‘মালো মা’ নিয়ে বিতর্ক: নেত্রকোনা নাকি ঢাকা, যা বলছেন সংশ্লিষ্টরা
কোক স্টুডিও বাংলার ‘মালো মা’ গানটি নিয়ে প্রশংসার সঙ্গে বিতর্কও উঠেছে। নেত্রকোনার বাউলসাধক রশিদ উদ্দিনের ‘মাগো মা’ গানের সঙ্গে ঢাকার সাধক, কবি ও শিল্পী খালেক দেওয়ানের ‘মালো মা’ গানের মিল খুঁজছেন শ্রোতারা।
সুরকার ও সংগীতশিল্পী প্রীতম হাসানের সংগীত পরিচালনায় ‘মালো মা’ প্রকাশ করেছে কোক স্টুডিও বাংলা। গত শুক্রবার ইউটিউবে প্রকাশিত গানটি বাংলাদেশের ট্রেন্ডিংয়ের তালিকার শীর্ষে রয়েছে। এ গানের গীতিকার হিসেবে খালেক দেওয়ানের নাম নিয়েছে কোক স্টুডিও বাংলা। প্ল্যাটফর্মটি জানিয়েছে, এ গানের আরেক সংস্করণ লিখেছেন নেত্রকোনার সাধক রশিদ উদ্দিন। ‘মালো মা’ গেয়েছেন খালেক দেওয়ানের নাতি আরিফ দেওয়ান ও সাগর দেওয়ান।
‘মালো মা’ প্রকাশ্যে আসার পর গত সোমবার নেত্রকোনায় এক প্রতিবাদ সমাবেশ হয়েছে। এ সময় রশিদ উদ্দিনের কনিষ্ঠ পুত্র কালা মিয়া, নেত্রকোনা-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য সংস্কৃতিকর্মী ছবি বিশ্বাসসহ অনেকে ছিলেন।
রশিদ উদ্দিনের ছেলে কালা মিয়ার দাবি, গানটির মূল স্রষ্টা রশিদ উদ্দিন, খালেক দেওয়ান নন। অন্যদিকে খালেক দেওয়ানের নাতি আরিফ দেওয়ানের দাবি, এই গানের মূল স্রষ্টা খালেক দেওয়ান।
দেশের দুই অঞ্চলের দুই প্রথিতযশা বাউলসাধক রশিদ উদ্দিন ও খালেক দেওয়ানের কেউই বেঁচে নেই। দুজনই হাজারেরও বেশি গান রচনা করেছেন। বয়সে রশিদ উদ্দিনের ২০ বছরের ছোট খালেক দেওয়ান। জীবদ্দশায় দুজনের সাক্ষাৎ হয়েছিল কি না, তা জানা যায়নি। তবে ‘মাগো মা’ ও ‘মালো মা’ গানের কথার অনেকাংশেই মিল পাওয়া যায়।
‘মাগো মা’ নিয়ে যুক্তিতর্ক
ভাটি অঞ্চলের সাধক বাউল রশিদ উদ্দিনের জন্ম ১৮৮৯ সালে। ১৯৬৪ সালে মৃত্যুর আগপর্যন্ত সংগীত সাধনা করেছেন তিনি। হাজারেরও বেশি গান রচনা করেছেন। নেত্রকোনার এ বাউল মালজোড়াগানের সাধক হিসেবে পরিচিত। ১৯৯৯ সালে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার (মরণোত্তর) পেয়েছেন তিনি।
রশিদ উদ্দিনের ছোট ছেলে কালা মিয়ার দাবি, মৃত্যুরও অন্তত ৩০ বছর আগে আনুমানিক ১৯৩৫ সালের দিকে ‘মাগো মা’ গানটি রচনা করেছেন তাঁর বাবা।
রশিদ উদ্দিনের ছোট ছেলে কালা মিয়ার দাবি, মৃত্যুরও অন্তত ৩০ বছর আগে আনুমানিক ১৯৩৫ সালের দিকে ‘মাগো মা’ গানটি রচনা করেছেন তাঁর বাবা।
