা ছিল, গৌরীকে সঙ্গে নিয়ে সিনেমাটা দেখবেন। কিন্তু কয়েক দিন ধরে গৌরীর দেখা নেই। এর মধ্যে খবর এল, ঠাকুরমার সঙ্গে ‘দৃষ্টিদান’ দেখতে গিয়ে অঘটন ঘটিয়েছেন গৌরী।

আরও পড়ুন

ছবি দেখার একপর্যায়ে ঠাকুরমা পর্দার শিল্পীদের কয়েকজনকে দেখিয়ে বলেন, ‘হ্যাঁ রে, দেখ তো ওদের মধ্যে তোর কাউকে মনে ধরে কি না, কাকে তোর পছন্দ?’ গৌরী অপেক্ষা করে না, আঙুল দিয়ে পর্দায় উত্তমকুমারকে দেখিয়ে বলেন, ‘ওকে।’ ঠাকুরমা ভাবলেন, গৌরী বোধ হয় ঠাট্টা করছেন। তিনি রীতিমতো বিস্ময়ের সুরে বললেন, ‘এত ছেলে থাকতে ওই রোগা ছেলেটা?’ সরল মনে গৌরী সব সত্য খুলে বললে, বাড়ি থেকে বেরোনোর ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি হলো।

মায়ের সঙ্গে উত্তম ও গৌরী
ছবি: সংগৃহীত

কেটে গেল কয়েকটি বছর। উত্তমকুমার এর মধ্যে কাজ করেছেন কয়েকটি সিনেমায়। একটাও সফলতার মুখ দেখেনি। সেই সঙ্গে রয়েছে গৌরীর জন্য বেদনা। এর মধ্যেই একদিন খবর এসে পৌঁছাল, গৌরীর বিয়ে ঠিক হয়েছে, কিন্তু গৌরী রাজি নন। ভেঙে পড়লেন উত্তম। ওদিকে গৌরীও নাছোড়বান্দা। ভালোবাসার মানুষকে হারাতে পারবেন না। একদিন সব ভাবনাচিন্তা ছেড়ে ছুটে এলেন উত্তমদের বাড়িতে। উত্তম তখন বাড়িতেই ছিলেন। মায়াজড়ানো কণ্ঠে তাঁর কাছে গিয়ে গৌরী বললেন, ‘এই তো সুযোগ, কথা দাও, এবার তুমি আমাকে তোমার মতো করে আনতে পারবে।’ নানা চিন্তাভাবনা মাথায় এলেও গৌরীর জোরের কাছে হার মানলেন উত্তমকুমার। গৌরীর হাত ধরে তাঁদের বাড়িতে গেলেন। গৌরীর বাবার সামনে দাঁড়ালেন। অনেক বাগ্‌বিতণ্ডার পর ভদ্রলোক রাজি হলেন। স্বপ্ন সত্যি হলো গৌরী ও উত্তমের।