বাচ্চু বলল, সোলস থেকে ‘একদিন ঘুম ভাঙা শহরে’ গানটি চেয়ে নিয়েছি

‘হারানো বিকেলের গল্প’ আইয়ুব বাচ্চুর গাওয়া প্রথম বাংলা গান। লিখেছেন শহীদ মাহমুদ জঙ্গী। ক্যারিয়ারের শুরু থেকেই বাচ্চুর সঙ্গে তাঁর দারুণ সখ্য। এলআরবির প্রথম অ্যালবামের ‘একদিন ঘুম ভাঙা শহরে’ গানটিও তাঁর লেখা। এ ছাড়া লিখেছেন ‘হৃদয়...কাদামাটির কোনো মূর্তি নয়’, ‘আজ যে শিশু পৃথিবীর আলোয় এসেছে’, ‘যতীন স্যারের ক্লাসে’, ‘প্রেম প্রেমের মতো’, ‘সময় যেন কাটে না’সহ অনেক জনপ্রিয় গান। মৃত্যুদিনে আইয়ুব বাচ্চুকে নিয়ে আবারও স্মৃতিচারণা করেছেন শহীদ মাহমুদ জঙ্গী

এলআরবির ২৫ বছর পূর্তি অনুষ্ঠানে শহীদ মাহমুদ জঙ্গীর সঙ্গে আইয়ুব বাচ্চুসংগৃহীত

সত্তরের দশকের শেষ দিকে সোলসের লিড গিটারিস্ট সাজেদুল আলম বিদেশে চলে যান। এই শূন্য পদের জন্য অনেকেই আগ্রহী থাকলেও শেষ পর্যন্ত আইয়ুব বাচ্চু লিড গিটারিস্ট হিসেবে যোগ দেন। বাচ্চুর বয়স তখন ১৭ কি ১৮। সে সময় সোলসের সুর ও কম্পোজিশনের দায়িত্বে ছিলেন আরেক অসাধারণ মিউজিশিয়ান, নকীব খান। সোলসের প্রথম অ্যালবাম প্রকাশের কিছুদিন পর নকীব খান ঢাকায় চলে আসেন। সোলসে আবার শূন্যতা তৈরি হয়। ব্যান্ডের সুর ও সংগীত কে করবেন?
বাচ্চু শুরু থেকেই দারুণ গিটার বাজাত। দেশি-বিদেশি গানের ওপর তার বিস্তর জানাশোনা। সবাই বাচ্চুকে সুর করার জন্য উৎসাহিত করল। মনে পড়ে, একদিন দুপুরে বাচ্চু এল। সুর নিয়ে অনেক কথাবার্তার পর বলল, ‘জঙ্গী ভাই, গান দিন, সুর করা শুরু করি।’ ওই দুপুরেই সৃষ্টি হলো ‘প্রতিদিন প্রতিটি মুহূর্ত কেন...’।
শুরু থেকেই দেখেছি, বাচ্চু সব সময় অল্পস্বল্প ইংরেজি গান গাইত। ১৯৭৮ সালের একটি দিনের কথা মনে পড়ছে। একদিন চট্টগ্রাম শিল্পকলা একাডেমির মাঠে বাচ্চুর সঙ্গে কথা হচ্ছে। আড্ডাপ্রিয় ছেলে বাচ্চু জমিয়ে কথা বলতে পারে। নানা কথায় বেশ জমেছিল সেদিনের আড্ডা। আমি তার কথা থামিয়ে দিয়ে বললাম, ‘তুমি বাংলা গান গাও না কেন?’ বাচ্চু বলল, ‘ভাই, আমি গাইতে পারি নাকি?’ বললাম, ‘খুব পারো।

ইংরেজি গান গাইতে পারলে বাংলা গানও গাইতে পারবে। শুরু করে দাও।’ বাচ্চু বলল, ‘ওকে, দেন তবে একটা গান লিখে।’ ওই সময়ে পকেট থেকে কলম বের করে লিখে ফেলি, ‘হারানো বিকেলের গল্প বলি/সাগরতীর ধরে এগিয়ে চলি’।