ছোটবেলা থেকেই তিনি তাঁর এলাকায় গানটি শুনেছেন; এটি রশিদ উদ্দিনের গান হিসেবেই এলাকায় পরিচিত।অধ্যাপক যতীন সরকার
অধ্যাপক যতীন সরকারের জন্ম ও বেড়ে ওঠা নেত্রকোনায়। ৮৭ বছর বয়সী এই লোকসংগীতের গবেষক প্রথম আলোকে বলেন, ছোটবেলা থেকেই তিনি তাঁর এলাকায় গানটি শুনেছেন; এটি রশিদ উদ্দিনের গান হিসেবেই এলাকায় পরিচিত।
নেত্রকোনার লোককবি জালাল উদ্দীন খাঁর গানের সংকলন ‘জালালগীতিকা’ সম্পাদনা করেছেন যতীন সরকার। রশিদ উদ্দিনের সঙ্গে জালাল খাঁর সখ্য ছিল।
রশিদ উদ্দিনের নাতি আবুল কায়েস বলেন, জীবদ্দশায় নিজের গানের পাণ্ডুলিপি লিখে গেছেন রশিদ উদ্দিন। মূল পাণ্ডুলিপি ধীরে ধীরে নষ্ট হতে থাকায় সেটি দেখে তিনটি অনুলিপি তৈরি করেছে পরিবার। রশিদ উদ্দিনের মৃত্যুর পর অনুলিপি লেখার কাজটা করেছেন তাঁর শিষ্য চান মিয়া দেওয়ানের ভাই দলিল লেখক সুরুজ আলী। রশিদ উদ্দিনের গানের অনুরাগী ছিলেন সুরুজ। তিনি মারা গেছেন।
রশিদ উদ্দিনের লেখা মূল পাণ্ডুলিপির বেশির ভাগ পৃষ্ঠাই নষ্ট হয়ে গেছে। ১৯৮০ সালের দিকে কালা মিয়ার কাছ থেকে একটি অনুলিপি সংগ্রহ করেছেন শিকড় উন্নয়ন কর্মসূচির পরিচালক রফিকুল ইসলাম। তিনি প্রথম আলোকে জানান, রশিদ উদ্দিনের মূল পাণ্ডুলিপি থেকে অনুলিপি করা সুরুজ আলীর হাতে লেখা একটা পাণ্ডুলিপি পেয়েছেন তিনি।
রশিদ উদ্দিনের মূল পাণ্ডুলিপি ও অনুলিপি পাণ্ডুলিপির ভিত্তিতে ২০১৩ সালে দুটি বই প্রকাশিত হয়েছে। এর মধ্যে সেপ্টেম্বরে প্রকাশিত হয়েছে আবু দায়েনের ‘বাউলসাধক রশিদ উদ্দিন ও তাঁর গান’; নভেম্বরে প্রকাশিত হয়েছে গোলাম মোস্তফা সম্পাদিত ‘রশিদ গীতিকা’; দুই বইয়েই ‘মাগো মা’ গানটি অভিন্নভাবে এসেছে।
মাগো মা ঝিগো ঝি করলে কি রঙ্গে
ভাঙ্গা নৌকা বাইতে দিলে গাঙ্গে।।
গোমাই নদী নষ্ট করল ঐ না কোলাবেঙ্গে।।
ভাঙ্গা নৌকায় উঠে জল নদী করে কলকল
কলকলাকল পারি না তার সঙ্গে
নদীর নাম কামনা সাগর বাঁকে বাঁকে উঠে লহর গো...
কত সাধুর ভরাডিঙ্গা পার তার তরঙ্গে।।
ছিলাম শিশু ছিলাম ভালা না ছিল সংসারের জ্বালা গো...হাসিতাম খেলিতাম মায়ের সঙ্গে॥
এই দেহে আইল জোয়ানী ঘারে আইল নয়া পানি গো
কাম কামিনী বসিল বাম অঙ্গে।।
ছিলাম জোয়ান অইলাম বুড়া লইরা গেছে বাঁকা জোড়া গলই গোড়া সব গিয়াছে ভেঙ্গে॥
রশিদ উদ্দিন বলে গানে ভেবে দেখ আপন মনে গো...
