আইয়ুব বাচ্চু নেই, এলআরবির অন্যরা কে কোথায়
বাংলাদেশের ব্যান্ড সংগীতে আইয়ুব বাচ্চু আবেগ ও ভালোবাসার একটি নাম। আইয়ুব বাচ্চু ও তাঁর স্বপ্নের ব্যান্ড এলআরবি দীর্ঘ সময় পাশাপাশি চলেছে। হয়ে ওঠে একে অপরের সমার্থক শব্দ। দেশ–বিদেশের মঞ্চ এলআরবি নিয়ে মাতিয়েছেন তিনি। আইয়ুব বাচ্চু গিটারের বাদনে মোহাবিষ্ট রাখতেন মঞ্চের সামনে থাকা শ্রোতাদের। মৃত্যুর ছয় বছর পার হতে চললেও গিটার জাদুকর আজও তাঁর কথা–সুরের মায়াজালে আগলে রেখেছেন অগণিত গানপ্রেমীকে। ব্যান্ডের গান আজও শ্রোতাদের মায়ার জালে আটকে রাখলেও রাখতে পারেনি ব্যান্ডের সদস্যদের। আইয়ুব বাচ্চুকে হারিয়ে প্রত্যেক সদস্য যেন দলছুট। এলআরবির সবাই আজ যেন ছন্নছাড়া। কারও সঙ্গে কারও দেখাটাও ঠিকমতো হয় না। ব্যান্ডের ৩৩ বছরের প্রতিষ্ঠার দিনে সদস্যদের খোঁজখবর নিতে গেলে এমনটাই জানা গেল।
আজ আইয়ুব বাচ্চুর স্বপ্নের ব্যান্ড এলআরবির প্রতিষ্ঠার দিন। ৩৩ বছর আগের এই দিনে আইয়ুব বাচ্চুর হাত ধরে প্রতিষ্ঠা পায় দলটি। শুরুর দিকে আইয়ুব বাচ্চুর সহযাত্রী হয়ে কেউ যোগ দিয়েছিলেন।
এরপর একে একে আরও অনেকে যুক্ত হন। কেউ এক যুগ, এক দশক পর এসেও যোগ দেন। একটা পরিবার হয়ে পাড়ি দিয়েছেন অনেকটা পথ। আইয়ুব বাচ্চুকে ঘিরে গড়ে ওঠা ব্যান্ড দলটির সব কার্যক্রম থেমে যায় তাঁর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে। দলের সদস্যদের কারও সঙ্গে কারও এখন দেখা হয় না।
কে কোথায় আছেন, তা–ও কেউ জানেন না। অথচ একটা সময় ছিল, যখন দিনের বেশির ভাগ সময় তাঁদের একসঙ্গে কাটত। আড্ডায়, জ্যামিংয়ে মুখর থাকতেন সবাই। নতুন গান তৈরিতে মেতে থাকতেন। তাঁদের সবার মধ্যমণি হয়ে থাকতেন আইয়ুব বাচ্চু।
প্রতিষ্ঠার এই দিনে আইয়ুব বাচ্চুর সঙ্গে পথচলা শুরু করা এলআরবি সদস্য স্বপনের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। তাঁর ব্যবহৃত মুঠোফোন নম্বরটিতে পাওয়া না গেলে যোগাযোগ করা হয় ব্যান্ডটির ব্যবস্থাপক শামীম আহমেদের সঙ্গে। তিনি জানান, স্বপন এখন যুক্তরাষ্ট্রে থাকেন। তাঁর খোঁজখবর জানেন না অন্যরা।
কথা হয় এলআরবি সদস্য আবদুল্লাহ আল মাসুদের সঙ্গে। তিনি এই দলে যুক্ত হন ২০০৩ সালে। মৃত্যুর আগের দিন পর্যন্ত আইয়ুব বাচ্চুর সঙ্গেই ছিলেন। তিনি এখন সংগীত পরিচালক হিসেবে কাজ করছেন। অন্য শিল্পীদের জন্য গান বানাচ্ছেন। তিনি বললেন, ‘বস (আইয়ুব বাচ্চু) না থাকলে সবই মূল্যহীন। বেশ কিছুদিন যাবৎ কারও সঙ্গে কারও কোনো যোগাযোগ নাই। শুধু শামীম ভাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ আছে।
