প্রিন্স মাহমুদ কেন আলাদা

আজ প্রিন্স মাহমুদের জন্মদিনকোলাজ

নব্বইয়ের দশকের সংগীত অনুরাগীদের ভালোবাসার নাম প্রিন্স মাহমুদ। তাঁর সুরে বুঁদ ভক্ত-শ্রোতারা। নব্বইয়ের দশক কেন, আজকের এই দিন, এই সময় পর্যন্ত তিনি সমান জনপ্রিয়। আইয়ুব বাচ্চুর কণ্ঠে ‘বেলাশেষে ফিরে এসে’; জেমসের ‘মা’, ‘বাবা’, ‘বাংলাদেশ’; হাসানের ‘এত কষ্ট কেন ভালোবাসায়’, ‘এত দিন পরে প্রশ্ন জাগে’সহ বহু কালজয়ী গানের স্রষ্টা প্রিন্স। ক্যাসেট-যুগ থেকে হালের ইউটিউব—সব যুগেই সমান প্রাসঙ্গিক এই সুরকার। ব্যবসায়িকভাবে প্রায় সব গানই ছিল সফল। আর প্রতিটি অ্যালবামের কোনো না কোনো গান মানুষের হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছে সার্থকভাবে। আজ এই গীতিকবি ও সুরস্রষ্টার জন্মদিন।
সুরকার বা গীতিকবি নয়, খুলনা থেকে প্রিন্স মাহমুদের শুরুটা ছিল অন্য রকম। ‘দ্য ব্লুজ’ ব্যান্ডের ভোকাল ও গিটারিস্ট ছিলেন প্রিন্স মাহমুদ। গত শতকের আশির দশকের কথা। ‘সে কেমন মেয়ে’ নামের একটি অ্যালবাম সেই সময়ে বেশ আলোচনায় ছিল।

গান প্রিন্স মাহমুদ নিজেই গেয়েছিলেন। সেই দলের আলোচিত একটি গান ছিল—‘রাজাকার আলবদর কিছুই রইব না রে/ উপরে দালাল ভিতরে চোর কিছুই হইব না রে/ সব রাজাকার ভাইসা যাইব বঙ্গোপসাগরে’। তবে নিজে বেশি দিন আর গান করেননি প্রিন্স। শিল্পীদের জন্য গান বাঁধতে শুরু করেন তিনি। নব্বইয়ের দশকের পর শূন্য দশক থেকে আজ পর্যন্ত নতুন সব শিল্পী তাঁর কথা ও সুরে গান করার জন্য উদ্‌গ্রীব থাকেন।

প্রিন্স মাহমুদ
কবির হোসেন

বছরের পর বছর আলোচিত বা সুপার হিট গান উপহার দিয়েছেন প্রিন্স মাহমুদ। এমনও হয়েছে জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পির চেয়েও প্রিন্স মাহমুদ—নামটির প্রতি বেশি আগ্রহ ছিল শ্রোতৃমহলে। প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানগুলোও তাঁকে মিশ্র অ্যালবামের দায়িত্ব দিয়ে নির্ভার থাকতেন, বাণিজ্য আসবেই! ‘মাটি হব মাটি’, ‘দুনিয়া তোর সঙ্গেতে নাই’, ‘ছিপ নৌকো’সহ বহু জনপ্রিয় গান রয়েছে প্রিন্সের।
‘মা’, ‘বাবা’, ‘জন্মদিন’, ‘বাংলাদেশ’, ‘এত কষ্ট কেন ভালোবাসায়’, ‘বেলাশেষে’, ‘সোনার মেয়ে’, ‘ফেরানো গেল না কিছুতেই’, ‘হয়নি যাবার বেলা’ ও ‘শেষ দেখা’। ব্যান্ডশিল্পীদের ছাড়াও করেছেন আধুনিক ও সলো শিল্পীদের গান।

‘এক মুঠো জোছনা’ নামে পুরো একটা অ্যালবাম করেছেন জনপ্রিয় শিল্পী কুমার বিশ্বজিতের। চলচ্চিত্রের গানের জনপ্রিয় শিল্পী এন্ড্রু কিশোরের জন্য করেছেন ‘গাঁয়েন’ নামে একক অ্যালবাম। এ ছাড়া করেছেন এন্ড্রু কিশোর ও আতিক হাসানকে নিয়ে ডুয়েট অ্যালবাম ‘পদ্ম পাতার জল’ ও ‘দুই দিনের মেলা’ নামে দুটি অ্যালবামসহ আরও অনেক সলো ও মিশ্র অ্যালবাম।