একদিন মিশতে হবে মাটির সঙ্গে॥
২০১৩ সালেই প্রথমবারের মতো ‘মাগো মা’ গানটি বইয়ে ছাপা হয়েছে; এর আগে গানটি কোথাও প্রকাশের দালিলিক প্রমাণ মেলেনি। তবে গোলাম মোস্তফা সম্পাদিত ‘রশিদ গীতিকা’ বইয়ে উল্লেখ আছে, ১৯২৯ সালে ‘স্বররাজ লহরী’ নামে রশিদ উদ্দিনের একটি সংগীত সংকলন প্রকাশিত হয়েছিল।
রাজুর বাজার কলেজিয়েট স্কুলের অধ্যক্ষ ও ‘রশিদ গীতিকা’ বইয়ের সম্পাদক গোলাম মোস্তফা প্রথম আলোকে জানান, তিনি ‘স্বররাজ লহরী’ বইয়ের কথা রশিদ উদ্দিনের দ্বিতীয় স্ত্রী আমিরজানের কাছে শুনেছেন। তবে বইটির কোনো কপি রশিদ উদ্দিনের পরিবারের কাছে নেই। এই বইয়ে ‘মাগো মা’ গানটি আছে কি না, তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে রশিদ উদ্দিনের মূল পাণ্ডুলিপিতে গানটি আছে; সেখানে তাঁর স্বাক্ষরও আছে।
‘স্বররাজ লহরী’ বইটি পেলেই গানটি নিয়ে তৈরি হওয়া বিতর্কের অবসান ঘটত বলে মনে করছেন লোকসংগীতের গবেষকেরা।
নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ, সুনামগঞ্জ ও হবিগঞ্জ অঞ্চলে ‘মাগো মা’ গানটির জনপ্রিয়তা রয়েছে; দশকের পর দশক ধরে ভাটি অঞ্চলের মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়েছে পড়েছে।
রশিদ উদ্দিনের ‘মাগো মা’ গানে নেত্রকোনার ‘গোমাই নদের কথা এসেছে। গোমাই নদসহ স্থানীয় সংস্কৃতির আবহ থাকায় গানটিকে ভাটির অঞ্চলের গান হিসেবেই ধারণা করে আসছেন ভাটি অঞ্চলের শ্রোতারা।
প্রয়াত সংগীতশিল্পী বারী সিদ্দিকীর কণ্ঠে ‘মাগো মা’ গানটি ভাটি অঞ্চল ছাপিয়ে দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে। জীবদ্দশায় চ্যানেল আইয়ের ‘আমার যত গান’ অনুষ্ঠানে গানটি পরিবেশনের আগে বারী সিদ্দিকী বলেছিলেন, গানটি রশিদ উদ্দিনের।
বারী সিদ্দিকীর ভাষ্যে, ‘আমি গান শুরুর পঞ্চাশ বছর আগেও নানান বাউল তাঁদের নামে গানটি পরিবেশন করেছেন, রেকর্ডও হয়েছে। শ্রদ্ধেয় হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে কাজের সময় গানটি আমি উদ্ধার করেছি; জানতে পেরেছি, এটা বাউল রশিদ উদ্দিনের গান।’
গানে নেত্রকোনার গোমাই নদের কথা এসেছে। গোমাই নদসহ স্থানীয় সংস্কৃতির আবহ থাকায় গানটিকে ভাটির অঞ্চলের গান হিসেবেই ধারণা করে আসছেন ভাটি অঞ্চলের শ্রোতারা।
নেত্রকোনা সরকারি কলেজের বাংলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সরোজ মোস্তফা গত শুক্রবার এক ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন, ‘একটা অঞ্চলের সাংস্কৃতিক রূপ ও জীবনাচারের ভেতরে একটা গানের জন্ম হয়। কথায়, স্বরে, বাচনিক ভঙ্গিতে প্রতিটি অঞ্চল আলাদা। প্রতিটি অঞ্চলের ভাব ও ভাবুকতা আলাদা। গান শোনা ও শোনানোর ভঙ্গিও আলাদা। মাটির স্বাতন্ত্রিক রূপ ও সুর নিয়ে জন্ম হয় একেকটি গান। গাতক যে অঞ্চলে থাকেন, সেই অঞ্চলই গাতকের মনন, ভাবুকতা ও কণ্ঠস্বর নির্মাণ করেন। নদী ও হাওরের সম্মিলিত জলতরঙ্গের ভেতর থেকে উঠে এসেছে এই গান। জলতরঙ্গের প্রাকৃতিক রূপ-ঐশ্বর্য বাংলার ভাবুকতার দার্শনিক দরদে রশিদ উদ্দিনের মননজাত হয়ে জন্মেছে এই গান।’
