তাঁর গান শুনে বেড়ে উঠেছি...
চলে গেলেন বরেণ্য সংগীতশিল্পী পাপিয়া সারোয়ার। আজ বৃহস্পতিবার সকাল আটটায় রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে তিনি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। তার আগে কয়েক দিন ধরেই তিনি হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। গতকাল বুধবার শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে তাঁকে ভেন্টিলেশনে রাখা হয়। আজ সকালে ভেন্টিলেশন সাপোর্ট খুলে দেওয়া হয়। পাপিয়া সারোয়ারের মরদেহ বেলা ১টায় ধানমন্ডি ২৮ নম্বরের বাসায় নেওয়া হয়। আজ রাতে বারডেমের হিমঘরে রাখা হবে। কাল জুমার পর জানাজা শেষে বনানী কবরস্থানে দাফন করা হবে।
শিল্পী প্রসঙ্গে পাপিয়া সারোয়ারের দীর্ঘদিনের সহকর্মী ও অনুজেরা শিল্পী ও মানুষ হিসেবে কেন তিনি আলাদা ছিলেন, সেই বিষয়ে কথা বলেছেন। সংগীতশিল্পী অদিতি মহসিনের ভাষ্যে, ‘শিল্পী পাপিয়া সারোয়ারকে মূল্যায়ন করবার ধৃষ্টতা আমার নেই। তবে শ্রোতা হিসেবে বলব, পাপিয়া সারোয়ার একজন অসাধারণ শিল্পী ছিলেন। আমরা তো খুব ছোটবেলা থেকে তাঁর গান শুনে বেড়ে উঠেছি; সেই “ফুলে ফুলে ঢলে ঢলে...”, “হৃদয়ের একূল–ওকূল দুকূল ভেসে যায়...” বা “আমি হৃদয়ের কথা বলিতে ব্যাকুল...”। এ ছাড়া তো আধুনিক গান গেয়েছেন—“নাই টেলিফোন, নাইরে পিয়ন...”, “পাপিয়ারে পাপিয়া আয়না গাহিয়া...” সবকটি গান ভীষণ জনপ্রিয় হয়েছিল। আমরা ছোটবেলা থেকে টেলিভিশনের পর্দায় তাঁকে দেখে দেখে বড় হয়েছি। তাঁর কণ্ঠশৈলীটা ছিল একদম ভিন্ন, সবার থেকে আলাদা। গায়কিও ছিল একেবারে তাঁর নিজের মতো। তাঁর গাওয়া গান কারও সঙ্গে মেলে না।
এসব দিক থেকে তিনি অসাধারণ শিল্পী। মানুষ হিসেবে বলতেই হয়, তিনি অত্যন্ত অমায়িক, ভ্রদ্র, নম্র, নিরীহ ধরনের মানুষ ছিলেন। তাঁকে কখনো কোনো শিল্পীর সম্পর্কে কোনো কুৎসা বা খারাপ মন্তব্য করতে শুনিনি, দেখিনি। পাপিয়া আপা আমাদের সব সময় এত স্নেহের চোখে দেখেছেন! ছোটদের মধ্যে যাঁরা ভালো গাইতেন, তাঁদের উৎসাহ দিতেন। কাজেই মানুষ হিসেবেও তিনি অন্য ধরনের ছিলেন, তাঁর মধ্যে কোনো অহংকার, কী বলব... এখন তো অনেক রকম কিছু দেখতে পাই; কিন্তু তাঁরা বাংলাদেশের সেই প্রথম প্রজন্মের শিল্পী, তাঁরা এত সাধারণ জীবনযাপন করেছেন, তাঁদের শিল্পজীবন এমন সুন্দর করে বহন করেছেন, সেটা সত্যিই একটা দৃষ্টান্তের মতো।
‘পাপিয়া সারোয়ার শুধু রবীন্দ্রসংগীতে নয়, শিল্পী হিসেবেও তিনি একটু আলাদা ছিলেন। আমি আগেই বলেছি, তাঁরা বাংলাদেশের প্রথম প্রজন্মের শিল্পী, সেই সময়ে তিনি রবীন্দ্রসংগীত শিখবার জন্য শান্তিনিকেতনে গিয়েছেন। সম্ভবত ১৯৭২ সালে।
ফিরে এসে নিয়মিত সংগীতচর্চা করেছেন। সব শিল্পীর মধ্যে পাপিয়া সারোয়ার কিন্তু নিজেকে স্বতন্ত্র শিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। শুধু রবীন্দ্রসংগীত বলব না, তাঁর একটা নিজস্বতা ছিল। তিনি যখন আধুনিক গানটাও গাইতেন, তাঁর নিজের মতো করে গেয়েছেন। তাঁর কণ্ঠ, গায়কি, ব্যক্তিত্ব—সব মিলিয়ে তিনি কিন্তু অনন্য ছিলেন। আমাদের সেই সময়ে, দেশ তো স্বাধীন হয়েছে ৫৩ বছর হয়ে গেছে, সে সময় আমাদের যে শ্রোতারা ছিলেন, তাঁদের যে ভক্তরা—তাদের মনন, রুচি, রুচি তৈরি করার ক্ষেত্রে এই শিল্পীরা, তার মধ্যে পাপিয়া সারোয়ার একজন অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। যত দিন গান গেয়ে গেছেন, তত দিন নিজেকে সুন্দরভাবে, সম্মানের সঙ্গে, ভালোবাসার সঙ্গে, সে গান চর্চা করে গেছেন। নিজে স্কুল করে গেছেন। ছাত্রছাত্রী তৈরি করেছিলেন, নিজেকে সব সময়... ওই যে কথা বারবার বলতে ইচ্ছে করে—পাপিয়া আপা নিজেকে কখনো জাহির করেননি, নিজের গুণগান প্রচার করেননি, প্রসার করবার চেষ্টা তাঁর মধ্যে দেখিনি। গানের প্রতি একটা নিবিষ্টতা ছিল, সেভাবেই গান করে গেছেন। সে জন্য আমার মনে হয় যে পাপিয়া সারোয়ারদের মতো শিল্পীরা, অন্তত যাঁরা রবীন্দ্রনাথের ভক্ত, যাঁরা রবীন্দ্রনাথের গান শিখে আসছেন, অন্তত তাঁদের কাছে এদের স্থান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।’