ঈদ এলেই বাজতে থাকে ‘স্বপ্ন যাবে বাড়ি’; গানটা কেন এত জনপ্রিয়?
‘স্বপ্ন যাবে বাড়ি’ প্রকাশের দেড় দশক পর আজও গানটির আবেদন ফুরায়নি। গানটির কথা ও সুরের মায়াজালে ঘরে ফেরার আকুলি–বিকুলি উঠে এসেছে। এবার ঈদের ছুটিতে ঘরমুখো মানুষের মধ্যে গানটি নিয়ে চর্চা চলছে।
‘গানটা যতবার শুনি, ততবার চোখে পানি চলে আসে। অনেক স্মৃতি ভেসে ওঠে চোখে।’ ‘স্বপ্ন যাবে বাড়ি’ গানটি নিয়ে ফেসবুকে লিখেছেন জিহাদ হাওলাদার নামে এক শ্রোতা। বিজ্ঞাপনচিত্রের ‘থিম সং’ থেকে দেশের মানুষের ঘরে ফেরার ‘থিম সং’–এ পরিণত হয়েছে গানটি।
২০০৯ সালে গ্রামীণফোনের একটি বিজ্ঞাপনের জন্য গানটি লেখেন গ্রামীণফোনের তৎকালীন কর্মকর্তা আনিকা মাহজাবিন। হাবির ওয়াহিদের সুর ও সংগীতায়োজনে গানটি কণ্ঠে তোলেন শিল্পী মিলন মাহমুদ।
কোনো বিজ্ঞাপনচিত্রের ‘থিম সং’ আলাদাভাবে গান হিসেবে পরিচিতি পাওয়ার নজির নেই বললেই চলে। ‘স্বপ্ন যাবে বাড়ি’ প্রকাশের দেড় দশক পর আজও গানটির আবেদন ফুরায়নি। গানটির কথা ও সুরের মায়াজালে ঘরে ফেরার আকুলি–বিকুলি উঠে এসেছে।
এবার ঈদের ছুটিতে ঘরমুখো মানুষের মধ্যে গানটি নিয়ে চর্চা চলছে, যাত্রাপথের ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট করে অনেকেই লিখছেন, ‘স্বপ্ন যাবে বাড়ি’। কেউ কেউ গানটি শেয়ার করে গানটি ঘিরে নিজের অনুভূতির কথা লিখছেন।
এবার ঈদের ছুটিতে ঘরমুখো মানুষের মধ্যে গানটি নিয়ে চর্চা চলছে, যাত্রাপথের ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট করে অনেকেই লিখছেন, ‘স্বপ্ন যাবে বাড়ি’। কেউ কেউ গানটি শেয়ার করে গানটি ঘিরে নিজের অনুভূতির কথা লিখছেন।
এই গান নিয়ে শ্রোতাদের উন্মাদনা আনিকা মাহজাবিনকেও ছুঁয়ে যায়। আজ মঙ্গলবার প্রথম আলোকে তিনি বলেন, নিজেদের সময়ের কথা ভেবে ভালো লাগে। কথার সঙ্গে সুর ও কণ্ঠের জন্য গানটাকে মানুষ ভালোবেসেছে।
দর্শক–শ্রোতাদের এই ভালোবাসা ছুঁয়ে যায় শিল্পী মিলন মাহমুদকে। ২০২৩ সালের এপ্রিলে প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘বিষয়টি নিঃসন্দেহে অনেক ভালো লাগার। একটা গান যুগ যুগ ধরে টিকে আছে, এটা অনেক আনন্দের বিষয়। গানের অংশ হিসেবে আমি শ্রোতাদের কাছে কৃতজ্ঞ।’
পরে ২০১৩ সালে প্রকাশিত মিলন মাহমুদের ‘গোপনে’ অ্যালবামে রাখা হয় আলোচিত গানটি।
বিষয়টি নিঃসন্দেহে অনেক ভালো লাগার। একটা গান যুগ যুগ ধরে টিকে আছে, এটা অনেক আনন্দের বিষয়।মিলন মাহমুদ
গানটি এতটা জনপ্রিয়তা পেল কেন