ভাবির সঙ্গে যোগোযোগ আছে। অদূরভবিষ্যতে বড় কিছু যদি হয়, তখন হয়তোবা রি–ইউনিয়ন টাইপ কিছু হলে আবার সবার দেখা হবে। তবে এর বাইরে ব্যান্ড নিয়ে সবার এক হওয়ার কোনো সুযোগ বা সম্ভাবনা কিছুই নাই।
সত্যি বলতে, এলআরবি তো বিশাল বড় জাহাজ। এই জাহাজকে টেনে নিয়ে যাওয়ার মতো সাধ্য কারও নাই। বিশাল মোটা রশি বেঁধে টানলেও যাবে না। এর চেয়ে বরং তিনি যেখানে রেখে গেছেন, ব্যান্ডটাকে সেখানেই থাকতে দেওয়া ভালো। তিনি একটা বেঞ্চমার্ক তৈরি করে গেছেন। এটাকে নষ্ট করার কোনো অধিকার আমাদের কারও নাই। হয়তো অনেক ব্যান্ডের উদাহরণ সামনে আসতেও পারে, কিন্তু এটাও ঠিক, প্রতিষ্ঠিত এসব ব্যান্ডের প্রধান মানুষটি ছাড়া সেই ক্রেজ সেভাবে কেউ ধরে রাখতে পারেনি।’
এদিকে দলটির কনিষ্ঠ সদস্য রোমেল যে মুঠোফোন নম্বরটি ব্যবহার করতেন, সেটিও বন্ধ। ১৯৯৫ সাল থেকে এলআরবিতে শব্দ প্রকৌশলী হিসেবে কাজ শুরু করেন শামীম আহমেদ। শেষ দিকে দলটির ম্যানেজারের দায়িত্বও তাঁর কাঁধে তুলে দেন আইয়ুব বাচ্চু। ২০১২ সালের দিকে শামীমকে ব্যান্ডের সদস্য হিসেবেও স্বীকৃতি দেওয়া হয়। এই মুহূর্তে শামীম আছেন যুক্তরাজ্যে। তিনি বললেন, ‘বাচ্চু ভাইয়ের ছেলে যদি কোনো একদিন ব্যান্ড চালুর কথা ভাবে, তাহলে হয়তো দেখা যাবে। এলআরবি নিয়ে অনেকে অনেকের মতো চিন্তা করেছে। হয়নি। সম্ভবও না। কিন্তু এটাও ঠিক, এখনকার প্রজন্ম যারা আছে, যারা বাচ্চু ভাইয়ের গান মঞ্চে গায়, তাদের মাধ্যমে তিনি প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে বেঁচে থাকবেন। তিনি যেসব সৃষ্টিকর্ম দিয়ে গেছেন, তা বিশাল একটা ইনস্টিটিউটসম। একজন গিটারিস্ট বা মিউজিশিয়ান বাচ্চু ভাইয়ের সৃষ্টিকর্ম নিয়ে জানাশোনার চেষ্টা করলে, সারা জীবন করে খেতে পারবেন। আর এভাবেই সবার মধ্যে এলআরবি ও আইয়ুব বাচ্চু বেঁচে থাকবেন।’
কথায় কথায় শামীম এ–ও বললেন, ‘আমরা না হয় চেষ্টা করলাম এলআরবি দাঁড় করাতে, কিন্তু ব্যান্ডের যে ইমেজ, তা যদি রাখতে না পারি, আর এটা তো স্বাভাবিকও। কারণ, আমি যাকে নিয়ে ভাবছি, তিনি এমন একজন কিংবদন্তি, যাঁর তো আসলে কোনো বিকল্প বা কাছাকাছি পর্যায়ে কাউকে পাওয়া দুষ্কর। তিনি একটা ব্র্যান্ড।
ঠিকমতো আমরা এই ব্র্যান্ড নিয়ে কাজ করতে না পারি, তাহলে তো হিতে বিপরীত। এর চেয়ে এলআরবির কাজ যেখানে শেষ হইছে, ওখানে রেখে দেওয়া উচিত। চালিয়ে নেওয়ার নামে নষ্ট করা উচিত না। এটা মোটেও সহজ কাজ না। অনেক ভক্ত প্রায়ই বলেও “আপনারা এলআরবি কেন করছেন না?” কিন্তু আমাদের প্রশ্ন হচ্ছে, কেমনে করব, কী নিয়ে করব, আমরা তো সহযোগী ছিলাম মাত্র। এটা তো সত্যিই অসম্ভব।’
