'নড়াচড়া করবেন না'

​ওস্তাদ জাকির​ হোসেন
​ওস্তাদ জাকির​ হোসেন

টের পাওয়া যাচ্ছিল রাত নয়টা থেকেই। স্টেডিয়ামের বাইরে মাইকে বলা হচ্ছিল, ‘পার্কিংয়ে আর জায়গা নেই।’ সোমবার তখনো শিবকুমার শর্মা মঞ্চে ওঠেননি। কিন্তু স্টেডিয়ামজুড়ে মানুষ আর মানুষ।
উত্তর জানা ছিল, তবু রক্তকরবীর কিশোরের মতো বারবার নানা দর্শককে একই প্রশ্ন করে যাই, ‘আজ কার টানে এসেছেন?’ ব্যতিক্রমহীন উত্তর আসে, ‘জাকির হোসেনের তবলা শুনব বলে এসেছি।’
আগের তিন দিন যাঁরা এসেছেন, তাঁদের জানা ছিল, রাতের শরীরে বয়সের ছোঁয়া লাগলেই কোথা থেকে যেন শীত এসে হাজির হয়। ফলে পোড় খাওয়া অভিজ্ঞ দর্শকদের হাতে সোয়েটার কিংবা শাল—শেষ রাত্তিরে শীতের হানা থেকে বাঁচার রক্ষাকবচ। এই মানুষেরা তখনো জানতেন না, স্টেডিয়ামভর্তি ঘন হয়ে আসা মানুষের কারণে এই রাতে শীত এসে হামলে পড়তে পারবে না। রাত তিনটার দিকে যখন জাকির হোসেন তাঁর অসাধারণ বাদনশৈলী প্রদর্শন শেষ করেছেন, তখনো দেহ-মনের উষ্ণতা ভেদ করে হেমন্তের নবীন শীত দাঁত বসাতে পারেনি কারও শরীরে।
এই দিনটির প্রতিটি পরিবেশনাই ছিল তাৎপর্যময়। তবে যে বিষয়টি নিয়ে না বললেই নয়, তা বলে ফেলা যাক এখানেই। জাকির হোসেন মঞ্চে আসার আগেই আয়োজকেরা দর্শকদের কাছে একটি অনুরোধ রেখেছিলেন, ‘স্থির হয়ে বসুন। হাঁটাচলা করবেন না।’ একই অনুরোধ অন্য শিল্পীদের পরিবেশনার সময়ও করা হয়েছিল, কিন্তু কিছু মানুষ সব সময়ই হতে চান চঞ্চলমতি। ভব্যতা বা শিষ্টাচারের চেয়ে নিজের গতিশীল বর্ণময় জীবনকেই তাঁরা বেশি দামি মনে করেন। তাঁরা ওই অনুরোধ মেনে চলেননি। এমনকি শিবকুমার শর্মা যখন ‘মনোযোগ’ শব্দটি উচ্চারণ করে বললেন, ‘মনোযোগ দিন, বাকিটা সংগীতই করে দেবে’, তখনো এই ‘উড়ে বেড়ানো’ মানুষদের পাখা ঝাপটানি থামেনি।
জাকির হোসেন যখন শুরু করলেন, তখনো কিছু মানুষ কিন্তু নড়ছেন, চড়ছেন, উড়ছেন...
বাদনে যখন এল গতি, তখন এক ফাঁকে জাকির হোসেন দর্শকদের কাছে অনুরোধ রাখলেন, ‘নড়াচড়া করবেন না।’
কথায় নয়, নড়াচড়া বন্ধ হলো বাদনে। তবলার ফাঁকে ফাঁকে তিনি যখন কথা বলে বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন, কী কথা বলা হচ্ছে তবলা দিয়ে, তখনই বুঝি একটু একটু করে নড়াচড়া কমতে শুরু করল। কামানের তোপ, হরিণের ছুটে চলা, ঘোড়া কিংবা বৃষ্টির কথা যখন তবলাই বলতে শুরু করল, তখন আর নড়াচড়া নেই। সবচেয়ে অস্থির মানুষটিও যেন বাদনের আকর্ষণে হয়ে যান গান্ধার শিল্পের শ্রেষ্ঠ মূর্তি।