‘এই বাড়ি ভরে গেল প্রেমে!’ ওয়ান হান্ড্রেড ইয়ারস অব সলিচুডের জাদু

`ওয়ান হানড্রেড ইয়ারস অব সলিচুড'-এর দৃশ্য। নেটফ্লিক্স

‘এই বাড়ি ভরে গেল প্রেমে!’ লিখেছিলেন মার্কেস, তাঁর উপন্যাসে। নেটফ্লিক্সের সিরিজে এই বিবরণ রহস্যমেদুর কণ্ঠে পড়ে শোনানো হয়!

বইয়ে পড়া গল্পের চিত্রায়ণ দেখতে বসা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই হতাশাজনক। বাংলা ভাষায় অন্তত দুটি উপন্যাস এবং তার ওপরে নির্মিত চলচ্চিত্র সম্পর্কে বলা যায়, উপন্যাসও তুলনাহীন, চলচ্চিত্ররূপও অনবদ্য। ‘পথের পাঁচালী’, আর ‘সূর্য দীঘল বাড়ী’। আবার পদ্মা নদীর মাঝি উপন্যাস হিসেবে অনবদ্য, চলচ্চিত্র হিসেবে বলতে হবে, মন্দ নয়। ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ও উপন্যাস ও চলচ্চিত্র উভয়রূপেই উত্তম। এই রকম করে অনেক উপন্যাস, গল্প এবং তাদের চলচ্চিত্ররূপ নিয়ে অনেক কথাই বলা যাবে।

`ওয়ান হানড্রেড ইয়ারস অব সলিচুড'-এর দৃশ্য। নেটফ্লিক্স

কলম্বিয়ান কথাসাহিত্যিক নোবেল পুরস্কার (১৯৮২) বিজয়ী গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের (১৯২৭-২০১৪) ভুবনকাঁপানো উপন্যাস ‘ওয়ান হানড্রেড ইয়ারস অব সলিচুড’ নিয়ে নেটফ্লিক্সের সিরিজের প্রথম সিজন এই বড়দিনের তুষারঢাকা মৌসুমটিকে উষ্ণতর করে তুলেছে। লাতিন আমেরিকা আর মেক্সিকোর মতো স্প্যানিশভাষী অঞ্চলে এই সিরিজ এরই মধ্যে ভূমিকম্প সৃষ্টি করেছে। নিউইয়র্ক কাঁপছে না বটে, তবে এই সিরিজ নিয়ে আগ্রহের কমতি নেই সেখানেও।

বাংলাদেশেও আমরা নেটফ্লিক্সের নির্জনতার একশ বছর নিয়ে কমবেশি উত্তেজিত। বিভিন্ন দেশের দর্শকেরা এই সিরিজ দেখে তাঁদের প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে একটা কথা বলছেন, তাঁরা আবার বইয়ের তাক থেকে বইটা নামিয়েছেন এবং আবার পড়তে শুরু করেছেন। বাংলাদেশেও আমাদের বন্ধুবান্ধবের অনেককেই একই কথা বলতে শুনছি।

‘ওয়ান হানড্রেড ইয়ারস অব সলিচুড’ চিত্রায়িত হবে—এই চিন্তাটাই একটা অবাস্তব চিন্তা। আমরা সবাই জানি, মার্কেসের উপন্যাসটি জাদুবাস্তবতার জাদুতে ঢাসা, বলা যায়, পাগলামোতে পরিপূর্ণ। মাকোন্দো আমাদের একেকজনের কল্পনায় একেক রকম। উরসুলা বলতে অন্তত আমার চোখে একজন বৃদ্ধার ছবি ভেসে ওঠে, যার চুল সাদা। সম্ভবত উরসুলার দ্বিতীয় ভাগ সুলা, মানে সাদা চুলওয়ালি, শব্দের মধ্যে অক্ষরগুলো আমাকে এই রকম কল্পনা করতে উদ্বুদ্ধ করেছিল। এই অসম্ভব কাল্পনিক জনপদ এবং তার পাগলামোতে পরিপূর্ণ চরিত্রগুলোকে ক্যামেরার চারকোনা ফ্রেমে কীভাবে আনা যাবে, আমি তা ভাবতেও পারছিলাম না। অনেক দিন ধরে ট্রেলার দেখানো হচ্ছিল, আর পরম কৌতূহলভরে অপেক্ষা করছিলাম, আর যেই না তা এসে গেল নেটফ্লিক্সে, অমনি চিৎকার করে উঠলাম—এসে গেছে।

`ওয়ান হানড্রেড ইয়ারস অব সলিচুড'-এর দৃশ্য। নেটফ্লিক্স

আহ্‌। সেই বিখ্যাত প্রথম লাইন, বহু বছর পরে ফায়ারিং স্কোয়াডের মুখোমুখি কর্নেল আওরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়ার মনে পড়ে গেল সেই সুদূর বিকেলটির কথা, যেদিন বাবা তাকে বরফ আবিষ্কার করতে নিয়ে গিয়েছিল। [এরপর থেকে ‘আরলিয়ানো’ বলা হবে]

মার্কেসের উপন্যাসে সময় জড়াজড়ি করে আছে, পরের কথা আগে, আগের কথা পরে, নেটফ্লিক্সের দুই পরিচালক মোটামুটি ধারাবাহিকভাবে গল্পটা বলার চেষ্টা করেছেন। এই উপন্যাস পড়ার সময় পাঠকদের সংগ্রাম করতে হয় এ জন্য যে দাদা, বাবা, ছেলে, নাতির একই নাম। কোনটা যে কে! বংশলতিকা সামনে রেখে বই পড়তে হয়। ছবি দেখার সুবিধা হলো, নাম এক হলেও অন্তত চেহারাগুলো আলাদা। সহজেই অনুধাবন করা যায়।

এই অসম্ভব উপন্যাসটিকে সম্ভবপর করে তোলার জন্য নেটফ্লিক্স এবং দুই পরিচালক অ্যালেক্স গার্সিয়া লপেজ এবং লরা মোরা অর্তেগাকে ধন্যবাদ দিতেই হবে। এই সিরিজ দেখার আগে কারও পক্ষেই ভাবা সম্ভব ছিল না বোধ হয় যে এটাকে শ্রুতিদৃশ্যমাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা সম্ভব হবে। ম্যাজিক রিয়েলিজমকে রিয়েল করার ম্যাজিক দেখানোর জন্য নির্মাতারা সাধুবাদ পাবেন।

`ওয়ান হানড্রেড ইয়ারস অব সলিচুড'-এর দৃশ্য। নেটফ্লিক্স

হ্যাঁ। অনেক ম্যাজিক পড়তে যতটা সুন্দর লাগে, দেখলে খানিকটা ‘খেলনা খেলনা’ মনে হয়। ধরা যাক, হোসে আর্কাদিওর মৃত্যুর পর তাঁর রক্তের ধারা যখন উরসুলার পায়ের কাছে পর্যন্ত যায়। বইয়ের বর্ণনা খুব মজা। রক্ত বেরিয়ে চলতে শুরু করল, দরজার নিচ দিয়ে গেল রাস্তা, ৯০ ডিগ্রি বাঁক নিল, অমুক রাস্তা ধরে চলল, অমুক জায়গায় আবার ঘুরল, অমুক জায়গায় এক ধাপ ওপরে উঠল, বারান্দা পেরিয়ে, রান্নাঘরে অমুকের পায়ের নিচ দিয়ে...তারপর উরসুলা যখন রক্তের উৎসের সন্ধানে বের হলো, আগের বর্ণনাটা জাস্ট রিভার্স করে দেওয়া হয়েছে, মার্কেসের সেন্স অব হিউমার এই রক্তপাতের মধ্যেও আপনার ঠোঁটে সামান্য হাসি আনবেই। কিন্তু সিনেমার রক্তের পথচলাটা দেখলে মনে হয়, একটা সাপ ছুটে চলেছে। মার্কেস বর্ণনা করার সময় কতগুলো অবাস্তব জিনিসের বিবরণ দেন সাংবাদিকী গদ্যে, যেমন ধরা যাক, এরেন্দিরার দাদির কী রকম মোটা, তার বর্ণনায় আছে, এত মোটা যে চারজন ইন্ডিয়ান তাকে রকিং চেয়ারে করে বয়ে নিয়ে যায়। সরলা এরেন্দিরা উপন্যাসিকায় বলা আছে, দাদিমা তিমির মতো বিশাল। সিনেমার দাদিমা অত মোটা নন। এরেন্দিরার যে চেহারা আমার কল্পনায় ছিল, তা এখানে একদমই মেলে না। কী আর করা।

