‘বাঞ্ছারাম’ চরিত্রটি তিনি বাংলাদেশ থেকে পেয়েছিলেন

মনোজ মিত্র। (২২ ডিসেম্বর,১৯৩৮–১২ নভেম্বর, ২০২৪)কোলাজ

‘সাজানো বাগান’-এর মায়া ত্যাগ করে চলে গেলেন ‘বাঞ্ছারাম’। গতকাল মঙ্গলবার সকাল ৮টা ৫০ মিনিটে হাসপাতালে শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন কলকাতার গুণী অভিনেতা ও নাট্যকার মনোজ মিত্র। বয়স হয়েছিল ৮৬ বছর। বার্ধক্যজনিত অসুস্থতায় ভুগছিলেন তিনি। গত সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহে গুরুতর অসুস্থ হয়ে সল্ট লেকের ক্যালকাটা হার্ট ইনস্টিটিউটে ভর্তি হন। প্রবীণ অভিনেতার চিকিৎসার জন্য মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হয়েছিল, যদিও চিকিৎসকদের সব চেষ্টা বৃথা গেল!

হাসপাতাল থেকে মনোজ মিত্রর দেহ প্রথমে নিয়ে যাওয়া হয় তাঁর সল্ট লেকের বাড়িতে। তারপর বেশ কিছুটা সময় মরদেহ শায়িত রাখা হয়েছিল রবীন্দ্র সদনে। তাঁকে শ্রদ্ধা জানাতে আসেন জগন্নাথ বসু, ঊর্মিমালা বসু, ব্রাত্য বসু, বিশ্বজিৎ চক্রবর্তী, দেবশঙ্কর হালদার, ইন্দ্রনীল সেন, মেঘনাদ বসু, দুলাল লাহিড়ী, দেবাশিস কুমার, নীল মুখোপাধ্যায়সহ কলকাতার বিনোদনজগতের অনেকে। রবীন্দ্র সদনে তাঁকে দেওয়া হয় গান স্যালুট। এরপর গাড়িতে করে মরদেহ শেষকৃত্যের জন্য নিয়ে যাওয়া হয় কেওড়াতলা মহাশ্মশানে। সেখানেই শেষকৃত্য হয়।

মনোজ মিত্রর জীবনের এক মাইলফলক চরিত্র বাঞ্ছারাম। এই ইউটিউবের যুগেও বাংলা সিনেমার দর্শকের মনকে নাড়া দেয় বাঞ্ছারাম কাপালির হাহাকার। দিনভর নিজ হাতে গড়া ফুল-ফলের বাগান নিয়ে মগ্ন অশীতিপর বাঞ্ছারামকে কি ভোলা যায়! প্রাণের চেয়েও প্রিয় ছিল এই বাগান।

১৯৩৮ সালের ২২ ডিসেম্বর সাতক্ষীরা জেলার ধূলিহর গ্রামে তাঁর জন্ম। ওই গ্রামেই কেটেছে শৈশব। পূজার সময় বাড়ির উঠানে যাত্রা ও নাটক দেখে ছোট থেকেই অভিনয়ের প্রতি আকৃষ্ট হন। ১৯৫০ সালে ১২ বছর বয়সে চলে যান কলকাতায়। স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন। এই কলেজেই দর্শনে স্নাতক পড়ার সময় নাটকের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন মনোজ মিত্র। সেই সময় পার্থপ্রতিম চৌধুরীর মতো বন্ধুদের নিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন নাটকের দল সুন্দরম। সেই থেকে নাটকের সঙ্গে পুরোপুরি জড়িয়ে পড়েন। মনোজ নিজেই বলেছিলেন, ‘প্রথমে আমি নাট্যকার, তারপর অভিনেতা, তারপর নির্দেশক।’

বাঞ্ছারামের বাগান চলচ্চিত্রের দৃশ্য
ইউটিউব থেকে

১৯৫৯ সালে লেখেন প্রথম নাটক ‘মৃত্যুর চোখে জল’। কিন্তু ১৯৭২-এ লেখা নাটক ‘চাকভাঙা মধু’ তাঁর খ্যাতি এনে দেয়। মনোজ মিত্রর লেখা শতাধিক নাটকের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘দর্পণে শরৎশশী’,‘নরক গুলজার’, ‘সাজানো বাগান’, ‘নৈশভোজ’, ‘কাল বিহঙ্গ’, ‘অশ্বত্থামা’, ‘মেষ ও রাখাল’, ‘অলকানন্দর পুত্রকন্যা’ ইত্যাদি। সত্যজিৎ রায়, তপন সিনহা ছাড়াও অনেক পরিচালকের বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রে কাজ করেছেন তিনি। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘বাঞ্ছারামের বাগান’, ‘গৃহযুদ্ধ’, ‘আদালত ও একটি মেয়ে’, ‘ঘরে বাইরে’, ‘বৈদুর্য্য রহস্য’, ‘গণশত্রু’, ‘অন্তর্ধান’, ‘চরাচর’, ‘হুইলচেয়ার’, ‘হঠাৎ বৃষ্টি’, ‘আশ্চর্য প্রদীপ’, ‘উমা’ ইত্যাদি। ১৯৯৮ সালে ভারত ও বাংলাদেশের যৌথ উদ্যোগে তৈরি ‘হঠাৎ বৃষ্টি’ ছবিতে অভিনয় করে প্রশংসিত হয়েছিলেন। রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে নাট্যকলা বিভাগের অধ্যক্ষ হিসেবে যোগ দেওয়ার আগে বিভিন্ন কলেজে দর্শন বিষয়েও শিক্ষকতা করেন।

নিজের সৃষ্ট এই চরিত্রকে মঞ্চে যেমন ফুটিয়ে তুলেছিলেন মনোজ মিত্র, তেমনি তপন সিনহার পরিচালনায় পর্দায়ও করে তুলেছিলেন জীবন্ত!

