বিশ্বমঞ্চের স্বপ্নে পাভেল
চিরকুট ব্যান্ডের কনসার্ট যাঁরা সরাসরি উপভোগ করেছেন, তাঁরা ড্রামার পাভেল আরীন-এর বাদনে মুগ্ধ হন। প্রধান ভোকাল, গিটারিস্টদের পাশাপাশি তিনিও নজর কাড়েন। চিরকুট ব্যান্ডের এই ড্রামার বিভিন্ন সময় ব্যান্ডের বাইরে অন্য শিল্পীদের দিয়েও গান করিয়েছেন। তাঁর উদ্যোগে এবার একটি নতুন অনুষ্ঠান তৈরি হয়েছে। ‘লিভিং রুম সেশন’ নামে এ অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা ও অন্যান্য বিষয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বললেন মনজুর কাদের
‘লিভিং রুম সেশন’ অনুষ্ঠানে পাভেলের পরিকল্পনা ও সংগীতায়োজনে এই প্ল্যাটফর্ম থেকে দুটি গান প্রকাশ হয়েছে—রবীন্দ্রসংগীত ‘ভালোবেসে, সখী’ ও লোকসংগীত ‘আমায় যত দুঃখ দিলি বন্ধুরে’। প্রশংসিত হয়েছে পাভেলের উদ্যোগে তৈরি এ আয়োজন। এমন একটি অনুষ্ঠানের স্বপ্ন পাভেল আরীন প্রথম দেখেছিলেন ১৪ বছর আগে। তখন যুক্তরাষ্ট্রের ‘এওএল সেশনস’ নামে একটি অনুষ্ঠান ইউটিউবে দেখেন তিনি। এটি মূলত তাঁর ‘লিভিং রুম সেশন’ অনুষ্ঠানের প্রধান অনুপ্রেরণা। চিরকুট ব্যান্ডের ড্রামার ও সাউন্ড প্রডিউসার পাভেল আরীন সেই পরিকল্পনার কথা এভাবে জানালেন, ‘২০১০ সালের দিকের ঘটনা, ইউটিউবে “এওএল সেশনস” দেখি। মুগ্ধ হই। অবাকও হই। পরে এমটিভি আনপ্লাগড দেখতাম, সেখানে পছন্দের মিউজিশিয়ানের গান শুনতাম। তখন থেকেই ইচ্ছা ছিল এ রকম অভিনব কিছু একটা করার। অল্প বয়সে একটা স্বপ্ন আঁকতে থাকি, আমার মিউজিক দিয়ে নতুন কিছু চেষ্টা করা যায় কি না। এরপর অনেক বৈচিত্র্যময় কাজ করেছি। চ্যানেল নাইনে “জেনএক্স” নামে একটি অনুষ্ঠান করেছি। শুনেছি, ১৮ বছরের তরুণ থেকে ৬০ বছর বয়সীর ওই অনুষ্ঠান ভালো লেগেছে। পাকিস্তানের কোক স্টুডিও শোনা হতো। ভারতের প্রেসিডেন্ট হাউসে আমরা চিরকুট যখন গাইতে গেলাম, তখন পাকিস্তানি মিউজিশয়ানের সঙ্গে দেখা হয়। মিউজিক নিয়ে আলাপ হয়। ওদের অনেকে এবার কোক স্টুডিওর মিউজিক করছে। অনেকের কাছ থেকে নানাভাবে অনুপ্রাণিত হই। আত্মবিশ্বাসও বাড়তে থাকে। দুই বছর আগে অবশেষে এমন একটি অনুষ্ঠান বানানো শুরু করি।’
আয়োজনের উদ্দেশ্য
বাংলাদেশি গান, বিশেষ করে বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী গান বিশ্বের তরুণদের কাছে তুলে ধরার একটা প্রয়াস হিসেবে ‘লিভিং রুম সেশন’, এমনটাই মনে করছেন পাভেল আরীন। তিনি বললেন, ‘আমি যেসব ঐতিহ্যবাহী গান করছি, ওসবে কোনোভাবে নিজেকে জাহির করতে চাইছি না। গানের মূল কথা ও সুরকে ঠিক রেখে, আমার ঢঙে, সংগীতায়োজনে আমার দর্শন ও জানাশোনা তুলে ধরার চেষ্টা করছি। এই আয়োজনে যারা নতুন শিল্পী, যারা ভালো করছে, ভাইরাল নয়, খালি গলায় শুনলে মুগ্ধ হই, তাদের নিয়েই কাজ করছি।’ ‘লিভিং রুম সেশন ১’-এ প্রকাশিত দুটি গানে কণ্ঠ দিয়েছেন কনা ও কাজল দেওয়ান। নয়টি গানের মধ্যে বাকি গানগুলোতে দেখা যাবে জাহিদ নিরব, ইমরান, ঐশী, মাশা প্রমুখকে। পাভেল বললেন, ‘এই প্রজেক্টে একটি মৌলিক গান আছে। আমার এই জীবনে বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রে যে গানগুলো উৎসাহ জুগিয়েছে, হৃদয় ছুঁয়েছে, সেই গানগুলো প্রথম সিজনে পছন্দ করেছি। সিজন টু ও সিজন থ্রিতে মৌলিক গান থাকবে অনেক বেশি।’
