নব্বইয়ের নস্টালজিয়া উসকে দেন প্রিন্স
প্রিন্স মাহমুদের নাম উসকে দেয় নব্বই দশকের নস্টালজিয়া। তবে তিনি এখনো সমসাময়িক। সময়ের ধুলা তাঁর আভিজাত্যের সৌন্দর্য স্পর্শ করতে পারেনি। এই গীতিকার, সুরকার ও সংগীত পরিচালকের পথচলার গল্প শুনেছেন রেজওয়ান সিদ্দিকী
সিনেমার গান
ভক্তদের মতে, নব্বইয়ের দশকের অডিও অ্যালবামের রাজপুত্র ছিলেন প্রিন্স মাহমুদ। তাঁর সুরারোপিত প্রায় প্রতিটি গানেই বুঁদ ছিলেন ভক্ত-শ্রোতারা। কিন্তু ওই সময় সিনেমার গানে পাওয়া যায়নি তাঁকে। প্রস্তাব পেলেও করা হয়ে ওঠেনি। কারণ জানতে চাইলে প্রিন্স মাহমুদ বলেন, ‘অডিওর গান নিয়ে খুব ব্যস্ত থাকতে হয়েছে। ছবির গানের জন্য বেশি মনোযোগ দিতে হয়। অডিওর ব্যস্ততার কারণে সেই মনোযোগ দিতে পারিনি।’
মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর ‘থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বার’ সিনেমার মাধ্যমে বড় পর্দার সংগীতে অভিষেক হয় প্রিন্স মাহমুদের। ২০০৯ সালে মুক্তি পাওয়া এই ছবিতে ‘জেলখানার চিঠি’ গানটিতে সুর করেন। এরপর ২০১৫ সালে অনিমেষ আইচের ‘জিরো ডিগ্রি’তে ‘প্রেম ও ঘৃণা’ গানটিও সুর করেন। মাঝে বিরতি শেষে প্রিন্স আবার সিনেমার গানে ফেরেন ২০২৩ সালে। হিমেল আশরাফ পরিচালিত ‘প্রিয়তমা’ সিনেমার ‘ঈশ্বর’ গানটি মুক্তির পর ব্যাপক সাড়া ফেলে। এটি ছিল মূলধারার বাণিজ্যিক ছবিতে তাঁর প্রথম গান। ২০২৪ সালে একই পরিচালকের রাজকুমার ছবির ‘বরবাদ’ ও ‘মা’ গান দুটির কথা, সুর ও সংগীতায়োজন করেন তিনি। এ গান দুটিও আলোচিত হয়।
গান শুনে যেন দর্শক সিনেমা দেখার প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠেন, সেটাই লক্ষ্য থাকে প্রিন্স মাহমুদের। তাঁর ভাষ্যে, ‘হিমেল আশরাফ আমাকে এসে বললেন, ভাইয়া, প্রিয়তমার জন্য আপনাকেই দরকার। আপনি ভালো করতে পারবেন। আর ছবির কাহিনিকার প্রয়াত ফারুক হোসেনের কথা বলেন। ফারুকের প্রথম সিনেমার জন্য জেমস ভাইয়ের গান করেছিলাম। যেটা পরে হয়নি। কাজ করার সময় ফারুক ঠিক এভাবেই বলতেন, ‘ভাইয়া, এই গান আপনি ছাড়া কেউ বানাতে পারবে না। তখন কিছুটা আবেগপ্রবণ হয়েই তাঁর প্রস্তাবে রাজি হয়ে যাই। খেয়াল করলে দেখবেন, “ঈশ্বর” গানের মাধ্যমে দীর্ঘদিন পর সিনেমার গান ঠিক আগের মতো আলোচনায় চলে আসে। একটা সময় গান এমন মায়া ছড়াত যে গানের জন্য মানুষ হলে আসত। এই মায়া ছড়াতে চেয়েছিলাম। ঠিক তা–ই হয়েছে।’
