ডামি ভয়েসটাই দামি হয়ে গেল
দেড় দশক ধরে ঈদ উৎসবে বাড়ি ফেরা মানুষের প্রিয় একটি গান ‘স্বপ্ন যাবে বাড়ি’। গানটি যেন শিকড়ের কথা মনে করিয়ে দেয়। একটি মোবাইল সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান আট বছর আগে নতুন করে ‘স্বপ্ন যাবে বাড়ি ২’ গানটি তৈরি করে। রাসেল মাহমুদের লেখা এই গানের সুর ও সংগীতায়োজন করেন হাবিব ওয়াহিদ। গানটিতে কণ্ঠ দেন মিথুন চক্র। গত বৃহস্পতিবার প্রকাশিত হয়েছে গানটির নতুন একটি ভিডিও চিত্র। যন্ত্রশিল্পী হিসেবে পরিচিত হলেও মিথুনের এই কণ্ঠ দেশ–বিদেশের সবার কাছে পৌঁছে যায়।
আট বছর আগে টালমাটাল সময় পার করছিলেন মিথুন চক্র। একেবারে ব্যক্তিগত ঘটনায় মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। এমন সময় তাঁর ডাক আসে হাবিব ওয়াহিদের কাছ থেকে। ছুটে যান। জানতে পারেন, একটি গানের ডামি ভয়েস দিতে হবে। তখনো জানেন না, কী সেই গান। স্টুডিওতে যান। কথা হয়। জানতে পারেন, বিজ্ঞাপনের সেই ‘স্বপ্ন যাবে বাড়ি’ গানটি গাইতে হবে। মিথুন বললেন, ‘আমি ভেঙে পড়েছিলাম। এর মধ্যে আরেকটা প্রজেক্টেও যুক্ত হই। তারপর হাবিব ভাইয়ের ডাকে যাই। বলা হলো ডামি ভয়েস। ১৫ মিনিটে পুরো গান গেয়ে দিই। আমিও ভাবছিলাম, যেহেতু ডামি ভয়েস...এতেই চলবে। এরপর আরেক দিন ডাক পড়ল। হাবিব ভাই বললেন, আরেকবার কণ্ঠ দিতে হবে। তবে পুরো গান নয়। শুধু “স্বপ্ন টানে”—এই শব্দ দুটি।
প্রতিষ্ঠানের চাহিদা শব্দ দুটিতে ছিল। এই দুটি শব্দ গাইতে সময় বেশি নিয়ে ফেলেছিলাম। ৩০-৩৫ মিনিট লেগে যায়। “স্বপ্ন টানে” এখন আইকনিক একটা টান হয়ে গেছে।’ এটাই ডামি ভয়েসের দামি হওয়ার টার্নিং পয়েন্ট।
অনুভূতি যেমন
‘স্বপ্ন যাবে বাড়ি ২’ গানটি খুব দ্রুত সব দিকে ছড়িয়ে পড়ে। তবে কেউ জানেন না, গানটি কার গাওয়া। অনেকে মনে করেন, হাবিব ওয়াহিদের কিংবা মিলন মাহমুদের। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি কনসার্টে গানটি পরিবেশন করার পর একজন তাঁকে বলেছিলেন, ‘গানটি আপনার, জানতাম না।’ ২০২১ সালের দিকে নিজের কণ্ঠে গানের আনপ্লাগড সংস্করণ প্রকাশ করেন তিনি। গ্রামীণফোনের ক্যাম্পেইনের নাম ‘স্বপ্ন যাবে বাড়ি’, ক্যাম্পেইনের নাম অনুসারেই গানের নামকরণ হয়েছে। গানটি এভাবে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ায় ভীষণ খুশি মিথুন। বললেন, ‘স্বপ্নের চেয়ে বেশি অনুভূতি। কিছু কিছু ক্ষেত্রে গান যে বিনোদনের চেয়েও বেশি, এটা আমরা বুঝতে পারি “স্বপ্ন যাবে বাড়ি”র মতো গান শুনে। যেখানে মানুষের মনের আকুতি তুলে ধরা। মানুষকে নিয়ে যায় শিকড়ে। এই গানে কণ্ঠ ও যন্ত্রশিল্পী হিসেবে কাজ করেছি।’ গানটির অংশ করার জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন হাবিব ওয়াহিদের প্রতি। মিথুন বললেন, ‘তাঁর মতো একজন গায়ক, সুরকার ও সংগীত পরিচালক যে সুযোগ দিয়েছেন, এটাও অনেক বড় ব্যাপার। তিনি অনেক বড় একজন মানুষ। ভেবেছিলেন, আমাকে দিয়ে গাওয়ালে ভালো লাগতে পারে। সত্যি বলতে, ট্রায়াল ভার্সনে গেয়েছি। তখন আমি মাত্র তিনটি গান গেয়েছি। “সাম্পানওয়ালা”, “ডুবেছি”, “বাঁশখালী মইশখালী”। হুট করে একদিন হাবিব ভাই ফোন করে বললেন, আমাকে দিয়ে একটু ট্রাই করতে চান? কিন্তু আমি কোনো রেফারেন্স থেকে সিঙ্গার না। ডামি ভয়েস হিসেবে ক্লায়েন্টকে পাঠাবে। যদি লাগে তো লাগল, না হলে যে নির্ধারিত শিল্পী, সে গাইবে। সেই ডামি ভয়েজটাই দামি হয়ে গেল। (হাসি) ৮ বছর ধরে চলছে।’
উইন্ড অব চেঞ্জ ও কোক স্টুডিও
মিউজিশিয়ান হিসেবে উইন্ড অব চেঞ্জের প্রথম আসর থেকে কাজ শুরু করেন মিথুন। এ আয়োজনে মিথুন তাঁর গুরু আনন্দম শিবামণিকেও সঙ্গে পেয়েছিলেন। মিথুন বললেন, ‘প্রথম গান ছিল পান্থ কানাইয়ের “নৌকা কিনে দেব”। এরপর আমার গুরুজি আমাকে আরও কয়েকটি গানে বাজাতে বললেন। তাপস ভাই আরও কয়েকটি অসাধারণ গানের অংশ করে নিলেন। মিরাকলি সব হয়ে গেল। প্রথম আসরে ১০টা গান বাজানোর সুযোগ হয়।’ কোক স্টুডিওর বেশ কয়েকটি গানে যন্ত্রশিল্পী হিসেবে কাজ করেছেন মিথুন। তিনি বললেন, ‘আমি শুধু ছন্দ বাজিয়ে থাকতে চাই না। ছন্দের মাধ্যমে জীবনের গল্প বলতে চাই। সে ক্ষেত্রে কোক স্টুডিওতে সেই সুযোগ পেয়েছি। এটা আমাদের জন্য অনেক বড় একটা প্ল্যাটফর্ম। বাংলাদেশকে নিয়ে এগোচ্ছে। অনেককে তো বলতে শুনি, কোক স্টুডিওর গান শুনে তাদের ভালো লাগছে। এটাই তো বড় ব্যাপার। বাংলা গান আবার নতুন করে সবাই শুনছে।’
স্বপ্ন তাঁর চলচ্চিত্র
মিথুন প্রথম প্লেব্যাক করেন তৌকীর আহমেদের ‘হালদা’ ছবিতে। পিন্টু ঘোষের সংগীতায়োজনে গানটি ছিল ‘নুরের পুতুলা বাবা মাওলানা’। এরপর এসে বন্ধু ইমন চৌধুরীর সঙ্গে হাওয়া ছবির জনপ্রিয় ‘সাদা সাদা কালা কালা’ গানে রিদম প্রোগ্রামিং করেন তিনি। মিথুন বলেন, ‘বন্ধু ইমন চৌধুরী আমাকে সেই সুযোগ দেয়। আমাদের দুই বন্ধুর মিলিত এই প্রয়াস মানুষের হৃদয় স্পর্শ করে।’ দুজন একসঙ্গে আরও কয়েকটি জনপ্রিয় গানের অংশ হন। এসব গানের মধ্যে আছে ‘ট্যাকা পাখি’, ‘আটটা বাজে দেরি করিস না’ আর কোক স্টুডিওর ‘কথা কইয়ো না’। মিথুন জানালেন, চলচ্চিত্রের গানে সংগীত পরিচালনা করতে চান। তাঁর সুর ও সংগীতে অন্য শিল্পীদের গাওয়াতে চান। বললেন, ‘আগামীর লক্ষ্য চলচ্চিত্র, যেকোনোভাবে থাকতে চাই। আমার ভাবনাচিন্তা তুলে ধরতে চাই। আবহ সংগীতে থাকতে চাই, গাইতেও চাই।’