‘স্বপ্ন যাবে বাড়ি’ গানটি এতটা ছড়িয়ে পড়ল কেন কিংবা শ্রোতারা গানটিকে বছরের পর বছর ধরে গানটিকে জারি রেখেছেন কেন? এমন প্রশ্নের জবাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগীত বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সাইম রানা জানান, বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে কোনো গান বারবার বাজানো হলে তা মানুষের শ্রবণে গেঁথে যায়। এর দুটো দিক রয়েছে। গানটি ভালো মানের না হলে শ্রোতাদের মধ্যে বিরক্তি তৈরি করে আর গানটি হৃদয়গ্রাহী হলে তা অনেক বেশি আত্তীকরণের মধ্যে চলে আসে।
সাইম রানা জানান, সাধারণ মানুষ উঁচু স্বরে (হাই পিচ) গাওয়া গান পছন্দ করেন। ‘স্বপ্ন যাবে বাড়ি’ গানটিও উঁচু স্বরে গাওয়া, ফলে সাধারণ মানুষের কাছে গানটি জনপ্রিয়তা পেয়েছে।
তাঁর ভাষ্যে, ‘সাধারণত লোকসংগীতগুলো হাই পিচে গাওয়া হয়। গানটা লোকসংগীত নয়, তবে হাই পিচে করা। সাধারণ মানুষ হাই পিচ পছন্দ করে, গানের কম্পোজিশনটাও ভালো।’
বিজ্ঞাপনচিত্রে গানটি শোনার পাশাপাশি ভিডিও চিত্রও দেখেছেন দর্শকেরা; গানের দৃশ্যায়নও গানটির ছড়িয়ে পড়ায় ভূমিকা রেখেছে বলে মনে করেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত সংগীত পরিচালক সাইম রানা।
তাঁর ভাষ্যে, ‘মধ্যবিত্ত কিংবা নিম্নবিত্ত মানুষ রুটিরুজির প্রশ্নে মানুষ নগরজীবনে বসবাস করেন। তবে তাঁদের মনটা পড়ে থাকে গ্রামে। এই গানের দৃশ্যায়নে দেখা যায়, বাসে, ট্রেনে কিংবা নদীপথে মানুষ বাড়ি ফিরছেন। এর সঙ্গে শ্রোতারা নিজেদের মিল খুঁজে পান।’
মধ্যবিত্ত কিংবা নিম্নবিত্ত মানুষ রুটিরুজির প্রশ্নে মানুষ নগরজীবনে বসবাস করেন। তবে তাঁদের মনটা পড়ে থাকে গ্রামে। এই গানের দৃশ্যায়নে দেখা যায়, বাসে, ট্রেনে কিংবা নদীপথে মানুষ বাড়ি ফিরছেন। এর সঙ্গে শ্রোতারা নিজেদের মিল খুঁজে পান।সংগীত পরিচালক সাইম রানা
গানের গীতিকার আনিকা মাহজাবিন বলেন, ‘সংকটের মধ্যে আমরা শেকড়ের সংযোগটা খুঁজে ফিরি; ছোটবেলার নরম আবেগের মধ্যে গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকতে চাই।’
২০১১ সালে গ্রামীণফোন ছেড়েছেন আনিকা, এখন একটি আন্তর্জাতিক বেসরকারি সংস্থায় কাজ করছেন। এর আগে বন্ধু নিয়ে আরেকটা গান লিখেছিলেন তিনি, তবে গানটি প্রকাশ্যে আসেনি।
শিল্পী মিলন মাহমুদ বলেন, গানটি সবার আবেগকে একসুতায় বেঁধেছে। গানের কথাগুলোর মধ্যে শ্রোতারা নিজেদের খুঁজে পেয়েছেন। দেশ কিংবা বিদেশ থেকে মানুষ ঘুরেফিরে প্রিয়জনের কাছে ফেরেন, ফেরার এই আবেদন সর্বজনীন। গানের কথা ও সুরের আবেদন মিলিত হয়েছে; সে কারণেই শ্রোতারা এটিকে নিজের গান হিসেবে ধরে নিয়েছেন।
সংকটের মধ্যে আমরা শেকড়ের সংযোগটা খুঁজে ফিরি; ছোটবেলার নরম আবেগের মধ্যে গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকতে চাই।গীতিকার আনিকা মাহজাবিন
স্বপ্ন যাবে বাড়ি