এবারও চাঁদরাতে গান আসবে। সেটাও জংলি সিনেমার। এর মধ্যে বাবা-বাচ্চাকে নিয়ে “মায়াপাখি” নামে একটি গান করেছি। এটি ষাট-সত্তর দশকের আবহের গান। মাহতিম সাকিব গেয়েছেন। অবন্তী সিঁথিও আলাদাভাবে গেয়েছে। বাবা-মা তাঁর বাচ্চাকে বুকে জড়িয়ে যেন গানটি গাইতে পারেন, সেভাবেই তৈরি করেছি। হাবিবের জন্যও ভীষণ মায়াময় গান করেছি। চাঁদরাতে প্রকাশ পেতে পারে এটি।
গান জনপ্রিয়তা পাবে কি না, এ নিয়ে কখনো ভাবেন না তিনি। শ্রোতার মনে এভাবে মায়া জাগাতে পারাকেই সার্থকতা বলে মনে করেন।
‘জংলি’ প্রিন্স মাহমুদ মিউজিক্যাল
২০১৬ সাল পর্যন্ত প্রিন্স মাহমুদের মিক্সড অ্যালবাম প্রকাশ পেয়েছে। প্রায় আট বছর পর জংলি সিনেমার জন্য অ্যালবাম করলেন তিনি। এতে চারটি গানের কথা ও সুর তাঁর করা। এ প্রসঙ্গে এই সুরকার বলেন, ‘ছবির গল্পটা ভালো লেগেছে, পরিচালক এম রাহিম-সিয়াম আহমেদের আগের একটি ছবিতে কাজ করার কথা থাকলেও করা হয়ে ওঠেনি। তাই এবার করলাম। তা ছাড়া তাঁরা আমাকে বললেন, এটা “প্রিন্স মাহমুদের সুরে” হবে। আমরা নব্বই দশকে যেমন আপনার গান পেয়েছি, ওইভাবে আপনাকে ছবিতে পরিচয় করাতে চাই।” গল্প ভালো লাগল। সুন্দর সুন্দর গান ব্যবহারের সুযোগ আছে। তাই রাজি হয়ে যাই। দুটো গানে সেই মায়া ছড়ানো আছে। ভালোলাগার সম্ভাবনা আছে।’
এ সিনেমার চারটি গান চার রকমের। সেগুলো ষাট-সত্তর দশক, আশি-নব্বই দশক, শূন্য দশক আর সমসাময়িক আবহে সুর ও সংগীতায়োজন করেছেন প্রিন্স মাহমুদ। তিনি বলেন, ‘এর আগে একটি সিনেমার সবগুলো গানের দায়িত্ব নিয়েছিলাম আমি। কিন্তু সেটা মুক্তি পায়নি। সে হিসেবে জংলি আমার প্রথম সিনেমা।’
আগের দুটি ছবিতে নতুনদের নিয়ে কাজ করে আলোচনায় থাকলেও ‘জংলি’তে একটু ভিন্নতা আনতে শিল্পী নির্বাচনে পরিবর্তন এনেছেন। এবার গেয়েছেন হাবিব, তাহসান, কনা, ইমরান, মাহতিম শাকিব, আতিয়া আনিশা এবং অবন্তী সিঁথি।
এরই মধ্যে এই ছবির ‘জনম জনম’ ও ‘বন্ধুগো শোনো’ শিরোনামের দুটি গান প্রকাশ পেয়েছে। পর্যায়ক্রমে বাকি দুটি গান প্রকাশ পাবে। গান দুটি প্রসঙ্গে প্রিন্স মাহমুদ বলেন, ‘তাহসান-আতিয়ার গাওয়া “জনম জনম” গানটি নতুন সময়ের গান। সিনেমার জন্য একদমই নতুন ধরনের। নিতে একটু সময় লাগবে। ভিডিওর কারণে শুরুতে একটু সমালোচনা হলেও গানটি মানুষ শুনছেন। আমি বিশ্বাস করি, একটা সময় গিয়ে আমার অনেক গানের মতো শ্রোতার মনের ভেতরের গান হয়ে যাবে এটি। আর “বন্ধুগো শোনো” গানটি আশি-নব্বই দশকের আবহে তৈরি।’
চাঁদরাত মানেই প্রিন্স মাহমুদ
