‘এই ভালোবাসার ঋণ তো আমরা শোধ করতে পারব না’
বরেণ্য সংগীতশিল্পী পাপিয়া সারোয়ার গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন। এর আগে কয়েক দিন ধরে হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন তিনি। গত বুধবার শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে তাঁকে ভেন্টিলেশনে রাখা হয়। পরদিন সকালে ভেন্টিলেশন সাপোর্ট খুলে দেওয়া হয়। পাপিয়া সারোয়ারের মরদেহ গতকাল বেলা ১টায় ধানমন্ডি ২৮ নম্বরের বাসায় নেওয়া হয়। এরপর রাতে বারডেমের হিমঘরে রাখা হয়। আজ শুক্রবার জুমার পর জানাজা শেষে বনানী কবরস্থানে বাবার কবরে সমাহিত করা হবে।
পাপিয়া সারোয়ার প্রসঙ্গে তাঁর দীর্ঘদিনের সহকর্মী ও অনুজেরা শিল্পী ও মানুষ হিসেবে কেন তিনি আলাদা ছিলেন, সে বিষয়ে কথা বলেন।
স্মৃতিচারণা করে সংগীতশিল্পী বুলবুল ইসলাম বলেন, ‘পাপিয়া আপা অসাধারণ মানুষ এ কারণে যে তাঁর মতো সহজসরল মানুষ খুব একটা দেখা যায় না। শিল্পীসমাজের মধ্যে তাঁর অতি সারল্য এবং সরল মানুষটি সবার প্রিয় হয়ে উঠেছিলেন, তাঁর স্বভাবের কারণে। এসব কারণে মানুষটি আমাদের অত্যন্ত প্রিয় এবং অত্যন্ত শ্রদ্ধার একজন মানুষ ছিলেন। তিনি প্রত্যেককে ভীষণ রকম আপন করে নিতে পারতেন। সব মানুষের মধ্যে এই গুণ পাওয়া যায় না। সারাক্ষণ তিনি সবার খোঁজখবর নিতেন, নিজে থেকে। যে মানুষ সরল এবং যাঁর মধ্যে কোনো কুটিলতার কোনো বসবাস ছিল না, তাঁর গানের মধ্যেও সে রকম একটি সারল্য ছিল, স্নিগ্ধতা ছিল। যে স্নিগ্ধতা দিয়ে তিনি সমগ্র বাঙালির মন জয় করেছিলেন।
বুলবুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা যখন খুব ছোট, তখন থেকেই পাপিয়া আপার গান শুনছি। তাঁর গান শুনতে শুনতে আমরা বড় হয়েছি। আমরা বলতে পারি, পাপিয়া আপা বাংলাদেশের রবীন্দ্রসংগীতের একজন পথিকৃত। বাংলাদেশে রবীন্দ্রনাথের গান চর্চা যাঁরা করতেন, মালেক আজিম থেকে শুরু করে, ফাহমিদা খাতুন—তাঁদের পরই পাপিয়া আপারা এলেন। তাঁদের দীঘর্কাল ধরে গানচর্চা, মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক আমরা দেখে আসছি। আমরা যখন একটু বড় হলাম, আপার সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ হলো, তিনি আমাদের অনেক বড় হওয়া সত্ত্বেও আমাদের খোঁজখবর নিতেন। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, পাপিয়া আপাকে হারানো আমাদের বড় বোনকে হারানোর মতো কষ্ট। কারণ, তিনি আমাদের সে রকম স্নেহ করতেন, যেন আমরা তাঁর আপন ছোট ভাই। এই যে অসুস্থ ছিলেন, এর মধ্যেও নিজে থেকে আমাদের খোঁজখবর নিতেন। আমরাই হয়তো তাঁর খোঁজখবর নিতে পারতাম না। ২০-২৫ দিন আগেও ফোন করে বললেন, “কেমন আছিস তোরা?” এই যে ভালোবাসা, এই ভালোবাসার ঋণ তো আমরা শোধ করতে পারব না। তাঁর কাছে আমরা সারা জীবন কৃতজ্ঞ থাকব।’
কথায় কথায় বুলবুল ইসলাম বলেন, ‘আরেকটা কথা বলব, পাপিয়া আপা একজন গান অন্তপ্রাণ মানুষ ছিলেন। রবীন্দ্রনাথের গান ভালোবেসে হৃদয়ে ধারণ করে সুন্দরভাবে পরিবেশন করেছেন এবং সব সময় আরও বিস্তার কীভাবে হয়, সেটি ভাবতেন। ভাবতে গিয়ে তিনি নিজে একটা গানের স্কুল করেছেন। জাতীয় রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদের সঙ্গে যুক্ত থেকেছেন। শুধু রবীন্দ্রসংগীত নয়, সব ধারার গান নিয়ে সারা বাংলাদেশে এই সংগঠন কাজ করে, সেই সংগঠনের তিনি একসময় কর্ণধার ছিলেন। সারা বাংলাদেশের গানপ্রেমীদের সঙ্গে মিশেছেন, তাঁদের উৎসাহিত করেছেন; যে কারণে এই কাজ ও নিজের গান—দুটি মিলে আমাদের সমাজে বেঁচে থাকবেন এবং আমাদের কাছে একজন অনন্য শিল্পী হিসেবেই বেঁচে থাকবেন।’