মনোজ মিত্রর জীবনের এক মাইলফলক চরিত্র বাঞ্ছারাম
কোলাজ

এক সাক্ষাৎকারে মনোজ মিত্র জানিয়েছিলেন, বাঞ্ছারাম চরিত্রটি তিনি বাংলাদেশ থেকেই পেয়েছিলেন। তাঁর ভাষ্যে, ‘বাঞ্ছারাম কিন্তু আমার দেখা একজন জলজ্যান্ত মানুষ! আমার বৃদ্ধ পিসিমা একদিন বললেন, “চল মনু, তোকে একটি পানের বাগান দেখিয়ে আনি!” পিসি সেই পানের বরজের কাছে গিয়ে বাঞ্ছা…বাঞ্ছা বলে চিৎকার করে ডেকেছিলেন। বেশ কিছুক্ষণ পর হঠাৎ দেখি, পাটকাঠি দিয়ে ঘেরা পানের বরজ থেকে শুধু একটা মাথা বেরিয়ে পিসির দিকে তাকিয়ে। মাথাটা একজন বুড়ো মানুষের। মাথার চুল থেকে দাড়ি—সবই সাদা...।’ স্মৃতিচারণায় আরও বলেছিলেন, ‘বাঞ্ছা কুঁজো হয়েই থাকেন, হাঁটেনও কুঁজো হয়ে। পরনে একটা নোংরা খাটো ধুতি, খালি গা। সে এক ভয়ংকর চেহারা! আমি ভয়ে পিসির গায়ে সেঁটে রয়েছি। বাঞ্ছারাম আমার কাছে এসে বললেন, “কী খোকা, খুব ভয় পেয়েছ?” আমি নির্বাক। তিনি তখন বললেন, “দেখো, শুধু এই পানের বরজ নয়, ফুল, ফল, আম, কাঁঠালের যেসব গাছ দেখছ, সবই আমার। এই গাছগুলো আমার ছেলেপিলে। আমি এদের জন্ম দিয়েছি, পালন করেছি। এরা আমায় বাবার মতো ভালোবাসে।” আমি আর কী বুঝব? ভয়েই মরি আরকি! কাছে এসে আমার কাঁধে হাত দিয়ে টেনে নিয়ে চললেন তাঁর ভাঙা কুঁড়ের দিকে। সামনের একটা কাঁঠালগাছে হাত বাড়িয়ে বেশ মাঝারি সাইজের একটা কাঁঠালের বোঁটা ছাড়িয়ে আমার হাতে দিয়ে বললেন, “যাও, এটা নিয়ে বাড়ি যাও। কদিন বাদে পাকলে পিসিকে বলো ভেঙে দেবে। কাঁঠালটা খেয়ো।” সেই আমার প্রথম দেখা বাঞ্ছরামের সঙ্গে, চোখ ভরে দেখছিলাম তাঁর বাগানের বহর। কোন ফুল নেই সেই বাগানে, কোন সবজি ছিল না সেখানে। পরে পিসির কাছেই শুনেছিলাম, প্রতিদিন তিনি পানের বরজ থেকে একগোছ পান পাঠাতেন পিসির জন্য। একটা পয়সাও নিতেন না। কিন্তু গ্রামের অন্য কাউকে তিনি বাগানের ধারেকাছে ঘেঁষতেও দিতেন না। ওই পুরো বাগানই ছিল তাঁর একার সম্পত্তি।’

মনোজ মিত্রর দীর্ঘ পথচলা প্রেরণা জোগাবে দুই বাংলার নাট্যানুরাগী, শিল্পীদের। গতকাল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দুই বাংলার অনেকেই স্মৃতিচারণা করলেন, শোক জানালেন।

রবীন্দ্র সদনে তাঁকে দেওয়া হয় গান স্যালুট
ভাস্কর মুখার্জী

২০১১ সালে দুই বাংলার তরুণ নাট্যকারদের নিয়ে শান্তিনিকেতনের কর্মশালার স্মৃতিচারণা করে নাট্যকার ও অভিনেতা অলোক বসু লিখেছেন, ‘আমরা আড়ালে বলতাম, হেড পণ্ডিত। প্রকৃত শিক্ষাদানের সহজাত প্রবৃত্তি ছিল তাঁর অন্তরে।’ বাকার বকুলের ভাষ্যে, ‘এমন হিউমার এবং স্যাটায়ারধর্মী সংলাপ লিখতে পারা নাট্যকার এই উপমহাদেশে আর এসেছেন কি না, আমার জানা নেই। বাংলাদেশের গবেষকদের অনেকে তাঁকে হালকা মানের নাট্যকার হিসেবে উড়িয়ে দিতে চেয়েছেন! কিন্তু আমি দেখেছিলাম, তাঁর রচিত সংলাপে-বিষয়বস্তুতে সামাজিক ও রাজনৈতিক চিন্তা-দর্শনের গভীরতা! সহজ কথা সহজে বলতে পারার ক্ষমতা! একবার প্রশ্ন করেছিলাম, “এমন হিউমারাস ডায়ালগ কী করে লেখেন?” উনি বললেন, “লেখার সময় শিশু হয়ে যাই, বৃদ্ধ হয়ে গেলেই লেখাটা আরোপিত হয়।”’
শিশুমনের অধিকারী মনোজ মিত্র চলে গেলেন। বছরের পর বছর তিনি আগলে রেখেছিলেন তাঁর বাগান, নাটকের বাগান।