মেয়েকে নিয়ে ‘মাইশেলফ অ্যালেন স্বপন’ অভিনেতা রুবেলের যুদ্ধ
সদা হাস্যোজ্জ্বল আর কৌতুকপ্রিয় মানুষটি জমিয়ে গল্প বলতে জানেন। কিন্তু এবার যেন সবকিছু ভুলে যাচ্ছিলেন। মনে থাকছে না বিভিন্ন ঘটনার দিন-তারিখও!
আড্ডা চলছিল ঘণ্টা দেড়েক ধরে। চায়ে চুমুক দিতে দিতে নিজের অভিনয়জীবনের নানা গল্প বলে যাচ্ছিলেন রুবেল। সদা হাস্যোজ্জ্বল আর কৌতুকপ্রিয় মানুষটি জমিয়ে গল্প বলতে জানেন। কিন্তু এবার যেন সবকিছু ভুলে যাচ্ছিলেন। মনে থাকছে না বিভিন্ন ঘটনার দিন-তারিখও। কন্যা তুরীর অপারেশন কবে হলো, সে কথা মনে করতে না পেরে স্ত্রীকে ফোন করলেন। ম্লান হেসে বললেন, তুরীর অসুখের পর থেকেই এই অবস্থা। সব এলোমেলো হয়ে গেছে। নিজেকে সহজ করার চেষ্টায় বোধ হয় হাসতে গেলেন। পারলেন না। হাত দিয়ে চোখ ঢেকে কেঁপে কেঁপে উঠলেন কান্নার দমকে। বললেন, ‘সিনেমা, নাটকে এসব হয়, গল্প-উপন্যাসে হয়, কিন্তু আমার সঙ্গে কেন এমন হবে। আমার ১১ বছরের মেয়েটা...।’
চেন্নাই থেকে মেয়ের চিকিৎসা শেষে দেশে ফিরেছেন কদিন আগে। সেখানে মাসখানেকের বেশি সময় মেয়েকে নিয়ে হাসপাতালে কাটিয়েছেন। চিকিৎসা শেষ হয়নি, শুরু হলো মাত্র। মাঝখানে অবসর মেলায় কিছুদিনের জন্য দেশে ফিরেছেন এ সময়ের আলোচিত অভিনেতা রফিউল কাদের রুবেল। ওটিটি সিরিজ ‘গুটি’র ম্যানেজার, ‘মাইশেলফ অ্যালেন স্বপন’–এর মাদক চোরাকারবারি বদি এবং ‘মহানগর ২’–এ গোয়েন্দা কর্মকর্তার ভূমিকায় অভিনয় করে রুবেল এরই মধ্যে দর্শকের নজরে পড়েছেন।
অভিনেতা হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেছেন দুই বছর হলো। এই দুই বছরে একরকম জায়গাও তৈরি করে নিয়েছেন তিনি। নতুন অনেক কাজ এসেছিল হাতে। এর মধ্যেই গত জুলাই মাসে মেয়ের ব্রেন টিউমার ধরা পড়ে। থমকে যায় সবকিছু
পোশাকশিল্পের মার্চেন্ডাইজার হিসেবে চাকরি করে ভালোই চলে যাচ্ছিল সংসার। সেই চাকরি ছেড়ে পুরোপুরি অভিনয়জগতে, টেলিভিশনসহ নানা মাধ্যমে পেশাদার অভিনেতা হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেছেন দুই বছর হলো। এই দুই বছরে একরকম জায়গাও তৈরি করে নিয়েছেন তিনি। নতুন অনেক কাজ এসেছিল হাতে। এর মধ্যেই গত জুলাই মাসে মেয়ের ব্রেন টিউমার ধরা পড়ে। থমকে যায় সবকিছু। সব কাজ ছেড়েও দিয়েছেন।
ব্রেন টিউমার অপারেশনের আগে মেয়ের চুল কেটে ফেলতে হয়েছিল। মেয়েকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য রুবেল ও তাঁর স্ত্রীও সেই সময় নিজেদের চুল ফেলে দিয়েছিলেন।
গত মঙ্গলবার সন্ধ্যায় চট্টগ্রামের পাঁচলাইশে প্রথম আলো অফিসে আড্ডা হচ্ছিল রুবেলের সঙ্গে। এই কয়েক মাসের ধকলে অনেকখানি শুকিয়েছেন। চোখ দুটি গর্তে ঢুকেছে। ব্রেন টিউমার অপারেশনের আগে মেয়ের চুল কেটে ফেলতে হয়েছিল। মেয়েকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য রুবেল ও তাঁর স্ত্রীও সেই সময় নিজেদের চুল ফেলে দিয়েছিলেন। মাথার চুল এখনো আগের মতো বাড়েনি। সব মিলিয়ে একটা ঝড়ের ছাপ তাঁর চেহারায়।
ঝড় বললেও একে কম বলা হয়। রুবেলের মুখ থেকেই শোনা গেল সেটা। দুই মেয়ে তুরী ও জয়ীকে নিয়ে পরিপাটি সুখের জীবন রুবেলের। সেই জীবনে প্রথম ঝোড়ো হাওয়া টের পান গত কোরবানির ঈদের পর। সে সময় মাথাব্যথা ও জ্বরে আক্রান্ত তুরীকে ভর্তি করা হয় হাসপাতালে। নানা পরীক্ষা–নিরীক্ষার পর ধরা পড়ে ব্রেন টিউমার হয়েছে।
