মা-বোনের হাতে বানানো কাপড়ে ঈদ হতো

রুনা লায়লা

আমার জন্ম সিলেটে। বাবার চাকরি সূত্রে ছোটবেলা কেটেছে পাকিস্তানের করাচিতে। ছুটিছাটায় বাংলাদেশে এসে আবার চলে যেতাম। তাই আমার ছোটবেলার ঈদের সব স্মৃতিই করাচিকেন্দ্রিক।

ঈদের সময়টা কখনো ঢাকায় থাকা হয়নি। ছোটবেলার কোরবানি ঈদের কথা অতটা খেয়াল না থাকলেও এটুকু মনে আছে, কোরবানির বেশির ভাগ অংশ বিলিয়ে দেওয়া হতো। মা-বাবাই সবকিছু করতেন।

আমার ছোটবেলার ঈদটা ছিল অন্য সবার মতোই। নতুন কাপড়, জুতা, মাথার ফিতা—এসব নিয়ে মেতে থাকতাম। আমার স্কুল-কলেজ যেহেতু করাচিতে কেটেছে, তাই অধিকাংশ বন্ধুবান্ধবও ছিল ওখানকার। ঈদের মৌসুমে তাদের বাড়ি যাওয়া হতো, ঘোরাঘুরি হতো তাদের সঙ্গে। আসলে ছোটবেলার ঈদ মানে শুধু ঘোরাঘুরি আর আড্ডাবাজি। ঈদের দিন বন্ধুবান্ধবের বাড়ি যাওয়া হতো, খাওয়া হতো। নতুন কাপড় পরে ঘুরে বেড়াতাম। কোনো দায়দায়িত্ব ছিল না। সব মিলিয়ে নিটল একটা আনন্দ ছিল সে সময়। বড়বেলায় তো নানান ঝাক্কি থাকে। যদিও সবকিছু এখন আলমগীর সাহেবই সামলান।

আমরা যেহেতু দেশের বাইরে থাকতাম, বাবা-মা ছিলেন আমাদের সবচেয়ে ভালো বন্ধু। তাঁদের কাছেই ছিল যত আবদার। ছোটবেলায় এমনও শুনতাম, অনেকে ঈদের নতুন জামা কিনে লুকিয়ে রেখেছেন। যাতে ঈদের আগে ভাইবোনেরা কেউ কারোটা দেখতে না পারে। আমাদের আবার সেই সুযোগ ছিল না। কারণ, ঈদের জামাকাপড় একটা সময় পর্যন্ত মা-ই সেলাই করে দিতেন। বাজার থেকে থানকাপড় কিনে আনতেন। এরপর ঘরে সেলাই মেশিনে জামাকাপড় তৈরি হতো। পরে অবশ্য বড় বোন দিনা আপাও নিজের ডিজাইনে আমার জন্য জামাকাপড় বানাতেন।

মা আর বোনের হাতে বানানো কাপড় পরার মধ্যেও একটা আলাদা আনন্দ আছে। বিষয়টা পরম শান্তিরও। ছোটবেলায় ফ্রকটাই সবচেয়ে বেশি পরা হতো; বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সালওয়ার-কামিজ। মা আর বোনের বানানো জামাকাপড় পরে কত আনন্দেই না ঘোরাঘুরি করতাম!

ছোটবেলার প্রতিটি ঈদই ছিল হাসিখুশিমাখা। বাবা তো চাকরি করতেন, মা ছিলেন পুরোদস্তুর গৃহিণী, তিনিই আমাদের ভাইবোনদের সামলাতেন। আমাদের বেড়ে ওঠা ও গড়ে তোলার কাজটা মূলত তিনিই করতেন। তো ঈদের সময় অনেক কিছু রান্না করতেন মা। তাঁর বানানো সব খাবারই খুব মজার ছিল। তার মধ্যে আমার সবচেয়ে পছন্দের ছিল আলুর দম আর লুচি। চিকেন রোস্টও খুবই ভালো লাগত।

বাঁয়ে বড় বোন দিনা লায়লা, সঙ্গে রুনা লায়লা
ছবি: পারিবারিক অ্যালবাম থেকে

আমাদের বাড়িতে গরু আর ছাগল দুটোই কোরবানি দেওয়া হতো। কেন জানি আমার কাছে গরুর মাংস কখনোই প্রিয় ছিল না, ভালো লাগত খাসির মাংস। তবে ইদানীং বেশ কয়েক বছর হয় খাওয়া হয় না। মাটনের কারি আলু দিয়ে সবচেয়ে বেশি ভালো লাগত।

১৯৭৪ সালে বাংলাদেশে আসি আমরা। এসেই মোহাম্মদপুর আসাদ অ্যাভিনিউয়ে আমাদের পৈত্রিক বাড়িতে বসবাস শুরু করি। আগেই বলেছি, বাবা ছিলেন সরকারি চাকুরে, ন্যাশনাল বোর্ড অব রেভিনিউ বোর্ড মেম্বার হিসেবে অবসর নিয়েছিলেন তিনি। করাচি থাকার সময় মা-বোনের বানানো কাপড় পরে ঈদ করা হলেও ঢাকায় আসার পর কাপড় কেনা শুরু করেছি। আমি সেলাই করতে পারি না। তাই নিজের কাপড় কেনার সময় অন্যদেরটাও কেনা হয়।

আমার কাছে, ঈদের আনন্দ ছোটবেলা ও বড়বেলা—দুই সময়েই একই রকমের মনে হয়। এখন তো আমার নাতি-নাতনিরা আছে, তারা আবার বন্ধুর মতো। ছোট সব বন্ধু। ঈদের সময় সবাইকে আমি উপহার দিতে চেষ্টা করি। এতেই এখন আমার আনন্দ।

ঈদ আমাদের উদার হতে শেখায়। আর কোরবানি ঈদ তো আত্মত্যাগের। পৃথিবীজুড়ে এখন সবচেয়ে বড় জিনিস যা দরকার, তা হলো শান্তি। শান্তি থাকলে চারপাশের আনন্দ আরও বেড়ে যায়। কিন্তু এই শান্তির জন্য আমাদের সবার উদারমনা হওয়া ছাড়া উপায় নেই। ভাবতে হবে, আমি যেন অন্যের উপকারে আসতে পারি। সৃষ্টিকর্তা যদি অন্যজনকে সহযোগিতা করার ক্ষমতা আমাকে দেন, তা পরম শান্তির ব্যাপারই বটে। আমি সেই ভাগ্যবানদের একজন যে মানুষকে সহযোগিতা করতে পারে, তাদের আনন্দের উপলক্ষ হতে পারে। এ জন্য স্রষ্টার প্রতি আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই।

কোরবানির মর্মকথা হলো, নিজেকে বিলিয়ে দাও। এই কথা আমি সব সময় মনে রাখি। করাচিতে ছোটবেলায় কোরবানির সময়ে যেমন অল্প কিছু মাংস রেখে সব বিলিয়ে দেওয়া হতো, এখনো আমরা তা-ই করি—অল্প একটু নিজেদের জন্য রেখে বাদবাকি বিলিয়ে দিই। আত্মত্যাগের উৎসবে এই বিলিয়ে দেওয়ার আনন্দটাই আসলে সবচেয়ে বড়।

অনুলিখন: মনজুর কাদের