২০০৯ সালের ঘটনা, ঈদের আর বেশিদিন নেই। সময় খুব কম ছিল; বাড়ি ফেরা নিয়ে একটা বিজ্ঞাপনচিত্র করতে হবে। সেই সময়ের গ্রামীণফোনের কর্মকর্তা আনিকা মাহজাবিন স্মৃতি হাতড়ে বলেন, ‘খন্দকার আশরাফুল হক সরোজ বললেন, কিছু একটা করতে হবে। আমি তখন লিখলাম, “স্বপ্ন যাবে বাড়ি, আমার পথ দেব পাড়ি, কাছে যাব ফিরে বারবার”।’
পরে গানটা হাবির ওয়াহিদকে সুর করতে দেওয়া হয়। হাবিবের ধানমন্ডির বাসার হোম স্টুডিওতে গিয়ে লিরিকটা পান মিলন মাহমুদ।
মিলন মাহমুদের ভাষ্যে, ‘সুরটা হওয়ার পর ও নিজে গাইছিল। আমি বললাম, তোমার কণ্ঠেই তো ভালো হচ্ছে। হাবিব বলল, “ভাই, আপনি খালি ভয়েসটা দিয়ে দেখেন, কী ঘটে দেখেন।” পরে ভয়েস দিলাম, এরপর পুরোপুরি অনুভূতিটা পাল্টে গেল।’
গানটা গ্রামীণফোনের খুব পছন্দ হয়। এটি নিয়ে প্রথম বিজ্ঞাপনচিত্র নির্মাণ করেন কিসলু গোলাম হায়দার, পরে গানের ভিডিও চিত্র বানান রম্য খান। রেলস্টেশনে, লঞ্চঘাটে গানটি দেখানো হয়েছিল। টেলিভিশনেও প্রচারিত হয়।
রাতারাতি গানটি তখন তুমুল জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল; মিলন মাহমুদ কোনো লাইভ শোতে গেলেই দর্শকেরা ‘স্বপ্ন যাবে বাড়ি’, ‘স্বপ্ন যাবে বাড়ি’ বলে চিৎকার করতেন। গানটি না গেয়ে মঞ্চ ছাড়তে পারতেন না তিনি।
গানটি নিয়ে হাবিব ওয়াহিদের বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
স্বপ্ন যাবে বাড়ি ২
মিলন মাহমুদের কণ্ঠে ‘স্বপ্ন যাবে বাড়ি’ প্রকাশের সাত বছর পর ২০১৬ সালে গ্রামীণফোনের ‘স্বপ্ন যাবে বাড়ি ২’ বিজ্ঞাপনের থিম সংয়ের সুর ও সংগীতায়োজন করেন হাবিব ওয়াহিদ। রাসেল মাহমুদের লেখা এই গানে কণ্ঠ দেন শিল্পী মিথুন চক্র। বিজ্ঞাপনটি প্রকাশের পর গানটি তুমুল আলোচিত হয়, গানটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।
২০২৩ সালের এপ্রিলে মিঠুন চক্র প্রথম আলোকে বলেন, গানটি নিয়ে খুব আলোচনা হলেও অনেকেই জানেন না গলাটা কার। অনেকে মনে করেন, হাবিব ওয়াহিদের কিংবা মিলন মাহমুদের। ‘স্বপ্ন যাবে বাড়ি ২’ গানের গলা যে মিঠুন চক্রের সেটা জানেন না।
আসলে দুই গানের শিরোনাম একই হলেও কথা পুরোটাই আলাদা, লিখেছেনও ভিন্ন দুই গীতিকার। তবে দুই গানের সুরে খানিকটা মিল থাকায় ধন্দে পড়তে হয়েছে দর্শকদের।
২০২২ সাল থেকে নিয়মিত এই গান নিয়ে বিজ্ঞাপনচিত্র করছে গ্রামীণফোন। এবার ঈদেও মিঠুন চক্রের কণ্ঠের গান নিয়ে বিজ্ঞাপন করা হয়েছে। বিজ্ঞাপনটি নির্মাণ করেছেন শাহরিয়ার পলক।
গীতিকার রাসেল মাহমুদ ‘দামাল’, ‘সুড়ঙ্গ’, ‘ইউটিউমার’, ‘তুফান’ সিনেমার গান লিখেছেন। ‘সাদা সাদা কালা কালা’, ‘মুড়ির টিন’, ‘টাকা পাখি’সহ বেশ কয়েকটি আলোচিত গানের রিদম অ্যারেঞ্জমেন্ট করেছেন মিঠুন।