সরোজ মোস্তফার দাবি, এই গান কোনোভাবেই ঢাকা কিংবা বিক্রমপুর অঞ্চলের গান হতে পারে না।
মালো মা : যুক্তিতর্ক
রশিদ উদ্দিনের জন্মের ২০ বছর পর ১৯০৯ সালে সাধক, কবি ও বাউলশিল্পী খালেক দেওয়ানের জন্ম ঢাকার কেরানীগঞ্জ উপজেলার বামনসুর গ্রামে। ২০০৩ সালে মারা যান তিনি। তিনিও এক হাজারের মতো গান রচনা করেছেন। আরেক সাধক মালেক দেওয়ান তাঁর ভাই।
খালেক দেওয়ানের নাতি শাকির দেওয়ানের দাবি, ১৯৫০ সালের দিকে ‘মালো মা’ রচনা করেছেন তাঁর দাদা। ১৯৫৪ সালে প্রকাশিত খালেকের নিজের লেখা ‘দেওয়ান গীতিকা’ বইয়ে ‘মালো মা’ গানটি রয়েছে। বইটি ‘দেওয়ান আবদুল খালেক মিয়া’ নামে লিখেছিলেন। ১৯৭৫ সালের মে মাসে বইটির তৃতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয়। বইটি পরিবারের কাছে রয়েছে।
খালেক দেওয়ানের নাতি শাকির দেওয়ানের দাবি, ১৯৫০ সালের দিকে ‘মালো মা’ রচনা করেছেন তাঁর দাদা। ১৯৫৪ সালে প্রকাশিত খালেকের নিজের লেখা ‘দেওয়ান গীতিকা’ বইয়ে ‘মালো মা’ গানটি রয়েছে।
১৯৯৯ সালে খালেক দেওয়ান ফাউন্ডেশন থেকে প্রকাশিত হাসানুল কবীরের ‘খালেক দেওয়ান গীতিসমগ্র’ বইয়েও খালেক দেওয়ানের গানটি রয়েছে।
মালো মা, ঝিলো ঝি, বইন লো বইন, করলাম কি রঙ্গে
ভাঙ্গা নৌকা বাইতে আইলাম গাঙ্গে।।
নদী করে কল্ কল্ বাইন চুয়াইয়া উঠে জল
কত ভরা তল হইল এই গাঙ্গে।।
নদীর নাম কামনা সাগর, বাঁকে বাঁকে উঠছে লাহর
হইলাম ফাঁপর পড়িয়া তরঙ্গে।।
শিশু ছিলাম–ছিলাম ভালা না ছিল সংসারের জ্বালা
সদায় থাকিতাম মায়ের সঙ্গে।।
দেহেতে আইল জুয়ানী উজান বহে গাঙ্গের পানি
এসে রমণী বসিল বাম অঙ্গে।।
ছিলাম জুয়ান হইলাম বুড়া লইড়া গেল বাঁকা গুড়া
গলুই পাছা যেতে চায় গো ভেঙ্গে
ভেবে কয় খালেক দেওয়ানে চিন্তা কর আপন মনে
এক দিন মিশিবে মাটির সঙ্গে।
কোক স্টুডিও বাংলায় গানটি গেয়েছেন খালেক দেওয়ানের নাতি আরিফ দেওয়ান ও সাগর দেওয়ান। আরিফ দেওয়ান বলছেন, ষাটের দশকে গ্রামোফোন রেকর্ডে খালেক দেওয়ানের কণ্ঠে গানটি ধারণা করা হয়েছে। ইউটিউবে ‘তার তরঙ্গ’ নামে একটি চ্যানেলে ‘মালো মা’ গানটি পাওয়া যায়। আরিফ দেওয়ান বলছেন, এটিই ষাটের দশকে খালেক দেওয়ানের কণ্ঠে রেকর্ড করা গান।
ইউটিউবে গানটির বর্ণনায় লেখা আছে, ‘আবদুল খালেক দেওয়ান সাহেবের নিজের কণ্ঠের গান শোনার জন্য আমরা বহু ভক্ত আছি। গানগুলি সহজলভ্য নয়। আমি অনেক চেষ্টা করে কিছু গান সংগ্রহ করেছি।’
বিক্রমপুর-ঢাকা-ফরিদপুর অঞ্চলে দেওয়ান ঘরানার গানের জনপ্রিয়তা রয়েছে।
খালেক দেওয়ানের কণ্ঠে ষাটের দশকে গানটি প্রকাশের পর বিক্রমপুর-ঢাকা-ফরিদপুর অঞ্চলে জনপ্রিয়তা পেয়েছে।
