কুমার বিশ্বজিৎকে সারপ্রাইজ দেওয়া একমাত্র সন্তান ১৫ মাস ধরে হাসপাতালের বিছানায়

কুমার বিশ্বজিৎ ও নিবিড় কুমার
ফাইল ছবি

কয়েক বছর ধরে একমাত্র ছেলে কুমার নিবিড়ের বেশি আগ্রহ সংগীতশিল্পী বাবার জন্মদিন ঘিরে। বাসায় কেক কাটার জন্য সময় চেয়ে নিতেন। সারপ্রাইজ দেওয়ার চেষ্টা করতেন। সন্ধ্যায় ঘুরতে বের হতে চাইতেন। আর বাবা কুমার বিশ্বজিৎও এ দিনটায় নিজের চাওয়ার চেয়ে সন্তানের চাওয়াকে প্রাধান্য দিতেন। কিন্তু এবারের জন্মদিনের চিত্রটা একেবারে ভিন্ন। ছেলে হাসপাতালের বিছানায় শয্যাশায়ী। একজন বাবা হিসেবে অনেক কষ্টের মধ্যে দিন পার করছেন। দেড় বছর ধরে বাবা কুমার বিশ্বজিতের একটাই চাওয়া, ছেলে ফিরে আসুক সুস্থ হয়ে।

নিজ বাড়িতে কুমার বিশ্বজিৎ
ছবি: সুমন ইউসুফ

আজ দেশের জনপ্রিয় সংগীতশিল্পী কুমার বিশ্বজিতের জন্মদিন। এই দিনে তিনি আছেন কানাডায়, সেখানকার একটি হাসপাতালে তাঁর একমাত্র সন্তান চিকিৎসাধীন। কুমার বিশ্বজিতের তাই মনটা ভীষণ খারাপ।

তাঁর মতে, ‘বাবার কাছে সন্তান সব কিছুর ওপরে। সন্তানের এমন অবস্থায় এখন গান গাইতে গেলেও কোনো আবেগ কাজ করে না। আবার আবেগ এলে চোখটা ভিজে আসে— একজন বাবা হিসেবে যা খুব কষ্টের। যে অবস্থায় দেড় বছর ধরে আছি, এটা মেনে নেওয়া ভীষণ কষ্টের।’

কথায় কথায় কুমার বিশ্বজিৎ জানান, ‘দিনরাত অপেক্ষায় আছি নিবিড় কখন কথা বলবে! সবাই নিবিড়ের জন্য দোয়া করবেন। এতকিছুর মধ্যে কিছু দিন আগে ঢাকায় গিয়ে গানে ফিরতে চেয়েছিলাম, কেমন লাগে গানে ফিরে সেটা বোঝার জন্য। কিন্তু এটা আমার কাছে ভালো থাকার বৃথা চেষ্টা মনে হচ্ছিল।’

কুমার বিশ্বজিৎ ও ছেলে নিবিড়

১৯৬৩ সালের ১ জুন চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে জন্মগ্রহণ করেন কুমার বিশ্বজিৎ। ছোটবেলা থেকেই তাঁর গানের প্রতি আগ্রহ ছিল। সেই আগ্রহকে সাধনার মাধ্যমে সংগীতজগতে নিজের শক্ত অবস্থান করে তোলেন। দেশ–বিদেশের গানপ্রেমীদের কাছে প্রিয় একটি নাম হয়ে ওঠেন। ১৯৭৭ সালে একটি রেডিও অনুষ্ঠানে প্রথম গান গাওয়ার মাধ্যমে সংগীতাঙ্গনে যাত্রা শুরু কুমার বিশ্বজিতের। এরপর ‘রিদম ৭৭’ নামে একটি ব্যান্ডে দুই বছর গান করেন। ১৯৭৯ সালে ‘ফিলিংস’ নামে আরেকটি ব্যান্ড গঠন করেন।

বাংলাদেশ টেলিভিশনে কুমার বিশ্বজিৎ প্রথম গান করেছিলেন ১৯৮০ সালের দিকে। তবে ১৯৮২ সালে ‘শিউলিমালা’ নামের একটি অনুষ্ঠানে ‘তোরে পুতুলের মতো করে সাজিয়ে’ গানটি গাইবার পর তাঁর জনপ্রিয়তা চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। এই গানটি তাঁর সংগীতজীবনের টার্নিং পয়েন্ট হয়ে ওঠে। তবে শ্রোতাদের নিজেকে আরও বেশি গ্রহণযোগ্য করে তোলেন ‘যেখানে সীমান্ত তোমার’ গান প্রকাশের পর।

কুমার বিশ্বজিৎ প্রথম প্লেব্যাক করেন ১৯৮২ সালে আলাউদ্দিন আলীর সুর ও সংগীতে ‘ইন্সপেক্টর’ সিনেমায়। তিনি দুইবার শ্রেষ্ঠ গায়ক হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন। ৩০টি একক অ্যালবাম, অসংখ্য মিশ্র অ্যালবাম ও সিনেমায় গানে প্লেব্যাক করেছেন।