তিন দশক ধরে চাঁদরাত মানেই প্রিন্স মাহমুদের নতুন গান। এবারও সেই ধারাবাহিকতার ছন্দপতন ঘটছে না। তিনি বলেন, ‘এবারও চাঁদরাতে গান আসবে। সেটাও জংলি সিনেমার। এর মধ্যে বাবা-বাচ্চাকে নিয়ে “মায়াপাখি” নামে একটি গান করেছি। এটি ষাট-সত্তর দশকের আবহের গান। মাহতিম সাকিব গেয়েছেন। অবন্তী সিঁথিও আলাদাভাবে গেয়েছে। বাবা-মা তাঁর বাচ্চাকে বুকে জড়িয়ে যেন গানটি গাইতে পারেন, সেভাবেই তৈরি করেছি। হাবিবের জন্যও ভীষণ মায়াময় গান করেছি। চাঁদরাতে প্রকাশ পেতে পারে এটি।’
এত বছর ধরে চাঁদরাতে গান প্রকাশ পাওয়া ক্যারিয়ারের অন্যতম বড় অর্জন বলে মনে করেন প্রিন্স মাহমুদ। নতুন উদ্যমে সময়ের সঙ্গে পথ চলে নিজস্বতা বজায় রেখেছেন বলেই এটা সম্ভব হয়েছে বলে বিশ্বাস তাঁর।
অ্যালবাম বনাম সিনেমার গান
প্রিন্স মাহমুদের কাছে প্রশ্ন ছিল অ্যালবাম নাকি সিনেমার গান—কোনটি করা কঠিন? কোনো রাখঢাক না রেখে সরল উত্তরে বললেন, ‘অ্যালবামের গান একটু কঠিন হয়, এটা সত্যি কথা। সিনেমায় কিছুটা সহজ। আবার এত সহজও নয়। আমি যেভাবে কাজ করি, যদিও সেটা সহজ হচ্ছে না আমার জন্য। সে কারণে সময়ও লাগছে।’ তবে সময় লাগলেও ছাড় দিতে মোটেই রাজি নন এই সুরকার। কারণ, চেনা পৃথিবীর ক্লিশে তাঁকে গ্রাস করে না।
প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম
নব্বই দশক থেকে শুরু করে ও বর্তমান প্রজন্মের শিল্পীরাও প্রিন্স মাহমুদের সুরে গান গেয়েছেন। খ্যাতি পেয়েছেন। কাজের অভিজ্ঞতার ক্ষেত্রে তাঁদের মধ্যে পার্থক্য সম্পর্কিত প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘পার্থক্য তো একটু থাকে। কিন্তু আমার বেলায় সে রকম বোধ করছি না। আমি তো আমার মতো করে কাজ করি। এ প্রজন্মের যাঁদের সঙ্গে কাজ করছি, তাঁরা প্রত্যেকে প্রতিভাবান। চমৎকার গাইতে পারেন।’ অনেকে বলে থাকেন, বর্তমানে মিউজিক ইন্ডাস্ট্রি অতীত জৌলুশ হারিয়েছে। তবে প্রিন্স মাহমুদ তাঁদের দলে নন। তাঁর বিশ্বাস, ভালো অবস্থানেই আছে বাংলা গান।
নতুন মিক্সড অ্যালবাম
ক্যাসেট বা সিডির জমানা এখন নেই। তাই বলে মিক্সড অ্যালবাম তো আর থেমে থাকতে পারে না। অনলাইন স্ট্রিমিংয়ের জন্য মিক্সড অ্যালবামের কাজও শুরু করে দিয়েছেন প্রিন্স মাহমুদ। তিনি বলেন, ‘ব্যান্ড শিল্পীদের নিয়ে মিক্সড অ্যালবামের কাজ শুরু করেছি। দুটি গান শেষ হয়েছে। ভালো ভালো সব গান থাকবে সেখানে।’ এ নিয়ে এর বেশি কিছু বলতে চাইলেন না তিনি। তবে জানিয়ে রাখলেন বড় পরিসরে আসবে সেটি।