‘রেহানা’ থেকে ‘খুফিয়া’, বাঁধনের ধূসর-যাত্রা
বৃষ্টিভেজা রাত। আলো-অন্ধকার আর ধোঁয়াশার পর্দা ভেদ করে এগিয়ে আসছেন কেউ। চেহারা স্পষ্ট নয়, ছাতা হাতে বৃষ্টি থেকে বাঁচার চেষ্টাটা শুধু বোঝা যায়। বিশাল ভরদ্বাজের নতুন সিনেমা ‘খুফিয়া’র শুরুর দৃশ্য এটা। দৃশ্যের সঙ্গে চলা ভয়েস ওভারে শোনা যায় যিনি হেঁটে আসছেন, তাঁর সম্পর্কে কিছু তথ্য। ক্রমে স্পষ্ট হয় তাঁর চেহারা—আজমেরী হক বাঁধন। হিন্দি সিনেমার নন্দিত পরিচালকের ওয়েব ফিল্মে অভিনয় করছেন বাংলাদেশি অভিনেত্রী, এ খবর জানা গেছে আগেই। বাকি ছিল পর্দায় দেখার অপেক্ষা। ৫ অক্টোবর নেটফ্লিক্সে এসেছে সিনেমাটি। দৈর্ঘ্য বিচারে ছবিতে বাঁধনের উপস্থিতি খুব বড় নয়, কিন্তু অভিনয় আর সপ্রতিভ উপস্থিতি দিয়ে ঠিকই নিজের ছাপ রেখেছেন তিনি। ছবিতে বাঁধনের অভিনয় ও টাবুর সঙ্গে তাঁর রসায়নের প্রশংসা করেছেন অনুপমা চোপড়াসহ ভারতের অনেক সমালোচক।
‘মানুষ তোমাকে ভালোবাসায় ভরিয়ে দিচ্ছে’
‘এখন পর্যন্ত যা প্রতিক্রিয়া পেয়েছি, খুবই ভালো। মানুষ দেখছে, ছবিটি নিয়ে কথা বলছে। সবাই আমার আর টাবুর রসায়ন পছন্দ করেছে। বলছে, পর্দায় আমাদের দেখতে খুব ভালো লেগেছে; আমাদের দৃশ্য যখন এসেছে, তখন চোখ সরাতে পারেনি,’ ‘খুফিয়া’ দেখার পর দর্শকের প্রতিক্রিয়া নিয়ে গতকাল দুপুরে মুঠোফোনে বলছিলেন বাঁধন।
যদিও মুক্তির আগপর্যন্ত নার্ভাস ছিলেন তিনি। জানালেন, কেবল প্রথম হিন্দি সিনেমা বলেই নয়, সব কাজ মুক্তির আগেই এই নার্ভাসনেস কাজ করে; ঠিক পরীক্ষার আগের রাতের মতো।
বললেন, ‘আমার সিনেমাটা এত মানুষ দেখবে, এই চাপটা অনুভব করি। এত বড় একজন অভিনেত্রীর সঙ্গে (টাবু) কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করেছি, সেটা পর্দায় কেমন লাগবে, তা নিয়ে একটু ভয় ছিল। কিন্তু মানুষ আমাদের রসায়ন এত পছন্দ করেছে, আমি মুগ্ধ।’ কথায়–কথায় আরও বললেন, মুক্তির দিন টাবু খুদে বার্তা পাঠিয়ে শুভকামনা জানিয়েছেন তাঁকে। পুরো সিনেমা দেখার পর বাঁধনও তাঁর অনুভূতি জানান ভারতীয় অভিনেত্রীকে। উত্তরে টাবু লিখেছেন, ‘ছবিতে তুমি এত দুর্দান্ত করেছ, মানুষ তোমাকে ভালোবাসায় ভরিয়ে দিচ্ছে।’ মুক্তির আগে নিজের নার্ভাসনেসের কথা জানিয়েছিলেন পরিচালককেও। বিশালও তাঁকে বলেন, ‘তুমি এত ভালো করেছ, চিন্তার কিছু নেই।’
অক্টোপাসের আর ভয় কী
‘খুফিয়া’ সিনেমার বিষয়বস্তু বাংলাদেশের জন্য সংবেদনশীল, বাঁধন অভিনীত হীনা রহমান ওরফে অক্টোপাস চরিত্রটিও। মুক্তির পর তাঁর অভিনীত চরিত্র বা সিনেমা নিয়ে বিতর্ক হবে, এ ভাবনা মাথায় ছিল? অভিনেত্রী জানালেন, কোনো চরিত্র যদি তাঁকে রোমাঞ্চিত করে, তাহলে অন্য কিছু না ভেবে সেটাকেই প্রাধান্য দেওয়া উচিত। এখন মুক্তির পর যখন ভারতীয় বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় তাঁর অভিনয় নিয়ে লেখা হচ্ছে, সেটা তাঁর মধ্যে ভালো লাগা তৈরি করছে। ফলে অক্টোপাসের আর ভয় কী!