এদিকে আইয়ুব বাচ্চুর অবর্তমানে এই ব্যান্ডের ভবিষ্যৎ কী হবে, তা নিয়ে পরিবারকেও একটা ধারণা দিয়ে গিয়েছিলেন আইয়ুব বাচ্চু। তাঁর কন্যা ফাইরুজ সাফরা প্রথম আলোকে এ বিষয়ে বলেছিলেন, ‘বাবা সব সময় বলতেন, “আমাকে ছাড়া এলআরবি চলবে না। আমার এই সম্পদের অধিকার শুধু তোমার আর তোমার ভাইয়ের।” বাবা একটা কথা সব সময় পরিষ্কার করে বলতেন, “আমি তোমাদের খুব গরিব বাবা। আমার অনেক সীমিত জিনিস। আমার সবচেয়ে বড় সম্পদ আমার ছেলে ও মেয়ে। জীবনে অনেক শ্রম দিয়ে তোমাদের লেখাপড়া করিয়েছি।” বাবার এই কথা আমি সব সময় মনে রেখেছি।’ তিনি প্রায়ই বলতেন, ‘আমি না থাকলে, আমার কোনো জিনিসকে কখনো উল্টাপাল্টা হতে দিবা না।’
আইয়ুব বাচ্চুর হাত ধরে ১৯৯১ সালের ৫ এপ্রিল চালু হওয়া ‘এলআরবি’ ব্যান্ড শুরুতে ইংরেজি গানের কভার করত। তারপর রক, সফট রক, হার্ড-রক, ব্লুজ, অল্টারনেটিভ রক, মেলোডি—এমন নানা ধাঁচের গানের সঙ্গে শ্রোতাদের পরিচয় করায়।
আইয়ুব বাচ্চু একাধারে এই ব্যান্ডের গায়ক, লিড গিটারিস্ট, গীতিকার ও সুরকার ছিলেন। তবে এই ব্যান্ডের প্রথম নাম ছিল ওয়াইআরবি-ইয়েলো রিভার ব্যান্ড। সে সময় একটি ক্লাবে পারফর্ম করার সময় সেখানকার উদ্যোক্তারা ভুল করে ব্যান্ডটির নাম লেখেন—লিটল রিভার ব্যান্ড। সেই ভুলটাই আইয়ুব বাচ্চুর পছন্দ হয়ে যাওয়ায় ব্যান্ডটি পরিচিতি পায় এলআরবি নামে। কিন্তু পরে জানা যায় যে এই একই নামে অস্ট্রেলিয়াতে আরেকটি ব্যান্ড রয়েছে। কিন্তু এলআরবি নামটি ইতিমধ্যে দেশ-বিদেশের শ্রোতাদের কাছে পরিচিত হয়ে ওঠায়, নামটি পরিবর্তন করতেও চাইছিলেন না ব্যান্ডের সদস্যরা। এমন অবস্থায় এল-আর-বি—এই তিন অক্ষর ঠিক রেখে এর ভেতরের শব্দ পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এরপর আইয়ুব বাচ্চু এলআরবির নাম রাখেন ‘লাভ রানস ব্লাইন্ড’। নতুন এই নামেই দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়েছে দলটি। এলআরবির প্রায় প্রতিটি অ্যালবাম সুপারহিট হওয়ায় রাতারাতি তারা জনপ্রিয়তার শীর্ষে উঠে যায়। প্রতিষ্ঠার শুরু থেকে ব্যান্ডের স্টুডিও অ্যালবামের সংখ্যা ১১। মিশ্র অ্যালবাম ৯টি। প্রতিষ্ঠার পরের বছরে প্রথম অ্যালবাম ‘এলআরবি ওয়ান’, ‘এলআরবি টু’ বাজারে আসে। এটাই ছিল বাংলাদেশের প্রথম ডাবল অ্যালবাম। পরবর্তী সময় ‘আমাদের’ ও ‘বিস্ময়’ নামের আরেকটি ডাবল অ্যালবাম বাজারে আসে। এলআরবির অন্য অ্যালবামগুলো হলো ‘সুখ’ (১৯৯৩), ‘তবুও’ (১৯৯৪), ‘ঘুমন্ত শহরে’ (১৯৯৫), ‘ফেরারি মন’ (১৯৯৬), ‘স্বপ্ন’ (১৯৯৬), ‘মন চাইলে মন পাবে’ (২০০০), ‘অচেনা জীবন’ (২০০৩), ‘মনে আছে নাকি নেই’ (২০০৫), ‘স্পর্শ’ (২০০৮) ও ‘যুদ্ধ’ (২০১২)।