আইয়ুব বাচ্চু
ছবি: প্রথম আলো

আমাকে চমকে দিয়ে সঙ্গে সঙ্গে সুর করে ফেলল বাচ্চু। সে ২৪ ঘণ্টার মিউজিশিয়ান। কুশলবিনিময় দিয়ে কথা শুরু করত, কিন্তু কথা শেষ করত মিউজিক দিয়ে। যেখানেই যেত, সেখানে আগে থেকেই গিটার থাকত অথবা গিটার তার সঙ্গে যেত। একটি দিনের কথা বলি, সোলসের সবাই ও অন্যরা মিলে ফরেস্ট হিলে গিয়েছিলাম। সবাই খাবারের গল্পে ব্যস্ত। বাচ্চু আমাকে ডেকে পাহাড়ের প্রান্তে নিয়ে গেল। নিজে বসল আর আমাকেও বসাল। জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী ব্যাপার বাচ্চু? কিছু বলবে?’ বাচ্চু জবাবে বলল, ‘জঙ্গী ভাই, চারদিকে দেখেন কী সুন্দর!’ বললাম, ‘তা বটে, কিন্তু ওদিকে যে ওরা সব খাচ্ছে...।’

আইয়ুব বাচ্চু
ছবি: প্রথম আলো

বাচ্চু বলল, ‘চলেন, আগে একটা গান করে নিই। আপনি লিখতে থাকেন, আমি সুর করতে থাকি, পরে ওদিকে যাব।’ হেসে ফেললাম, ‘তবে তা-ই হোক।’একটা মুখরা লিখলাম, ‘একদিন ঘুম ভাঙা শহরে/ মায়াবী সন্ধ্যায়/ চাঁদ জাগা এক রাতে/ একটি কিশোর ছেলে/ একাকী স্বপ্ন দেখে/ হাসি আর গানে/ সুখের ছবি আঁকে।’
এটুকু লিখে চারদিকে একবার চোখ বোলালাম। পাহাড়ের ওপর থেকে নিচের দিকে নামা পথ, কিছুটা সমতল ভূমি, অপূর্ব দৃশ্য। হঠাৎ চোখে পড়ল একদিকে ঘাস আর ঘাসের ওপর কিছু ফুল, বাতাসে দুলছে। বাচ্চুকে দেখালাম। বাচ্চু মুগ্ধ হয়ে দেখতে লাগল।

বাচ্চুকে বললাম, ‘ঘুম ভাঙা শহরে’ আরেক দিন লিখব, আজকে এই ঘাসের ওপর ফুলের দৃশ্য নিয়ে কিছু লিখি। বাচ্চু আমার চেয়ে অনেক বেশি উৎসাহী। বলল, ‘আপনি গান লেখা শেষ করতে পারলে, আমি এই বসাতেই সুর করে দেব।’ লিখলাম, ‘কী জানি কী একদিন ছিল/ ঘাসেরও দোলায় ফুল ছিল/ এলিয়ে চুল তুমি ছিলে/ কী জানি কী একদিন ছিল।’ বাচ্চু সুর করল। বলতে দ্বিধা নেই, গানের কথার চেয়ে বাচ্চুর সুর কয়েক গুণ বেশি ভালো হয়েছিল। ওই দিন আড্ডা আর গল্পে অংশগ্রহণ করা হয়নি, কিন্তু বাচ্চুর উৎসাহে গান তৈরি হয়ে গিয়েছিল। গীতিকার–সুরকারমাত্রই জানেন, একটি গান তৈরি হয়ে গেলে যে আনন্দ পাওয়া যায়, তার সঙ্গে আর কোনো আনন্দের তুলনা হয় না।

এলআরবির ২৫ বছর পূর্তি অনুষ্ঠানের ফাঁকে শহীদ মাহমুদ জঙ্গি ও আইয়ুব বাচ্চু। ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া

বাচ্চু প্রথম দিকে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় এসে কাজ করত। পরে এলিফ্যান্ট রোডের ব্লু নাইল হোটেলে একপ্রকার স্থায়ীভাবেই থাকতে শুরু করে। অর্থকষ্ট ছিল। সোলস থেকে অনুষ্ঠান বাবদ পাওয়া টাকা এবং অ্যালবামের সুর ও অ্যারেঞ্জমেন্ট থেকে যে টাকা আসত, তাতে চলা মুশকিল ছিল। তাই একসময় মগবাজারে এক রুমের একটি বাসা ভাড়া নেয় সে। অর্থকষ্ট থাকলেও বিন্দুমাত্র পাত্তা না দিয়ে বাচ্চু হাসিমুখে সংগীত নিয়েই ব্যস্ত থাকত। ঠিক এ রকম সময় বিটিভিতে একটি ব্যান্ড শোর আয়োজন করা হয়। ঠিক হলো, অনুষ্ঠানে ফিডব্যাক ‘মেলায় যাই রে’ গাইবে, একইভাবে মাইলস, রেনেসাঁসহ অন্য প্রধান ব্যান্ডগুলো তাদের জনপ্রিয় গানগুলো গাইবে।

