শিরদাঁড়া উঁচু করে চলা তাঁর কাছ থেকে শিখেছি: রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা
বাংলাদেশের সংস্কৃতি অঙ্গনের অগ্রণী ব্যক্তিত্ব, সংগীতজ্ঞ, ছায়ানটের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি সন্জীদা খাতুন আর নেই। আজ মঙ্গলবার বেলা ৩টা ১০ মিনিটে রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালের আইসিইউতে তিনি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। একক পরিচয়ে সন্জীদা খাতুনের বহুমাত্রিক জীবনের পরিচয় দেওয়া যায় না। তিনি একাধারে ছিলেন শিক্ষক ও গবেষক, শিল্পী ও সংগীতজ্ঞ, দক্ষ সংগঠক ও সক্রিয় অধিকারকর্মী। তাঁর মৃত্যুর সংবাদ ছড়িয়ে পড়ার পর দেশের শিল্প–সাংস্কৃতিক অঙ্গনে শোকের ছায়া নেমে আসে। আত্মীয়স্বজনদের পাশাপাশি তাঁর সহযোদ্ধা, সহশিল্পী, শিক্ষার্থী ও গুণমুগ্ধরা শোক প্রকাশ করেন। আজ মঙ্গলবার বিকেলে যোগাযোগ করা হলে তাঁকে নিয়ে শোক প্রকাশ করে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বক্তব্য দেন গুণী রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা। তাঁর বক্তব্য তুলে ধরা হলো।
আমি ১৯৬৭ সালে প্রথম ছায়ানটে ভর্তি হই। তখন সন্জীদা খাতুনকে শিক্ষক হিসেবে পাই। ওই সময় জাহিদুর রহমানও আমাদের ক্লাস নিতেন। আমি তখন স্কুলে পড়ি, ক্লাস ফাইভ না সিক্স সম্ভবত। তখন আজিমপুরের অগ্রণী স্কুলে ছায়ানটের ক্লাস হতো। দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭৫ সালে আমি চলে যাই শান্তিনিকেতনে। তিনি আমার মায়ের বন্ধু ছিলেন, তাই তাঁকে সব সময় সন্জীদা খালা বলে ডাকতাম।
শান্তিনিকেতনে যাওয়ার আগে তিনি আমাকে ইন্টারভিউ তৈরি করে দিলেন। কী কী গান গাইব, তা ঠিক করে দিলেন। ইন্টারভিউ দিয়ে সুযোগ পেলাম। এরপর শান্তিনিকেতনে গেলাম। ১৯৮১ সালে দেশে ফিরে আসি। তবে ওখানে থাকার সময়ও তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ ছিল। তিনি তখন শান্তিনিকেতনে পোস্টডক্টর ছিলেন। দেশে ফিরে আসার পর দেখা করতে যাই। তখন জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী করবি এখন?’ বললাম, ভাবিনি। বললেন, ‘তাহলে ছায়ানটে চলে আয়।’ এরপর ছায়ানটে এসে শিক্ষক হিসেবে যোগ দিই। ১৯৮১ থেকে ১৯৯১ পর্যন্ত টানা ১০ বছর ছায়ানটে শিক্ষকতা করি। ১৯৯১ সালে আবার শান্তিনিকেতনে যাই, পড়তে। ফিরে এসে ১৯৯২ সালে সুরের ধারা শুরু করি।
সুরের ধারা শুরুর আগে সন্জীদা খালাকে বলি, আমি নিজের প্রতিষ্ঠান শুরু করতে চাই। শোনার পর খুশি হলেন, আমাকে অনেক দোয়া করলেন। বললেন যে এ রকম করা দরকার। বাংলাদেশে এ রকম প্রতিষ্ঠান হলে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড এগিয়ে যাবে। ছায়ানট বা সুরের ধারার সঙ্গে কোনো দ্বন্দ্ব নয় কিন্তু সংস্কৃতি বিকাশের জন্য পাশাপাশি আমরা কাজ করব। ওনার শুভকামনা নিয়ে যাত্রা শুরু সুরের ধারার। সুরের ধারার যখন প্রথম অনুষ্ঠান গৃহপ্রবেশ হয়, তখন উনি এসেছিলেন, বেগম সুফিয়া কামালও এসেছিলেন। শুভকামনা জানান। ছায়ানটে যখন ছিলাম, আমাকে অসম্ভব স্নেহ করতেন। ওনার মেয়ে অপালা (অপালা ফরহাদ নভেদ) ও আমি একসঙ্গে গাইতাম। ছায়ানট যখন শ্যামা করল, উনি বললেন, ‘শ্যামার গান বন্যা করবে।’
সন্জীদা আপার কাছে আমার প্রথম গানে হাতেখড়ি। পদ্ধতিগতভাবে গান প্রথম যখন শিখতে শুরু করি, সে হিসেবে ধরতে গেলে তিনিই প্রথম শিক্ষক। শিক্ষক হিসেবে এখন বাংলাদেশে রবীন্দ্রসংগীতের যারা গুরুস্থানীয়, সবাই সন্জীদা আপার কাছে গান শিখেছে। সন্জীদা খালা শিখেছেন আবদুল আহাদদের কাছে। আমাদের প্রজন্মের কমবেশি সবাই তাঁর কাছে শিখেছি। শিক্ষক হিসেবে তাঁর সর্বজনীন একটা স্বীকৃতি ছিল। আমার এখন মনে হচ্ছে, ’৮২-৮৩ সালের দিকের ঘটনা, পঁচিশে বৈশাখের একটা অনুষ্ঠানের জন্য বললেন যে ‘তুই এই গানটা গাইবি।’
আমি গানটা জানতাম না। তুলে যখন গাইলাম, তিনি তখন আমার সঙ্গে হারমোনিয়াম বাজান। ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটে সেদিনের গানের অনুষ্ঠানের পর মাথায় হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে একটা চুমু দিল। বললেন, ‘গানটা খুব জটিল ছিল। খুব ভালো তুলেছিস।’ কথাটা আজ খুব মনে পড়ছে।
সংগঠক হিসেবে আমাদের পথচলা তো তাঁকে অনুসরণ করে। এই যে শিরদাঁড়া উঁচু করে চলা, সব প্রতিকূলতাকে মোকাবিলার শক্তি তো আমরা তাঁকে অনুসরণ করে শিখেছি। ওই সময়ে, পাকিস্তান আমলে ১৯৬৮-৬৯ সালে সম্পূর্ণ প্রতিকূল পরিবেশের মধ্যে দাঁড়িয়ে ছায়ানটকে পরিচালনা করা তো অসম্ভব একটা সাহসের ব্যাপার। আমরা এখনো নানা প্রতিকূলতার মধ্যে নিজের পায়ে, নিজের মাটিতে শক্ত করে দাঁড়িয়ে থাকতে পারি, এগুলো তো তাঁদের কাছ থেকে শিখেছি। এই সময়ে তাঁর চলে যাওয়াটা অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেল। মনে হচ্ছে মাথার ওপর থেকে বিশাল বটগাছটা চলে গেল।