প্রেরণায় জেমস ও ফারুকী
পাভেল আরীনের খালাতো ভাই এহসান এলাহী ফান্টি ও আপন বড় ভাই জিমি দীর্ঘ সময় ধরে দেশের রক সংগীতের জনপ্রিয় তারকা জেমসের সঙ্গে ড্রামস বাজিয়েছেন। সব মিলিয়ে জেমসের সঙ্গে চমৎকার পারিবারিক সম্পর্ক ছিল তাঁদের পরিবারের। গানের অঙ্গনের বাইরে নির্মাতা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী দ্বারা অনেক বেশি অনুপ্রাণিত বলেও জানালেন পাভেল।
বললেন, ‘ফারুকী ভাইয়ের ব্যক্তিত্বও আমাকে খুব আকৃষ্ট করে। এই দুজনকে খুব কাছ থেকে দেখেছি, তাঁদের কাছ থেকে অনেক কিছু শিখেছি। শিখছি। আজকে আমি যতটুকু করতে পারছি, তা এই দুজনের কাছ থেকে শিখেই।’ জানা গেছে, পাভেলের যখন বয়স ১৪-১৫ বছর, তখন ঢাকার সিদ্ধেশরীতে থাকতেন। বড় ভাই জিমি ১৪ বছর জেমসের সঙ্গে ড্রামস বাজিয়েছেন। আর ফান্টি তো জেমসের সঙ্গে সেই শুরু থেকে।
পাভেল বললেন, ‘আমি ফান্টি ভাইদের বাসায় বড় হয়েছি। এ কারণে সাউন্ড গার্ডেন থেকে শুরু করে জেমস ভাই, আইয়ুব বাচ্চু, প্রিন্স মাহমুদ ভাই—সবাইকে কাছে পেয়েছি। সবাই আদর করেছেন। তাঁদের কোলের ওপর বড় হয়েছি।’
স্বপ্ন যখন বিশ্বমঞ্চ
পাভেল আরীন স্বপ্ন দেখেন বিশ্বমঞ্চে বাংলাদেশের গানকে নিয়ে যাওয়ার। এটা শতভাগ সম্ভব মনে করছেন তিনি। শুধু দরকার লক্ষ্য ঠিক রাখা এবং কাজের প্রতি সৎ থাকা। পাভেল বললেন, ‘যদি সঠিক জায়গায় সঠিক সঙ্গী যদি পাওয়া যায়; আমার ফোকাস ঠিক থাকে এবং সততা ধরে রাখতে পারি, তাহলে অন্য কোনো সমস্যাই সমস্যা নয়। পৃথিবীতে প্রচুর টাকা আছে। অনেক প্রযোজক আছেন। শুধু দরকার সততা, সময়ানুবর্তিতা ও প্রতিভা।’ কথায়–কথায় পাভেল আরীন সত্যজিৎ রায়ের একটি কথা মনে করলেন। জানালেন, এই কথা তাঁকে শিল্পের পথে মান ধরে রাখতে সবচেয়ে বেশি আত্মবিশ্বাসী করে রাখে। পাভেল বললেন, ‘আমি কোনো দিন আমার স্ট্যান্ডার্ড থেকে নামব না।
বিবিসিতে দেওয়া সত্যজিৎ রায়ের একটা কথা, “শ্রোতার জন্য আমি আমার মান কমাতে চাই না। শিল্পীর কাজ সব সময় শ্রোতাকে নতুন কিছু দেওয়া। শ্রোতা গ্রহণ করল কি করল না, সেটা বিষয় না। শ্রোতার ফ্রিডম, রাইট এবং চয়েজ—সবই আছে।” তাই আমিও আমার জায়গা থেকে ইনোভেশন, এক্সপেরিমেন্ট চালাতেই থাকব।’
সিনেমা প্রযোজনা
সিনেমা প্রযোজনা করতে চান পাভেল আরীন। তাঁর মতে, একটা ফিল্মের প্রাণ অডিও এবং ভিডিও—দুটোই। তিনি বললেন, ‘দুঃখজনক হচ্ছে, এই ইকোসিস্টেমটা আমাদের প্রজন্ম এখনো পাইনি। গান নিয়ে এত ডিটেইলসে কাজও অবশ্য হয়নি। মিশন ইমপসিবল যে লেভেলের কাজ, সে লেভেলের কাজ। অনেক ইনভলভমেন্ট, বাজেট এবং স্বাধীনতাও আমাদের লাগবে। অস্কারের মতো মঞ্চে যেতে হলে আমাদের সবচেয়ে বড় মাধ্যম কিন্তু চলচ্চিত্র। এটাই পৃথিবীর সবচেয়ে বড় প্ল্যাটফর্ম। ফিল্মে যদি প্রপার স্বাধীনতা পেয়ে এক্সিকিউট করা না যায়, তাহলে ওই জায়গাটায় পৌঁছানো সম্ভব নয়। আমাকে এত স্বাধীনতা এখন কে দেবে? তাই নিজেকেই উদ্যোগ নিতে হবে, সেটার জন্য হয়তো ১০ বছর, ৫ বছর, ৭ বছর হয়তো লেগে যাবে। তখনই ছবি প্রযোজনা করব।’