ফুলে ফুলে ভরে গেল কবির সমাধি
‘ঘুমিয়ে গেছে শ্রান্ত হয়ে আমার গানের বুলবুলি, করুণ চোখে চেয়ে আছে সাঁঝের ঝরা ফুলগুলি...’। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে এ গানটির পরিবেশনা দিয়ে কবিকে স্মরণ করেছেন নজরুলসংগীতের বিশিষ্ট শিল্পী সুজিত মোস্তফা। আজ মঙ্গলবার গানে আর বাণীতে নজরুলময় ফেসবুক। আর সকালে কবির সমাধি ভরে গেছে ফুলে ফুলে।
বাংলাদেশের মাটিতেই তাঁর অনেক মহান সৃষ্টি। জীবনের শেষ দিনগুলো এ দেশেই ছিলেন জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। এ দেশের মানুষও ভালোবেসে তাঁকে আপন করে নেয়। এই প্রিয় কবিকে আজ সকাল থেকে স্মরণ করছে অনুরাগীরা। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের সাম্য, মানবতাবোধ ও অসাম্প্রদায়িকতাবোধের চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে সমাজ প্রতিষ্ঠার আহ্বান নিয়ে পালিত হচ্ছে তাঁর ৪৩তম মৃত্যুবার্ষিকী।
আজ ভোরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে জাতীয় কবির সমাধিসৌধে শ্রদ্ধা নিবেদনের মধ্য দিয়ে তাঁর ৪৩তম মৃত্যুবার্ষিকীর কর্মসূচির সূচনা হয়। শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মো. আখতারুজ্জামান জাতীয় কবি নজরুলের অসাম্প্রদায়িকতা, সাম্য, ভালোবাসা ও সম্প্রীতির প্রতীক মন্তব্য করে বলেন, ‘এই মূল্যবোধগুলোর বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল কবির সাহিত্যকর্মের মধ্যে, যা আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় অসাধারণ অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছিল।’ তিনি আরও বলেন, ‘এ বিষয়টি অনুধাবন করেই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কবি নজরুলকে কলকাতা থেকে ঢাকায় ফিরিয়ে এনেছিলেন।’
জাতীয় অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম জানান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন ইনস্টিটিউটে নজরুলকে নিয়ে গবেষণা হচ্ছে। জাতীয় কবির সাহিত্যকর্ম বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত করে বিশ্বময় ছড়িয়ে দেওয়ার আহ্বান জানান তিনি। তাতে সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মান্ধতা ও হানাহানি থেকে বিশ্ব মুক্তি পাবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
এ সময় উপস্থিত ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক মুহাম্মাদ সামাদ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক এ এস এম মাকসুদ কামাল।
আওয়ামী লীগের পক্ষে শ্রদ্ধা জানাতে এসেছিলেন দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রহমান, সাংগঠনিক সম্পাদক এ কে এম এনামুল হক শামীম, দপ্তর সম্পাদক আবদুস সোবহান গোলাপ, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সম্পাদক আবদুস সবুর, উপদপ্তর সম্পাদক বিপ্লব বড়ুয়া প্রমুখ।
শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন অসাম্প্রদায়িক চেতনার মানবতাবাদী। তাঁর প্রতিটি লেখায় প্রতিবাদী কণ্ঠ, তাঁর প্রতিটি লেখা অসাম্প্রদায়িক চেতনার। আমরা আজ শপথ করব, আমরা সাম্প্রদায়িক শক্তিকে পরাজিত করে কবির স্বপ্নের অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ব।’
আওয়ামী লীগের পর কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগসহ দলের সহযোগী সংগঠনের নেতা–কর্মীরাও জাতীয় কবির সমাধিতে ফুলেল শ্রদ্ধা জানান।
বিএনপির পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে দলের যুগ্ম মহাসচিব খায়রুল কবির খোকন বলেন, ‘জাতীয় কবির মৃত্যুবার্ষিকীতে আমাদের গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের শপথ নিতে হবে। জাতীয় কবি আমাদের যে বিদ্রোহ শিখিয়েছেন, সেই বিদ্রোহে অনুপ্রাণিত হয়ে আমরা আমাদের নেত্রীকে মুক্ত করব।’
সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর, বাংলা একাডেমি, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি, নজরুলসংগীত শিল্পী পরিষদ, জাতীয় কবিতা পরিষদ, বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোট, বঙ্গবন্ধু লেখক পরিষদ, নজরুল চর্চা কেন্দ্র বাঁশরী, বাসদসহ বিভিন্ন সংগঠনের প্রতিনিধিরা সকালে কবির সমাধিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান।
‘নজরুল প্রয়াণ দিবস’ উপলক্ষে নজরুল ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে কুমিল্লা নজরুল ইনস্টিটিউটের কেন্দ্রে আলোচনা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। আজ বিকেল চারটায় বাংলা একাডেমির কবি শামসুর রাহমান সেমিনার কক্ষে একক বক্তৃতা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। ‘নজরুলের বিদ্রোহ: রাজনীতি, অর্থনীতি ও ধর্মে’ শীর্ষক বক্তব্য দেবেন অধ্যাপক মোহিত উল আলম। সভাপতিত্ব করবেন বাংলা একাডেমির সভাপতি জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান।
১৯৭৬ সালের এই দিনে (১৩৮৩ বঙ্গাব্দের ১২ ভাদ্র) ঢাকায় তদানীন্তন পিজি হাসপাতালে (বর্তমানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়) শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন বাংলা কবিতার বিদ্রোহী ও গানের বুলবুল আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম।
জাতীয় কবির চেতনা ও আদর্শ চিরভাস্বর হয়ে আছে আমাদের জীবনে। দারিদ্র্যের কশাঘাতে জর্জরিত হয়েও তিনি কখনো আপস করেননি। মাথানত করেননি লোভ, লালসা, খ্যাতি, অর্থবিত্তের বৈভবের কাছে। ‘চির উন্নত মম শীর’ বলে আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন শোষিত–বঞ্চিত মানুষের মুক্তির জন্য। মানবতার মুক্তির পাশাপাশি সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মান্ধতা, কুসংস্কার, কূপমণ্ডূকতার বিরুদ্ধেও ছিলেন সোচ্চার। মুক্তবুদ্ধি ও চিন্তার পক্ষে কলম ধরেছেন নির্ভীক চিত্তে। তাঁর রচিত ‘চল চল চল’ গানটি আমাদের রণসংগীত।
উপমহাদেশের স্বাধীনতা ও নবজাগরণের অন্যতম অগ্রনায়ক কাজী নজরুল ইসলামের জন্ম ১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ জ্যৈষ্ঠ (১৮৯৯ খ্রিষ্টাব্দের ১৪ মে) পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার চুরুলিয়া গ্রামে। বাবা কাজী ফকির আহমেদ, মা জাহেদা খাতুন। ১৯৭২ সালের ২৪ মে তৎকালীন সরকার তাঁকে জাতীয় কবির মর্যাদা দিয়ে সপরিবারে ভারত থেকে বাংলাদেশে নিয়ে আসেন। ১৯৭৬ সালে তাঁকে একুশে পদকে ভূষিত করা হয়।