নব্বইয়ের শুরুতে তিনি গড়েন ‘ফ্রম ওয়েস্ট’ নামের একটি ব্যান্ড
সংগৃহীত

সীমিত শ্রোতা নয়, বরং শিল্পীদের কণ্ঠোপযোগী গানগুলো তৈরি করেছেন সব শ্রেণির শ্রোতা-ভক্তের জন্য। জেমসের ‘হতেও পারে এই গান শেষ গান’, হাসানের ‘এত কষ্ট কেন ভালবাসায়’, শাফিনের ‘প্রতিরাতই নির্ঘুম রাত’, খালিদের ‘আকাশনীল’, পার্থ বড়ুয়ার ‘সময় আর কাটে না’ কিংবা পপগুরু আজম খানের ‘জীবনের শেষ কটা দিন’ এখনো ইউটিউবে শোনেন নানা প্রজন্মের শ্রোতা। এখনো ‘দুচোখে বন্যা’, ‘দাগ থেকে যায়’, ‘স্রোত’, ‘দেয়াল’, ‘পিয়ানো’, ‘চিঠির উত্তর দিও’, ‘হারজিৎ’, ‘মেহেদিরাঙা হাত’সহ একের পর এক তুমুল জনপ্রিয় অ্যালবাম প্রকাশ করে প্রিন্স মাহমুদ নিজেকে নিয়ে গেলেন অন্য এক উচ্চতায়। শোনা যায়, তাঁর গান গেয়ে অনেক ব্যান্ডশিল্পী একক ক্যারিয়ার তৈরি হয়, পারিশ্রমিক একলাফে কয়েক গুণ বেড়ে যায়। প্রতিষ্ঠিত তারকা শিল্পীর বাইরে নতুন শিল্পীদেরও সুযোগ দিয়েছেন প্রিন্স মাহমুদ, নতুনদেরও সুপারহিট গান বেঁধেছেন তিনি।

প্রিন্স মাহমুদ
প্রথম আলো

প্রেম, বিরহ, ক্ষোভ, স্মৃতিচারণা, বিষয়ভিত্তিক, দেশাত্মবোধক থেকে শুরু করে ‘মা’ ও ‘বাবা’র মতো প্রত্যেক মানুষের প্রিয় মানুষ নিয়েও গান উপহার দিয়ে গেছেন প্রিন্স মাহমুদ। বাংলাদেশে তো বটেই, পশ্চিমবঙ্গেও গানে কাউকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাতে গেলে প্রথমেই মনে পড়ে প্রিন্স মাহমুদের লেখা ও সুর করা শাফিন আহমেদের কণ্ঠে ‘আজ জন্মদিন তোমার’ গানটি।

বছরের পর বছর আলোচিত বা সুপার হিট গান উপহার দিয়েছেন প্রিন্স মাহমুদ

প্রিয় ‘মা’ ও ‘বাবা’কে মনে পড়লে মনে পড়ে যায় জেমসের কণ্ঠের ‘মা’ ও ‘বাবা’ গান দুটি, যা প্রিন্স মাহমুদের।
নব্বইয়ের প্রজন্মের পাশাপাশি এ প্রজন্মের শ্রোতাদের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়েছেন প্রিন্স মাহমুদ। ক্যারিয়ারের বেশির ভাগ সময় ব্যান্ডের গান করলেও একটা সময় এসে চলচ্চিত্রের গানেও তাঁকে পাওয়া গেছে। ‘জিরো ডিগ্রি’, ‘থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বার’, ‘ভয়ংকর সুন্দর’সহ কিছু ছবির জন্য তিনি গান করেছেন।

বেশ কয়েক বছর বিরতির পর গেল বছর তিনি কাজ করেন হিমেল আশরাফ পরিচালিত ‘প্রিয়তমা’ সিনেমায়। এই সিনেমার ‘ঈশ্বর’ গানটি সব শ্রেণির শ্রোতার কাছে তাঁকে নতুন করে আলোচনায় এনেছে। সিনেমায় কাজ করছেন। চলতি বছরও ‘রাজকুমার’ সিনেমায় তাঁর ‘বরবাদ’ গানটি বেশ সাড়া ফেলেছে। রয়েছে আরও বেশ কিছু আলোচিত গান। মুক্তির অপেক্ষায় থাকা ‘জংলি’ সিনেমার সব কটি গান সুর করেছেন তিনি। তবে বরাবরের মতোই মানের ক্ষেত্রে আপসহীন প্রিন্স মাহমুদ বুঝেশুনে নতুন একাধিক ছবির কাজ শুরু করেছেন।

ব্যান্ডশিল্পীদের ছাড়াও করেছেন আধুনিক ও সলো শিল্পীদের গান
সংগৃহীত

এই অডিও বা সিনেমার আলোচ্য গানগুলো ছাড়া পাঠক-শ্রোতার কাছে নিশ্চয়ই প্রিন্সের আরও অনেক গানই প্রিয়। প্রিন্সের গানের প্রতি শ্রোতাদের ভালোবাসাই তাঁর সবচেয়ে বড় অর্জন। জাতীয়ভাবে পুরস্কার ও সম্মাননার চেয়ে জীবদ্দশায় বিপুল বাঙালি শ্রোতার হৃদয়ে জায়গা করে নেওয়া এক অভাবনীয় ঘটনা। প্রিন্স মাহমুদকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা।