পরীমনি–নূরের কাঁধে চড়ে রোমাঞ্চকর এক যাত্রা
বরিশালের স্বরূপকাঠিতে একটি মুদিদোকান চালায় প্রদীপ। ঘরে অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী সুপ্তি। কিছুদিন পরই সন্তান হবে। স্ত্রীর যত্নের কোনো কমতি রাখে না প্রদীপ। প্রায় দিনই দুপুরে দোকান ফেলে ঘরে চলে আসে। সুপ্তির সঙ্গে একসঙ্গে বসে ভাত খায়। প্রদীপের এই সহজ–সাধারণ জীবনের পেছনে রয়েছে অন্ধকার অতীতের এক জগৎ! এর থেকে সে কি মুক্তি পায়?
একনজরে
সিরিজ: রঙিলা কিতাব
স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্ম: হইচই
জনরা: ক্রাইম, ড্রামা
পরিচালক: অনম বিশ্বাস
উপন্যাস: কিঙ্কর আহসান
অভিনয়: মোস্তাফিজুর নূর ইমরান, পরীমনি, ফজলুর রহমান বাবু, ইরেশ যাকের, মনোজ প্রামাণিক
এদিকে হঠাৎ করে এলাকার এমপি সাজু খুন হয়। নদীতে ভেসে ওঠে তার মাথাকাটা লাশ। সাজুকে যারা এ শহরের এমপি বানায় তারাই কি দায়ী এ খুনের পেছনে? কিন্তু সাজু যেখানে খুন হয়, সেখানে সেদিন প্রদীপও ছিল ঘটনাস্থলে প্রদীপের মুঠোফোনও পাওয়া যায়। প্রদীপ সেদিন কেন গিয়েছিল সেখানে? আর সাজুই–বা কেমন করে খুন হলো? খুনের দায় মাথায় নিয়ে শুরু হয় প্রদীপ আর সুপ্তির নতুন জীবন। যে জীবনের পদে পদে বিপদ ওত পেতে থাকে। একের পর এক ষড়যন্ত্রের শিকার হতে থাকে তারা। নির্ঘাত মৃত্যু, নয়তো পুলিশের হাতে ধরা দেওয়া—এটাই যেন নিয়তি! প্রদীপ আর সুপ্তি কি পারে পালিয়ে বেড়াতে? নাকি রাজনীতির মারপ্যাঁচে অন্য কোনো পরিণতি বরণ করতে হয় তাদের?
রক্তে রাঙা টান টান উত্তেজনার এই প্রেমের গল্পই ‘রঙিলা কিতাব’। ওটিটি প্ল্যাটফর্ম হইচইতে মুক্তি পেয়েছে ৮ নভেম্বর। আট পর্বের ওয়েব সিরিজটি পরিচালনা করেছেন অনম বিশ্বাস। কিঙ্কর আহসানের উপন্যাস ‘রঙিলা কিতাব’ অবলম্বনে নির্মিত হয়েছে সিরিজটি।
এর আগে হুমায়ূন আহমেদের ‘দেবী’ উপন্যাসের চলচ্চিত্র বানিয়ে বিপুল প্রশংসিত হয়েছিলেন এ নির্মাতা। আলোচিত সিনেমা ‘আয়ানাবাজি’রও চিত্রনাট্যকার ছিলেন তিনি। ওটিটি প্ল্যাটফর্ম চরকিতে তাঁর ‘দুই দিনের দুনিয়া’ও প্রশংসিত হয়। নতুন সিরিজ দিয়ে কি নামের প্রতি সুবিচার করতে পারলেন নির্মাতা?
‘রঙিলা কিতাব’ সিরিজের প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেছেন মোস্তাফিজুর নূর ইমরান ও পরীমনি। মোস্তাফিজুর নূর ইমরান তাঁর দুর্দান্ত অভিনয় দিয়ে ইতিমধ্যে নজর কেড়েছেন। তবে ‘রঙিলা কিতাব’-এ তাঁকে দেখা যায় একেবারেই ভিন্নভাবে। ‘মহানগর’ বা ‘কাইজার’-এর সেই মোস্তাফিজুর নূর খোলনলচে বদলে হাজির হয়েছেন। ভরপুর অ্যাকশন দৃশ্যের এ সিরিজে তিনি ছিলেন সাবলীল। খুব সাধারণ চেহারার এক ছা-পোষা লোক থেকে তিনি যেভাবে মারিয়া এক খুনি হয়ে ওঠেন, তা সত্যিই প্রশংসার দাবিদার।
অথচ গল্পের চরিত্রের আড়ালে যে অসহায়ত্ব কাজ করছিল, সেটাও তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন খুব সুন্দরভাবে। প্রদীপের চরিত্রের সঙ্গে তিনি এতটাই মানিয়ে গিয়েছিলেন যে দর্শক যেন অপেক্ষা করে থাকেন কখন প্রদীপের বিপদ কাটবে, কখন শেষ হবে তার এ সংগ্রাম। অ্যাকশন, স্ত্রীর সঙ্গে রসায়ন থেকে আবেগ আর অসহায়ত্বের দৃশ্যগুলোতে তাঁর এক্সপ্রেশন অনেক দিন মনে রাখবেন দর্শক।
মোস্তাফিজুর নূর ইমরানের চরিত্রকে পূর্ণতা দিয়েছেন পরীমনি। পর্দায় তাঁদের সম্পর্কের রসায়ন বেশ উপভোগ্য ছিল। পরীমনি নিজের গ্ল্যামারার্স লুকের বাইরে গিয়ে সংগ্রামমুখর চরিত্রে ভালো অভিনয় করেছেন। সন্তান পুণ্য হওয়ার পর এটিই তাঁর মুক্তি পাওয়া প্রথম কাজ। আর সে কারণেই হয়তো অন্তঃসত্ত্বা সুপ্তির সংগ্রামকে তিনি আপন করে তুলে ধরেছেন। এ চরিত্রে অভিনয়ের জন্য তিনি ওজনও বাড়ান।
এ ছাড়া গ্রামের প্রভাবশালী ব্যক্তির চরিত্রে ফজলুর রহমান বাবু তাঁর স্বভাবজাত অভিনয়টাই করেছেন। তবে ব্যাপারীর চরিত্রে খোলস ভেঙে দুর্দান্ত অভিনয় করেছেন ইরেশ যাকের। মনোজ প্রামাণিকও চরিত্রের সঙ্গে মানানসই অভিনয় করেছেন।
প্রদীপের দোকানের সহকারীর চরিত্রে শিশুশিল্পীও ভালো অভিনয় করেছে। পর্দায় স্বল্প সময়ের উপস্থিতি হলেও নজর কেড়েছে।
‘রঙিলা কিতাব’–এর সবচেয়ে বড় ইউএসপির বাস্তবধর্মী উপস্থাপন। নির্মাতা স্থান নির্বাচন, চরিত্র নির্মাণ, চিত্রগ্রহণ, সাসপেন্স ধরে রাখা—এই সবকিছু সুন্দরভাবে উপস্থাপন করেছেন। কাহিনির বাঁকে বাঁকে রাজনৈতিক উত্তেজনা আর একের পর এক ষড়যন্ত্র দর্শককে স্ক্রিনের সঙ্গে আটকে রাখে। যদিও কিছু জায়গায় দৃশ্য অনেক দীর্ঘ ছিল। কয়েকটি চরিত্র আরেকটু বিকশিত হওয়ার সুযোগ দিলে ভালো হতো।
এই সিরিজের আরেকটি বড় বিষয় হলো অ্যাকশন। দেশি সিরিজে সেভাবে অ্যাকশন দেখা যায় না। অল্প বাজেটে সেটা করার সময়-সুযোগও সেভাবে থাকে না। তবে এই সিরিজে চ্যালেঞ্জ নিয়ে ভালোভাবেই উতরে গেছে। সবচেয়ে বড় কথা, সিরিজের অ্যাকশন দৃশ্যগুলো আরোপিত মনে হয় না, এ জন্য অ্যাকশন ডিরেক্টর আলাদা ধন্যবাদ পাবেন।
তবে সিরিজের শেষটা অনেকেই আগে অনুমান করতে পারেন, এদিকে একটু নজর দিলে ভালো হতো। এ ছাড়া শেষ দিকে নির্মাতা যেন একটা ‘কিন্তু’ রেখে গেলেন। ইঙ্গিত দিলেন, ‘এ গল্প শেষ হয়েও শেষ হয়নি।’ এ রকম রোমাঞ্চকর সিরিজের আরেকটি মৌসুমের জন্য অপেক্ষা করাই যায়।