বাগান ফেলে চলে গেলেন ‘বাঞ্ছারাম’, প্রয়াত মনোজ মিত্র

মঙ্গলবার সকালে শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন মনোজ মিত্রকোলাজ

‘বাঞ্ছারাম’ নামটির সঙ্গে বাংলা চলচ্চিত্র ও নাট্যানুরাগীদের পরিচয় বহুদিনের। সেই কবে থেকে বাগান আঁকড়ে ছিলেন বাঞ্ছারাম। এই ইউটিউব দুনিয়ায়ও বাংলা সিনেমার দর্শক মনকে নাড়া দেয় বাঞ্ছারাম কাপালির হাহাকার। বাঞ্ছারামের সেই ‘সাজানো বাগান’, যেন আজও ঠিক তেমনই সাজানোই রয়েছে। তবে ‘বাঞ্ছারাম’ আর নেই। তাঁকে তাঁর ‘সাজানো বাগান’-এর মায়া ত্যাগ করেতেই হলো। প্রয়াত হলেন নাট্যকার মনোজ মিত্র।
বয়স হয়েছিল ৮৬ বছর। হিন্দুস্তান টাইমস, আনন্দবাজারসহ বিভিন্ন ভারতীয় সংবাদমাধ্যম সূত্র জানায়, মঙ্গলবার সকাল ৮টা ৫০ মিনিটে হাসপাতালে শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন মনোজ মিত্র। বেশ কয়েক বছর ধরেই বার্ধ্যক্যজনিত অসুস্থতায় ভুগছিলেন। সকালে এই বরেণ্য অভিনেতা মৃত্যুর খবরটি সংবাদমাধ্যমকে নিশ্চিত করেছেন তাঁর ভাই সাহিত্যিক অমর মিত্র।

গত সেপ্টেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে অসুস্থ হয়ে পড়েন মনোজ মিত্র। কলকাতার সল্টলেকের ক্যালকাটা হার্ট ইনস্টিউটে ভর্তি করা হয়। ভর্তির সময় হাসপাতাল জানিয়েছিল, তাঁর হৃদ্‌যন্ত্র ঠিকমতো কাজ করছে না। হার্ট পাম্পের সমস্যা রয়েছে। এ ছাড়া রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে নেই। ক্রিয়েটিনিনও বিপজ্জনক মাত্রায় বেড়ে গিয়েছে। সোডিয়াম-পটাশিয়ামেরও সমস্যা দেখা দিয়েছে। প্রবীণ অভিনেতার চিকিৎসার জন্য মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হয়েছিল, যদিও চিকিৎসকদের সব চেষ্টা বৃথা গেল! মৃত্যুকালে তিনি রেখে গেলেন, তাঁর স্ত্রী ও কন্যাকে।

অভিনেতা মনোজ মিত্র
প্রথম আলো

তপন সিংহের চলচ্চিত্র ‘বাঞ্ছারামের বাগান’ মনোজ মিত্রকে বাংলা সিনেমায় একজন অমর অভিনেতা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিল। তাঁরই লেখা নাটক ‘সাজানো বাগান’ থেকে তৈরি ওই চলচ্চিত্র। অশীতিপর বৃদ্ধ বাঞ্ছারাম তাঁর নিজ হাতে গড়া ফুল-ফলের বাগান নিয়ে পড়ে ছিলেন। নিজের প্রাণের চেয়েও প্রিয় সেই বাগান। মঞ্চে তিনি ওই বাঞ্ছারামের চরিত্রে যেভাবে ফুটিয়ে তুলেছিলেন, পর্দায়ও জীবন্ত করেছিলেন বাঞ্ছারামকে। তাঁর অভিনয়জীবনের এক মাইলফলক এই ‘বাঞ্ছারাম’। সব ছাপিয়ে তিনি হয়েছিলেন বাঞ্ছারাম। আজ বাগান ফেলে চলে গেলেন তিনি।

মনোজ মিত্রর জন্ম ১৯৩৮ সালের ২২ ডিসেম্বর, বাংলাদেশের সাতক্ষীরা জেলার ধূলিহার গ্রামে। শৈশব কেটেছে তাঁর ওই গ্রামেই। ১৯৫০ সালে ১২ বছর বয়সে তিনি চলে যান কলকাতায়। বাবা অশোক কুমার মিত্র স্বাধীনতা–উত্তর বাংলাদেশে ঢাকায় ভারতের দূতাবাসে চাকরি করেছেন। ১৯৫৭ সালে কলকাতার নাট্যমঞ্চে তিনি প্রথম অভিনয় করেন। আর ১৯৭৯ সালে প্রথম পা রেখেছিলেন সিনেমায়। অভিনয়ের জন্য পেয়েছিলেন সংগীত নাটক একাডেমি পদকসহ নানা পুরস্কার। ছিলেন কলকাতার রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগের অধ্যক্ষ।

‘বাঞ্ছারামের বাগান’ মনোজ মিত্রকে বাংলা সিনেমায় একজন অমর অভিনেতা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিল
ভিডিও থেকে

মনোজ মিত্রর লেখা প্রথম নাটক ‘মৃত্যুর চোখে জল’। লিখেছিলেন ১৯৫৯ সালে। আর ১৯৭২ সালে ‘চাকভাঙা মধু’ নাটকের মধ্য দিয়ে তিনি পর্দার সামনে আসেন। ওই নাটকের নির্দেশনায় ছিলেন নাট্যব্যক্তিত্ব বিভাস চক্রবতী। মনোজ মিত্রর মঞ্চনাটক, যাত্রা, আকাশবাণীর নাটকে অবাধ বিচরণ ছিল।

১৯৭৯ সালে প্রথম পা রেখেছিলেন সিনেমায়
কোলাজ

মনোজ মিত্রর লেখা শতাধিক নাটকের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘চাকভাঙা মধু’, ‘দর্পণে শরৎশশী’, ‘নরক গুলজার’, ‘সাজানো বাগান’, ‘নৈশভোজ’, ‘চোখে আঙ্গুল দাদা’, ‘কাল বিহঙ্গ’, ‘অশ্বত্থামা’, ‘মেষ ও রাখাল’, ‘অলকানন্দর পুত্রকন্যা’ উল্লেখযোগ্য।
মনোজ মিত্র অভিনয় করেছেন ৫৭টি সিনেমায়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ‘হঠাৎ বৃষ্টি’, ‘৬১ নম্বর গড়পার লেন’, ‘উমা’, ‘প্রেম বাইচান্স’, ‘অমর সাথি’, ‘ভালোবাসি শুধু তোমাকে’, ‘আগুন’, ‘চক্র’, ‘দত্তক’, ‘হিংসা’, ‘আবির্ভাব’ ও ‘তুফান’। কাজ করেছেন সত্যজিৎ রায়ের সিনেমাও।