চিকিৎসকেরা বলেছিলেন, হাতে একদমই সময় নেই। তাই চট্টগ্রামেই তুরীর অপারেশন করিয়ে ফেলতে হয়। এরপর তাকে নিয়ে যান চেন্নাইয়ে। সেখানে গত এক মাসে ৩০টি মতো রেডিও থেরাপি দিতে হয়েছে মেয়েকে। প্রথমবার রেডিও থেরাপির পর ২২ বার বমি হয়েছে তুরীর। সারা মুখে ক্ষত হয়ে যাওয়ায় কোনো কিছুই খাওয়ানো যাচ্ছিল না তাকে।
চেন্নাইয়ের ভাড়া বাসায় একদিন অচেতন হয়ে পড়েন রুবেল নিজে। ঘরে অসুস্থ তুরী, স্ত্রী আজিজা শামসুননাহার আর ছোট মেয়ে জয়ী। দ্রুত অচেতন রুবেলকে হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসকেরা জানান হার্ট অ্যাটাক হয়েছে।
এ অবস্থায় চেন্নাইয়ের ভাড়া বাসায় একদিন অচেতন হয়ে পড়েন রুবেল নিজে। ঘরে অসুস্থ তুরী, স্ত্রী আজিজা শামসুননাহার আর ছোট মেয়ে জয়ী। দ্রুত অচেতন রুবেলকে হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসকেরা জানান হার্ট অ্যাটাক হয়েছে। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে অপারেশন করতে হবে। তবে জ্ঞান ফিরে এলে রুবেল তাতে সম্মতি দেননি। মেয়ের জন্য ২০-২৫ লাখ টাকা খরচ হয়ে গেছে। আরও অনেক টাকা লাগবে। তাই নিজের চিকিৎসা করাতে চাইলেন না। চিকিৎসকদের নিষেধ না শুনে, কেবল ওষুধ নিয়েই হাসপাতাল ছাড়লেন।
রুবেল আবারও দ্রুত কাজে ফিরতে চান। ফিরতে চান প্রিয় মঞ্চেও। মঞ্চই তো তাঁর প্রাণের জায়গা। চট্টগ্রামের তির্যক নাট্যগোষ্ঠীতে তাঁর সতীর্থ ছিলেন নাসির উদ্দিন খান ও ইমতিয়াজ বর্ষণ। দুই সহযোদ্ধা আর নির্মাতা ইফতেখার সায়মন এবং রিয়াদ বিন মাহমুদের উৎসাহেই তিনি টেলিভিশন ও ওটিটি প্ল্যাটফর্মে এসেছেন। তবে নাটকের হাতে খড়ি তির্যকেরও আগে। চট্টগ্রামের চকবাজারের জয়নগরে লজিয়ঁন থিয়েটার নামের একটা শৌখিন নাটকের দল গড়ে তুলেছিলেন তাঁরা। সে দলে ছিলেন নির্মাতা ওয়াহিদ তারেক আর রফিকুল আনোয়ার রাসেল।
সেই সময় জাঁ পল সার্ত্রের ‘দেয়াল’, মমতাজউদ্দিনের ‘বর্ণচোরা’র মতো নাটক মঞ্চস্থ করেছিলেন। ১৯৯৭-৯৮ সালে তারেক আর রাসেল ঢাকায় চলে গেলে রুবেল যোগ দেন তির্যকে। সেখানে বের্টল্ট ব্রেখটের ‘সমাধান’, শেক্সপিয়ারের ‘রোমিও জুলিয়েট’সহ নানা নাটকে অভিনয় করেছেন। ‘লজ্জা’ ও ‘সত্যান্ধ’ নামে নিজেও নাটক লিখেছেন তির্যকের জন্য।
ওটিটি প্ল্যাটফর্মের সঙ্গে দ্রুতই মানিয়ে নিয়েছেন চরকির আলোচিত ওয়েব সিরিজ গুটির ‘ম্যানেজার’ রুবেল। শঙ্খ দাশগুপ্তের এই সিরিজে অভিনয়ের অভিজ্ঞতার কথা বহুদিন মনে থাকবে তাঁর। বিশেষ করে নির্মাতা শঙ্খ দাশগুপ্ত তাঁকে নিজের মতো অভিনয়ের স্বাধীনতা দিয়েছিলেন।
‘গুটি’র সেটেই একবার মজার একটি ঘটনা ঘটে। এই সিরিজের অন্যতম প্রধান একটি চরিত্রে অভিনয় করেন আজমেরী হক বাঁধন। একটা দৃশ্যে বাঁধনকে চড় মারতে হবে মাদক চোরাকারবারিদের গডফাদার অর্থাৎ ম্যানেজার রুবেলকে। কিন্তু চড় মারাটা ঠিকঠাক হচ্ছিল না। পরিচালক শঙ্খ বললেন, ‘ঠাটায়ে চড় দেন।’ বাঁধনও বললেন, ‘দাদা হচ্ছে না। জোরেই মারুন।’ সংলাপ বলতে বলতে বেশ জোরেই চড়টা দিয়েছিলেন রুবেল। চকিতে মনে হলো ভীষণ ব্যথা পেয়েছেন বাঁধন। একটা কাঁটা যেন খচখচ করে উঠল। তবু অভিনেতাদের কত কিছুই করতে হয়। কষ্ট, অনুকম্পা, বেদনা, হতাশা—এসব তো নিত্যসঙ্গী। লড়াকু রুবেলও সেসব ভালো করে জানেন।