নিষ্ঠুর মার্কেস বলেছেন, ওই বাচ্চা মেয়েটার কাছে আরলিয়ানো পৌঁছানোর আগে আরও ৬৩ জন তার কাছে গেছে, ঘামে বিছানার চাদর জবজব করছে, আরলিয়ানো ভেতরে ঢুকলে মেয়েটি চাদর চিপে ঘাম ঝরায়, সেসব তো আর সিনেমায় দেখা যায় না। আমরা সরলা এরেন্দিরার কাহিনিটা জানি। নিঠুর দাদিমার নাতনিটি মোমবাতি জ্বেলেছিল ঘরে, দুর্ভাগ্যের বাতাস বয়ে যায়, মোমবাতি পড়ে গিয়ে বাড়িতে আগুন লাগে। দাদি তখন বলেন যে পুরো বাড়ির খরচ মেয়েটিকে দিতে হবে। হিসাবমতো আরও ১০ বছর বালিকাটিকে প্রতি রাতে ৭০ জন খদ্দেরের সঙ্গে শুতে হবে।

`ওয়ান হানড্রেড ইয়ারস অব সলিচুড'-এর দৃশ্য। নেটফ্লিক্স

মার্কেসের ‘লাভ ইন দ্য টাইম অব কলেরা’ থেকে বানানো ছবিও দেখেছি। বেশ হতাশই হতে হয়েছে। কিন্তু ‘ওয়ান হানড্রেড ইয়ারস অব সলিচুড’ মোহিত করে রেখেছে।

আর এই ২০২৪-এর ডিসেম্বরে ঢাকায় বসে ‘ওয়ান হানড্রেড ইয়ারস অব সলিচুড’ দেখার আলাদা তাৎপর্য আছে। উদারপন্থী আর রক্ষণশীলদের লড়াই। যে লড়াই শেষ পর্যন্ত অর্থহীন, কারণ মানুষকে মেরে উদারপন্থা বা রক্ষণশীলতা কোনো পক্ষেরই সৎ উদ্দেশ্য চরিতার্থ হয় না। আরলিয়ানো যে উদারপন্থীদের বলেছিল, তোমরা আসলে কসাই, সেটা যেমন ঠিক, তেমনি কনজারভেটিভরা যে বাংলাদেশের রাতের ভোটের মতো ব্যালট বাক্স খুলে সব ব্যালট বের করে ভোটের রেজাল্ট পাল্টে দেয়, সেটা দেখাও আমাদের জন্য এক করুণ কৌতুকের ব্যাপার।

`ওয়ান হানড্রেড ইয়ারস অব সলিচুড'-এর দৃশ্য। নেটফ্লিক্স

মহাভারতের এত যুদ্ধবিগ্রহ শেষে কী হয়! সবকিছু অর্থহীন মনে হয়। কেন এত রক্তপাত! তলস্তয়ের ‘ওয়ার অ্যান্ড পিস’ শেষ হলেও আপনার নিজেকে রিক্ত-নিঃস্ব মনে হবে, কেন এত যুদ্ধ করলেন নেপোলিয়ান। ‘ওয়ান হানড্রেড অব সলিচুড’ শেষেও এই নির্বেদ আপনাকে পেয়ে বসবে।

এই ছবির এবং উপন্যাসের সবচেয়ে প্রবল চরিত্র উরসুলা। একজন নারী যে একটা সংসারে প্রজন্মের পর প্রজন্মকে প্রচণ্ড ব্যক্তিত্ব দিয়ে রক্ষা করে চলে, এমনকি দুঃশাসনের বিরুদ্ধে দাঁড়ায় এবং শহরও শাসন করে, আবার রাতের বেলা কাঁদতে বসে, আহা, উরসুলা! বিশ্বসাহিত্যের এক অক্ষয় চরিত্র। নেটফ্লিক্সের উরসুলা আপনাকে মুগ্ধ করবেই, শ্রদ্ধায় আপনি নত হবেন।

`ওয়ান হানড্রেড ইয়ারস অব সলিচুড'-এর দৃশ্য। নেটফ্লিক্স

‘মেমোরিস অব মাই মিলানকলি হোর’ বইটার পর মার্কেসের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছিল পেডোফেলিয়া বা শিশুগামিতার। এক শ বছরের নির্জনতাতেও সে প্রবণতা আছে। তবে সেটা গল্পের চরিত্রের। মস্কোতের সাত মেয়ের মধ্যে ছয়টা বিবাহযোগ্য এবং অবিবাহিত, কিন্তু আরলিয়ানো পছন্দ করে সবচেয়ে ছোটটাকে, বইয়ের ভাষায় যে রোজ রাতে বিছানা ভেজায় আর সিনেমার সংলাপে যে এখনো পুতুল খেলে।