কথাসাহিত্যিক ইমদাদুল হক মিলনের ‘নূরজাহান’ উপন্যাসেও ‘মালো মা’ গানের কথা রয়েছে। তিনি লিখেছেন, ‘নয়–দশ বছরের হামেদ তখন খাওয়া শেষ করেছে। ছেলেটা আমুদে স্বভাবের। এই বয়সেই বয়াতীদের গান শুনে সেই গান ভালো গাইতে পারে। কয়েক দিন আগে তালুকদারবাড়িতে গিয়ে খালেক না মালেক দেওয়ানের দেহতত্ত্বের গান শুনে আসছে। স্মরণশক্তি ভালো। একবার দুবার শোনা গান একদম বয়াতীদের মতো করেই গায়। মা–দাদির কথা–কাটাকাটির মধ্যেও গলা ছেড়ে গান শুরু করল সে।
মালো মা ঝিলো ঝি বইনলো বইন করলাম কী
রঙ্গে ভাঙ্গা নৌকা বাইতে আইলাম গাঙ্গে।’
বাংলা একাডেমির ফোকলোর, জাদুঘর ও মহাফেজখানা বিভাগের পরিচালক তপন বাগচী ফেসবুকে লিখেছেন, ‘ছোটবেলায় অর্থাৎ সত্তরের দশকের মাঝামাঝি সময়ে মাদারীপুরে এই গান শুনেছি। আমাদের বাইচের নৌকায় সারিগান হিসেবেও গাইতে শুনেছি। কোনো ভণিতা ছিল না। পরে বিশ্ববিদ্যালয়জীবনে পদ্মা পাড়ি দিয়ে ঢাকা আসতে আসতে শুনেছি এই গানের “গাঙ্গ” আসলে পদ্মা নদী।’
ছোটবেলায় অর্থাৎ সত্তরের দশকের মাঝামাঝি সময়ে মাদারীপুরে এই গান শুনেছি। আমাদের বাইচের নৌকায় সারিগান হিসেবেও গাইতে শুনেছি।তপন বাগচী, বাংলা একাডেমির ফোকলোর, জাদুঘর ও মহাফেজখানা বিভাগের পরিচালক
তপন বাগচীর ভাষ্যে, ‘একসময় বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলে গান গেয়েছেন খালেক দেওয়ান। তাঁর গান ময়মনসিংহ অঞ্চলে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে রয়েছে। ওই অঞ্চলের জালাল খাঁ, উকিল মুন্সী, রশিদ উদ্দিন, মিরাশ উদ্দিন প্রমুখের গান ঢাকা তথা দেশের অন্য অঞ্চলে তেমন করে প্রবাহিত হয়নি। খালেক দেওয়ানের গান মালেক দেওয়ান, রাজ্জাক দেওয়ান, রজ্জব দেওয়ান, মাখন দেওয়ান, খবির দেওয়ান, আরিফ দেওয়ান, আক্কাস দেওয়ান, মমতাজ বেগম প্রমুখ শিল্পী গেয়েছেন।’
তপন বাগচীর ভাষ্যে, ‘“মালো মা” গানটি যে খালেক দেওয়ানের, তেমনটিই শুনেছি। যেহেতু রশিদ উদ্দিনের এবং খালেক দেওয়ানের ভণিতায় গানটি চলছে, তাই একটা সুরাহা হওয়া দরকার।’
খালেক দেওয়ানের আরেক নাতি শাকির দেওয়ান বলেন, ‘ভাইরে ভাই, বাপরে বাপ’ শিরোনামে একই ধরনের আরেকটি গানও রয়েছে খালেক দেওয়ানের।
কোক স্টুডিও বাংলা কী বলছে
‘মাগো মা’ ও ‘মালো মা’ নিয়ে বিতর্কের মধ্যে কোক স্টুডিও বাংলা এক বিবৃতি দিয়েছে। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, কোক স্টুডিও বাংলা একজন শিল্পীর সৃজনশীলতা ও মেধাসম্পদের মৌলিকত্বের গুরুত্ব অনুধাবন ও মূল্যায়ন করে। আমাদের প্রতিটি গান সতর্কতার সঙ্গে যাচাই করা হয়; ন্যায়সংগত শিল্পীকে প্রাপ্য কৃতিত্ব দেওয়া হয়। “মালো মা” গানটি মো. খালেক দেওয়ানের লেখা। তাঁর বংশধর আরিফ দেওয়ান ও সাগর দেওয়ান এই গানে পারফর্ম করেছেন।’
