সিরিয়াল কিলার কে? অপূর্বর ‘চালচিত্র’ কতটা চমকে দিল
ক্রিকেটের কারণে ‘ইমপ্যাক্ট প্লেয়ার’ এখন বহুল চর্চিত বিষয়। পশ্চিমবঙ্গের নির্মাতা প্রতীম ডিগুপ্তর সিনেমা ‘চালচিত্র’-এ অভিনয় করেছেন বাংলাদেশি অভিনেতা জিয়াউল ফারুক অপূর্ব। সিনেমাটিতে তাঁর ভূমিকা অনেকটা ‘ইমপ্যাক্ট প্লেয়ার’-এর মতোই। ছোট উপস্থিতি, বড় প্রভাব। সিনেমায় অপূর্ব অবশ্য ঠিকই নিজের ছাপ ফেলতে পেরেছেন। কিন্তু সব মিলিয়ে থ্রিলার হিসেবে কতটা রোমাঞ্চ জাগাতে পারল ‘চালচিত্র’। গত ডিসেম্বরে পশ্চিমবঙ্গের প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পায় সিনেমাটি। গত শুক্রবার সিনেমাটি এসেছে ওটিটি প্ল্যাটফর্ম হইচইতে।
একনজরে
সিনেমা: ‘চালচিত্র’
পরিচালক: প্রতীম ডিগুপ্ত
ধরন: ক্রাইম থ্রিলার
অভিনয়ে: টোটা রায়চৌধুরী, অনির্বাণ চক্রবর্তী, শান্তনু মাহেশ্বরী, ইন্দ্রজিৎ বসু, রাইমা সেন ও জিয়াউল ফারুক অপূর্ব
স্ট্রিমিং: হইচই
দৈর্ঘ্য: ১২৪ মিনিট
কলকাতা শহরে একের পর এক খুন হতে থাকেন নারীরা। তবে এই খুনের মধ্যে মিল আছে। খুন হওয়া নারীরা অবিবাহিত, সবাই নিজেই বিয়ের সম্বন্ধ ভেঙে দিয়েছেন। এখানেই শেষ নয়, খুন করে মরদেহকে বধূবেশ দিয়ে দেয়ালে চালচিত্রের মতো আকার দিয়ে ঝুলিয়ে রেখে যাচ্ছে খুনি। স্পষ্টতই সিরিয়াল কিলারের কাজ। এই কেসের সমাধানে নামে কলকাতা পুলিশের হোমিসাইড বিভাগের চার কর্মকর্তা কনিষ্ক চট্টোপাধ্যায় (টোটা রায়চৌধুরী) ও তাঁর তদন্তকারী দল নাসির রহমান (অনির্বাণ চক্রবর্তী), রিতেশ কুমার (শান্তনু মহেশ্বরী) ও বিশ্বরূপ অধিকারী (নবাগত ইন্দ্রজিৎ বসু)।
চারজন চার ধরনের মানুষ, স্বভাব, হাবভাবে। এই ক্রমিক খুনের সঙ্গে ১২ বছর আগে ঘটে যাওয়া একটি কেসের মিল রয়েছে। কিন্তু সত্যিই কি সেই দুটি কেস জড়িত একে অন্যের সঙ্গে? আদৌ কি সেই সিরিয়াল কিলার ধরা পড়বে? এই গল্প নিয়েই ‘চালচিত্র’।
নির্মাতা প্রতীম আগে ছিলেন চলচ্চিত্র সমালোচক। তাঁর সব সিনেমায় সিনেমাটোগ্রাফি দুর্দান্ত, থাকে দারুণ সব গান; আর থাকে স্মার্ট গল্প বলার ধরন। তাঁর আগের সিনেমা ‘পাঁচ অধ্যায়’, ‘সাহেব বিবি গোলাম’ দেখা দর্শকেরা তা ভালোই জানেন। ‘চালচিত্র’ সিনেমাও এর ব্যতিক্রম নয়। পুরো সিনেমার ভিজ্যুয়াল দুর্দান্ত। ‘জানি না মানে’, ‘ঝাপসা শহর’ গানের সঙ্গে দেবজ্যোতি মিশ্রর সংগীত যোগ্য সংগত দিয়েছে।