`ওয়ান হানড্রেড ইয়ারস অব সলিচুড'-এর দৃশ্য। নেটফ্লিক্স

আর মার্কেসের খ্যাতির একটা ক্ষেত্র, তা এই সিরিজেও প্রবলভাবে উপস্থিত—প্রেম। পাগলের মতো প্রেমে পড়ে চরিত্ররা, আরলিয়ানো রেমোডিসের, ক্রেসপি রেবেকার, ক্রেসপির প্রেমে পড়ে আমারান্তা। আর আছে অজাচার। ফুপুর প্রেমে পড়ে পাগল হচ্ছে আরলিয়ানো হোসে। আরকাদিও যে নগরনটিনী পিলার তেনেরার জন্য পাগল হয়ে যাচ্ছে, সে তো জানে না যে আসলে সে তার মা।

এবং এই উপন্যাসের এবং এই সিরিজের প্রধান উপজীব্য নিঃসঙ্গতা। প্রতিটা চরিত্র কী ভীষণ রকম একা। হোসে আরকাদিও বুয়েন্দিয়া, যাকে চেস্টনাটগাছের সঙ্গে বেঁধে রাখা হয়, সে একা। উরসুলা একা। আরলিয়ান্দো একা। আরকাদিও একা। কে একা নয়।

যুদ্ধও মানুষকে একা করে। যোদ্ধাকে একা করে।

`ওয়ান হানড্রেড ইয়ারস অব সলিচুড'-এর দৃশ্য। নেটফ্লিক্স

যুদ্ধ ভালো নয়। বিপ্লবের স্বপ্ন ভালো, কিন্তু বিপ্লবের বাস্তবতা ভালো নয়। কলম্বিয়ার এক হাজার দিনের যুদ্ধ ভালো নয়, গত শতাব্দীর শেষ থেকে এই শতাব্দীর প্রথম ভাগে চলা গৃহযুদ্ধও ভালো নয়।

আর রেমেদিওস, সুন্দরতম বালিকাটি। কীভাবে এত অল্প বয়সে বালিকা রতন/রেমেদিওস আর বালিকা থাকে না, জননীর স্থান অধিকার করে। আহ্‌, আমারান্তা, তুমি বিষ মিশিয়ো না কফিতে, প্লিজ, কারণ রেবেকা নয়, মারা যাবে রেমেদিওস, যার পেটে দু-দুটো বাচ্চা।

চলুন, মাকোন্দো যাই, মার্কেসের কল্পিত শহরটিতে। যেখানে টলটলে পানিতে প্রাগৈতিহাসিক ডিমের মতো পাথর। নেটফ্লিক্সের সেটে ওই প্রাগৈতিহাসিক পাথর, প্রিহিস্টোরিক এগস, দেখা যাবে। সব ভালো, শুধু চেস্টনাটগাছটা যে সিমেন্ট দিয়ে বানানো, তা দিব্যি বোঝা যাচ্ছে। এই একটা ত্রুটি ছাড়া আমার তেমন কোনো আপত্তি নেই।

`ওয়ান হানড্রেড ইয়ারস অব সলিচুড'-এর পোস্টার। নেটফ্লিক্স

বইটা আবার পড়া হচ্ছে। সেটাও তো কম লাভ নয়। মার্কেস সম্পর্কে আমার মূল্যায়ন তিনি জিনিয়াস, আইনস্টাইন, পিকাসো, রবীন্দ্রনাথ, তলস্তয়ের মতোই তিনি ক্ষণজন্মা মহাপুরুষ। আমি যতবার এই লাইনটা পড়ি, যে রেবেকার আনা ক্যানভাসের ব্যাগে তার বাবা-মার হাড় ক্লক-ক্লক শব্দ করে, ততবার ভাবি, একটা লোকের কল্পনাশক্তি কত দূরগামী হতে পারে!

‘ওয়ান হানড্রেড ইয়ারস অব সলিচুড’ কি দেখার মতো! এর উত্তর হলো, আপনি যদি সাহিত্যানুরাগী হন, শিল্পানুরাগী হন, তাহলে আপনার অবশ্যই সিরিজটা দেখা উচিত। কবে যে বাকি সিজনগুলো আসবে? ৪২৫ পৃষ্ঠার বইয়ের কেবল ১৩০ পৃষ্ঠা দেখানো হয়েছে।