সে সময় সোলসের বাংলা গান তপন চৌধুরী ছাড়া আর কেউ টেলিভিশনে গাইতেন না। তপন চৌধুরী সোলসে নেই। ঠিক হলো, তাঁর জায়গায় বাচ্চু গাইবে। এটাই হবে টেলিভিশনে বাচ্চুর প্রথম গান গাওয়া।

আইয়ুব বাচ্চু
সংগৃহীত

বাচ্চু চ্যালেঞ্জটা গ্রহণ করেছিল। আমি ওই সময় ব্যক্তিগত কাজে চট্টগ্রামে ছিলাম। বাচ্চু আর পার্থ (বড়ুয়া) চট্টগ্রামে ছিল। চট্টগ্রাম থেকে আমি, বাচ্চু ও পার্থ একটা মাইক্রোবাসে উঠলাম। সিদ্ধান্ত হলো, ‘একদিন ঘুম ভাঙা শহরে’ গাওয়া হবে। মুখরা আগেই লেখা হয়েছিল।

চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় আসতে আসতে দুটো অন্তরা লিখে ফেললাম। ঢাকায় পৌঁছে সোজা হোটেল ব্লু নাইলের ২১ নম্বর রুম। পরদিন টেলিভিশনে রেকর্ডিং। বাচ্চু গিটার তুলে নিল, পার্থ বসল কি-বোর্ডে। শুরু হলো কম্পোজিশন।
বিকেল, বিকেল গড়িয়ে রাত, সকালের দিকে সব ফাইনাল করে সোজা বিটিভিতে। গান করল বাচ্চু। টেলিভিশনে তার প্রথম গানে নিজেকে নতুন পরিচয়ে তুলে ধরল বাচ্চু। বুঝিয়ে দিল যে সে জয় করতে এসেছে। একদিনের কথা। তারিখটা ঠিক মনে নেই। সোলস তখন তুঙ্গে, হোটেল ব্লু নাইলে সোলসের সভা চলছে। একসময় দেখলাম, মন খারাপ করে বাচ্চু বেরিয়ে এল। আমার সঙ্গে সিঁড়িতে দেখা। বলল, ‘ভাই, সোলস ছেড়ে দিলাম।’ সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে বাচ্চু বলল, ‘আমি সোলস থেকে “একদিন ঘুম ভাঙা শহরে” গানটি চেয়ে নিয়েছি।’

মনখারাপ বাচ্চুকে আমি জড়িয়ে ধরে কুন্দন রেস্তোরাঁয় বসালাম। আমাদের টেবিলে বন্ধু শহীদুল হক এসে যোগ দিল। বাচ্চুকে সান্ত্বনা দিয়ে বললাম, ‘তুমি জেনুইন মিউজিশিয়ান, তোমার চিন্তা কী? তুমি নতুন ব্যান্ড করো।’ বাচ্চুর সেই একই প্রশ্ন, ‘আমি পারব ভাই?’ বললাম, ‘অবশ্যই পারবে।’

আইয়ুব বাচ্চু ও আজম খান, দুজনই এখন না ফেরার দেশে
প্রথম আলো

বাচ্চু চ্যালেঞ্জ নিল এবং ফলাফল সবার জানা। এলআরবির প্রথম গানও ছিল ‘একদিন ঘুম ভাঙা শহরে’। অবশ্য এটা এমন নয় যে আমি বলাতে বাচ্চু এলআরবি করেছে। সে এমনিতেই করত, কেননা শুধু গান করার জন্যই সে ঢাকায় এসেছিল।
২০১৬ সালের ডিসেম্বর। এলআরবির ২৫ বছর পূর্তি অনুষ্ঠান। বাচ্চু আন্তরিকভাবে দাওয়াত করল। আমি যুক্তরাষ্ট্রে ছিলাম। ঢাকায় এলাম। অনুষ্ঠানে গেলাম। প্রচুর লোকের ওই অনুষ্ঠানে সংগীত জগতের তেমন কাউকে না দেখে বাচ্চুকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘মিউজিক ইন্ডাস্ট্রির কাউকে দেখছি না কেন? তুমি বলো নাই?’ বাচ্চু উত্তরে বলেছিল, ‘মিউজিক ইন্ডাস্ট্রির সবাই তো আমার সমসাময়িক। ওদের বলতে হবে কেন? ওদের এমনিতেই আসা উচিত।’
এই হচ্ছে বাচ্চু, আমার হারানো বিকেলের গল্পের বাচ্চু। আশা নিয়ে এগিয়ে যাওয়া মানুষ, ভালোবাসার কাঙাল। খুব আবেগপ্রবণ ছিল। এই ভালোবাসা, এই আবেগ বাচ্চুর গানকে কালজয়ী করেছে।
(লেখাটি আগে প্রথম আলোয় প্রকাশিত হয়েছিল)