কুমার বিশ্বজিৎ
ছবি : প্রথম আলো

শৈশবে জন্মদিন নিয়ে বেশ আগ্রহ ছিল কুমার বিশ্বজিতের। সেই সময় তিনি চাইতেন, এই বিশেষ দিনটি পাঁচ দিন পর পর আসুক। কারণ, এই দিনে তাঁর বায়না থাকত অন্য দিনের চেয়ে আলাদা। উপহার হিসেবে তিনি জামাকাপড় কিংবা কেক চাইতেন না। জন্মদিনের কয়েক দিন আগে থেকেই তিনি পরিবারের সদস্যদের কাছে বায়না ধরতেন, তাঁকে বাদ্যযন্ত্র উপহার দিতে হবে। শৈশবের সেই দিনগুলোতে উপহার হিসেবে পেয়েছেন ড্রামস, গিটার, বেজ গিটারসহ নানা কিছু। এই উপহারগুলো পেতে তিনি দিনের পর দিন অপেক্ষা করতেন।

জন্মদিনের এই উপহারগুলোর সঙ্গে জড়িয়ে আছে তাঁর অনেক স্মৃতি। কিছু উপহার তাঁর জীবন বদলে দিয়েছে। জন্মদিনের সেরা উপহার হিসেবে একবার তিনি একটি টেপ রেকর্ডার পেয়েছিলেন। তখন তিনি চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র। পরে সেই টেপ রেকর্ডার তাঁর ক্যারিয়ারে শিক্ষকের ভূমিকা পালন করেছিল।

এই সংগীতশিল্পী বলেন, ‘টেপ রেকর্ডারের প্রতি আমার সবচেয়ে বেশি আকর্ষণ ছিল। আমি তখন গান শুনতাম আর সুরগুলো রেকর্ড করতাম। অনেক সময় গান গেয়ে নিজের রেকর্ড করা কণ্ঠ শুনতাম। মূল শিল্পীর গায়কির সঙ্গে তুলনা করতাম। তাঁদের গান শুনে আমি সুর, তাল, লয় শিখতাম। তখন এত প্রযুক্তির অগ্রগতি হয়নি। এই টেপ রেকর্ডারই আমার ভুল ধরার জন্য শিক্ষকের মতো ছিল।’

স্ত্রী ও ছেলের সঙ্গে কুমার বিশ্বজিৎ

কয়েক বছর আগের কথা। বেশ চলছিল সব কিছু। ছেলে কানাডার একটি কলেজে ডিজিটাল মার্কেটিংয়ে পড়াশোনায় ব্যস্ত। বাবা উত্তরার বাড়িতে বসে একদিন একমাত্র ছেলেকে নিয়ে প্রথম আলোর প্রতিবেদকের সঙ্গে অনেক স্বপ্ন ও আশার কথা শুনিয়েছিলেন। কথাগুলো বলতে বলতে গর্বে বুক ভরে যাচ্ছিল তাঁর। জনপ্রিয় সংগীতশিল্পী বাবাও দেশ–বিদেশে গানে গানে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছিলেন। শ্রোতাদের মাতিয়ে চলছিলেন।

হঠাৎ একটি দুর্ঘটনা যেন মুহূর্তেই সব হিসাব–নিকাশ পাল্টে দেয়। কানাডায় ঘটে যাওয়া সেই দুর্ঘটনায় ছেলে কুমার নিবিড় মারাত্মকভাবে আহত হন। এর পর থেকে বাবা ডাক শোনা থেকে বঞ্চিত হন কুমার বিশ্বজিৎ। ১৫ মাস ধরে এমন অবস্থা চলছে। সন্তানের মুখে বাবা ডাক শোনার প্রহর গুনছেন দেশের জনপ্রিয় সংগীতশিল্পী বাবা কুমার বিশ্বজিৎ। আশায় বুক বেঁধেছেন বাবা। হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে থাকা নিবিড়কে এখন চেয়ারে বসানো যাচ্ছে। চোখ মেলে তাকিয়ে মা–বাবাকে দেখছেনও।

আজ সুস্থ থাকলে হয়তো বাবাকে সারপ্রাইজ দিতেন। হয়তো ঘুরতে বের হয়ে যেতেন বাবা–ছেলে কিংবা মা–বাবাকে নিয়ে। কিন্তু তা তো আর সম্ভব না। কারণ, কুমার বিশ্বজিৎকে সারপ্রাইজ দেওয়া একমাত্র ছেলে হাসপাতালের বিছানায় ১৫ মাস ধরে শয্যাশায়ী।

২০২৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি সড়ক দুর্ঘটনায় মারাত্মকভাবে আহত হন কুমার নিবিড়। তার পর থেকেই মা–বাবা দুজনের ঠিকানা সেই সেন্ট মাইকেল হাসপাতাল। ছেলের সর্বশেষ শারীরিক অবস্থা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে কুমার বিশ্বজিৎ বললেন, ‘শারীরিক অবস্থা কিছুটা উন্নতির দিকে। কিন্তু কবে যে পুরোপুরি সুস্থ হবে, তা বলা মুশকিল। এখনো হাসপাতালে থাকতে হচ্ছে।’