এ সিনেমার গল্পে সেভাবে নতুন কিছু নেই। সারা দুনিয়ার এন্তার থ্রিলার দেখা দর্শককে গল্প চমকে দিতে নাও পারে। তবে নিজের সীমিত সম্পদের বলা যায় সর্বোচ্চ ব্যবহার করেছেন নির্মাতা। ঝরঝরে মেদহীন চিত্রনাট্যে টান টান উত্তেজনা, রোমাঞ্চ আছে। কেবল খুন, অ্যাকশন নয়। গল্পে রয়েছে মানবিক দিক, বিশেষ করে চরিত্রগুলোর ব্যক্তিগত জীবনের টানাপোড়েন দারুণভাবে তুলে এনেছেন নির্মাতা। বড় পুলিশ কর্মকর্তা আসামি ধরতে যতই সিদ্ধহস্ত হোন না কেন, তাঁর ব্যক্তিজীবন ততই ঝামেলার। এই ধরনের চরিত্র প্রচুর সিনেমা, সিরিজে দেখা গেছে। আছে ‘চালচিত্র’ সিনেমাতেও, ‘চর্বিত চর্বণ’ হলেও টোটা রায়চৌধুরী ও রাইমা সেনের দাম্পত্যের টানাপোড়েন ভালোভাবে দেখিয়েছেন নির্মাতা।
‘চালচিত্র’-এর সবচেয়ে বড় সম্পদ অভিনয়। টোটা রায়চৌধুরী আগেও বহুবার পুলিশের চরিত্রে নজর কেড়েছেন, এবারও ব্যতিক্রম হয়নি; বরং এবার যেন নিজেই নিজেকে ছাপিয়ে গেলেন। এই সিনেমা মুক্তির খুব কাছাকাছি সময়েই সৃজিতের ‘ভূস্বর্গ ভয়ঙ্কর’-এর ‘ফেলুদা’ হিসেবেই হাজির হয়েছেন টোটা। মোটাদাগে দুটোই রহস্যভেদীর চরিত্র, তবে দুই চরিত্রে তাঁর অভিনয় একেবারেই আলাদা। আপনি যদি পরপর দুই প্রকল্প দেখেন, তবে অভিনেতা টোটার ভক্ত হয়ে যাবেন।
শান্তনু মাহেশ্বরীও পুলিশ চরিত্রে ভালো করেছেন। এটা তাঁর প্রথম বাংলা সিনেমা। সঞ্জয়লীলা বানসালির ‘গাঙ্গুবাঈ কাঠিয়াবাড়ি’ দিয়ে তাঁর হিন্দি সিনেমায় অভিষেক হয়েছিল। তাঁর কি বাংলা উচ্চারণে জড়তা আছে? এ জন্যই কি অবাঙালি পুলিশ অফিসারের চরিত্র দেওয়া হয়েছিল? সে যা–ই হোক, তাঁর ও স্বস্তিকা দত্তর জুটি বেশ ভালো জমেছে। স্বস্তিকা বা রাইমা সেনের খুব বেশি কিছু করার ছিল না, তবে যেটুকু সময় পেয়েছেন খারাপ করেননি।
নাসির চরিত্রে অনির্বাণ চক্রবর্তী আবারও মন কাড়লেন। মেয়ের সঙ্গে তাঁর দৃশ্যগুলো সিনেমা শেষ হওয়ার পরেই মনে থাকে। অনির্বাণ চক্রবর্তীর মেয়ের চরিত্রে তানিকা বসু এই সিনেমায় তাক লাগিয়ে দিয়েছেন। বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন মেয়ের চরিত্রে কি দুর্দান্ত অভিনয়! পুতুলের চরিত্রটি মনে গেঁথে গেল তাঁরই জন্য। নাসিরের মতো ঠান্ডা মাথার শান্ত স্বভাবের চরিত্র মনে হয় না তিনি ছাড়া আর কেউ ফুটিয়ে তুলতে পারতেন। ইন্দ্রজিৎ বসুও নিজ চরিত্রে যথাযথ। কারাবন্দী চরিত্রে ব্রাত্য বসুও দুর্দান্ত।
অল্প উপস্থিতিতেও বাজিমাত করেছেন অপূর্ব। অ্যাকশন আর থানায় জিজ্ঞাসাবাদের সময় টোটা রায়চৌধুরীর সঙ্গে তাঁর সংলাপ বিনিময় অন্য রকম এক রোমাঞ্চ তৈরি করে। কেন যে তাঁর চরিত্রটি আরও বড় হলো না! এ সিনেমা স্বল্পদৈর্ঘ্যের চরিত্রে অভিনয় করে অভিনেতা বুঝিয়ে দিলেন, বড় পর্দার জন্য তিনি তৈরি।
‘চালচিত্র’-এর সবচেয়ে নেতিবাচক দিক খুনি ধরা পড়ার অংশটা। পুরো সিনেমা যতটা রোমাঞ্চ জাগায়, এ দৃশ্য ঠিক সেই মেজাজের সঙ্গে যায় না। তারপরও কপ সিনেমা হিসেবে ‘চালচিত্র’একবার দেখাই যায়।