কোক স্টুডিও বাংলা লিখেছে, “মাগো মা” নামে এই গানের আরও একটি সংস্করণ আছে, যা বাউল রশিদ উদ্দিনের লেখা। গান দুটির মধ্যে বিভ্রান্তি এড়াতে “মালো মা” গানটি প্রকাশের সময়ই ইউটিউবে গানটির বর্ণনায় রশিদ উদ্দিনের নামও উল্লেখ করা হয়েছে।’
রশিদ উদ্দিনের পরিবারের দাবি, অন্তত শত বছর আগে গানটি লিখেছেন রশিদ উদ্দিন। অন্যদিকে খালেক দেওয়ানের পরিবারের দাবি, অন্তত ৭০ বছর আগে গানটি লিখেছেন খালেক দেওয়ান।
গানটির মূল স্রষ্টা কে
দুটি গান বিশ্লেষণ করে অনেকাংশেই মিল পাওয়া গেছে। গবেষকেরা বলছেন, এটা কোনোভাবেই কাকতালীয় নয়। কেউ না কেউ আরেকজনের গানের আদলে আরেকটি গান রচনা করেছেন। লোকসংগীতে এমনটা হরহামেশা ঘটে; ফলে এটি নিয়ে বিতর্কের অবকাশও রয়েছে। গানটির মূল স্রষ্টা একজন হওয়ার কথা।
রশিদ উদ্দিনের পরিবারের দাবি, অন্তত শত বছর আগে গানটি লিখেছেন রশিদ উদ্দিন। অন্যদিকে খালেক দেওয়ানের পরিবারের দাবি, অন্তত ৭০ বছর আগে গানটি লিখেছেন খালেক দেওয়ান। তবে দুই গানেরই রচনাকাল নিয়ে এখনো কোনো দালিলিক প্রমাণ মেলেনি। প্রমাণ পেতে বাংলাদেশ কপিরাইট অফিসে যেতে হবে।
কপিরাইট অফিসে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রশিদ উদ্দিনের ‘মাগো মা’ কিংবা খালেক দেওয়ানের ‘মালো মা’—কোনো গানই কপিরাইট অফিসে নিবন্ধন করা নেই। ফলে গানটির মূল স্রষ্টা কে, তা এখনো নির্ধারিত হয়নি। কোনো গানের স্বত্ব একাধিক ব্যক্তি দাবি করলে দুই পক্ষের কাছে থাকা প্রমাণাদি যাচাই করে যিনি গানটি প্রথমে লিখেছেন, তাঁকেই স্বত্বাধিকারীর স্বীকৃতি দেয় কপিরাইট অফিস।
লোকসংগীত নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে দেখেছি, বহু শিল্পী অন্য কোনো গায়কের লেখা গানের আদলে আরেকটি গান রচনা করেছেন। গানের মিল এতটাই কাছাকাছি, এটা নিয়ে বিতর্ক হওয়াটা খুবই স্বাভাবিক।’সাইমন জাকারিয়া, লোকসংস্কৃতি–গবেষক
রশিদ উদ্দিন ও খালেক দেওয়ানের পরিবারের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কেউই কপিরাইটের আবেদন করেনি। বিষয়টি নিয়ে তাদের জানাশোনা ছিল না।
দুই গানের মধ্যে এত মিল কীভাবে—এমন প্রশ্নের জবাবে লোকসংস্কৃতি–গবেষক সাইমন জাকারিয়া বলেন, ‘বাংলা লোকসংগীতের অনেক গান খুবই সমস্যাপূর্ণ। এসব নিয়ে আলাপ করতে গেলে অনেককে নিয়ে বিতর্ক হবে। লোকসংগীত নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে দেখেছি, বহু শিল্পী অন্য কোনো গায়কের লেখা গানের আদলে আরেকটি গান রচনা করেছেন। গানের মিল এতটাই কাছাকাছি, এটা নিয়ে বিতর্ক হওয়াটা খুবই স্বাভাবিক।’
গানটির মূল স্রষ্টা কে? এ প্রশ্নের উত্তর এখনো মেলেনি।
দুই পরিবারের কেউই কপিরাইট অফিসে আবেদন না করায় বিষয়টি এখনো সুরাহা হয়নি। বির্তকের মধ্যে গবেষকেরাও বলছেন, কপিরাইট অফিসেই এর সুরাহা হওয়া জরুরি।