আগে সৃজিত মুখার্জির সিরিজে অভিনয় করেছিলেন বাঁধন। সেই হিসাবে দেশের বাইরে এটি তাঁর দ্বিতীয় কাজ। মুঠোফোনে জানালেন বলিউডে কাজের অভিজ্ঞতা, ‘ছবিতে আমার উপস্থিতি হয়তো বেশি সময়ের নয় কিন্তু এই কাজের অভিজ্ঞতা আমাকে সমৃদ্ধ করেছে। এটা অভিনেত্রী হিসেবে তো বটেই, মানুষ হিসেবেও আমাকে ঋদ্ধ করেছে। এত বড় মাপের মানুষেরাও কতটা মাটিতে থাকেন, সেটা দেখে বেশি ভালো লেগেছে। একজন অভিনেত্রী হিসেবে বিশাল ভরদ্বাজের ছবিতে কাজ করাই বড় ব্যাপার, তার ওপর সহ–অভিনেতা যদি হন টাবু, তাহলে তো সোনায় সোহাগা।’
‘খুফিয়া’র পুরো চিত্রনাট্য পড়েছিলেন বাঁধন। ডাবিংয়ের সময় একবার দেখেছিলেন। মুক্তির পর দেখেছেন কয়েকবার। হাসতে হাসতে বলছিলেন, প্রতিদিনই কারও না কারও সঙ্গে ছবিটি আবার দেখতে হচ্ছে তাঁকে। পুরো সিনেমা নিয়ে তাঁর মন্তব্য জানালেন এভাবে, ‘আমরা এখন তো দ্রুতগতির অ্যাকশন দেখে অভ্যস্ত, সেই হিসেবে “খুফিয়া”র মতো পিরিয়ড ছবি অনেকের ধীরগতির লাগতে পারে, কিন্তু আমার কাছে খুব ভালো লেগেছে। এটা এতবার দেখেও বোর লাগছে না, সিনেমাটা কতটা শক্তিশালী, বোঝাই যাচ্ছে।’
কে কাকে খুঁজে নেয়
‘রেহানা মরিয়ম নূর’, ‘রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনও খেতে আসেননি’, ‘গুটি’ থেকে ‘খুফিয়া’—সব কটিতেই ধূসর চরিত্রে অভিনয় করেছেন বাঁধন। এই কাজগুলোতে তিনি স্বাধীনচেতা, সাহসী নারী। একের পর এক ধূসর নারী চরিত্র তিনি কি নিজেই খুঁজে নেন, নাকি চরিত্ররাই তাঁকে খুঁজে নেয়? ‘দুটোই,’ প্রশ্ন শুনে হাসতে হাসতে বললেন বাঁধন। পরে দিলেন বিস্তারিত ব্যাখ্যাও, ‘জীবনে বেশির ভাগ জিনিসই নিয়তের ওপর নির্ভরশীল, এটা আমি বিশ্বাস করি। আমার এ ধরনের কাজ করার ইচ্ছা খুব তীব্র। সে জন্যই হয়তো রেহানা, অক্টোপাস, মুশকান জুবেরি বা সুলতানা আমাকে খুঁজে নিয়েছে।’
ওপরের চরিত্রগুলোর কোনোটিতেই বাঁধন প্রথম পছন্দ ছিলেন না। সে জন্যই ‘নিয়ত’ নিয়ে তাঁর বিশ্বাস আরও তীব্র হয়েছে বলে জানালেন অভিনেত্রী, ‘কেউ কিন্তু ভাবেনি চরিত্রগুলো আমাকে ছাড়া হবে না; বরং এটা ভেবেছে, ওকে দিয়ে হবে না। ফলে আমি মন থেকে বিশ্বাস করি, সৎ নিয়তের ওপর অনেক কিছু নির্ভর করে। মন থেকে চেয়েছি নারীপ্রধান গল্প করব, সে জন্যই হয়তো এসেছে। না হলে আমি কীভাবে চরিত্রের জন্য বিশালের কাছে, সৃজিতের কাছে বা সাদের কাছে যাব। আমি তো সাদকে চিনতামও না, জানতাম না এমন একজন পরিচালক আছেন।’
৪০-এর অপেক্ষায়
‘খুফিয়া’র চিত্রনাট্যে হীনা রহমান ২৭ কি ২৮ বছরের এক তরুণী। ছবিটির অডিশন দিতে যখন যান, বাঁধনের বয়স তখন ৩৭। অভিনেত্রী তখন সটান বলে দেন, ‘আমার বয়স তো ৩৭, কম বয়স তরুণীর চরিত্রে মানাবে কি?’ বয়স নিয়ে সরাসরি কথা বলায় তখন বাঁধন প্রশংসিত হয়েছিলেন শুটিং ইউনিটের কাছে।
বয়সের প্রসঙ্গ আসতেই অভিনেত্রীকে বলা, ২৮ অক্টোবর ৪০-এ পা দেবেন তিনি। জীবনের নতুন এই মাইলফলকে পা দেওয়ার আগে প্রত্যাশা কী? ‘চল্লিশে জীবনকে নতুন করে দেখছি। এই নতুন অধ্যায়ে জীবনটাকে পুরোপুরি উপভোগ করতে চাই। আমার স্বাধীনতা বুঝে পেতে চাই, অধিকার বুঝে পেতে চাই আর আমার মতো বাঁচতে চাই,’ বললেন বাঁধন।