এই ভূত সেই ভূত নয়

নুহাশ নতুন গল্পগুলোতে অতিপ্রাকৃত বিষয়ের সঙ্গে জুড়ে দিয়েছেন দেশের সাম্প্রতিক নানা ঘটনা; যা তৈরি করেছে অদ্ভুত এক ভয়ের মনস্তত্ত্বকোলাজ

‘ইবলিশ আর মানুষের মধ্যে পার্থক্য একটাই—একটা তালব্য শ, আরেকটা পেট কাটা ষ’, নুহাশ হুমায়ূনের ২ষ-এর ‘অন্তরা’ পর্বের একটি সংলাপ। এই সংলাপের প্রতিফলন দেখা যায় পুরো সিরিজেই। প্রথম মৌসুমে ভূতের ভয় দেখিয়েছেন নির্মাতা, এবার তিনি হাজির হয়েছেন ভয়ের অন্য রকম এক ব্যাখ্যা নিয়ে। চরকির এ অ্যানথোলজি সিরিজ এর মধ্যেই মনোনীত হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের মর্যাদাপূর্ণ সাউথ বাই সাউথওয়েস্ট উৎসবে।
‘পেট কাটা ষ’-এর মতো এবার গ্রামবাংলার পুরোনো দিনের ভূতের গল্প নেই। নুহাশ নতুন গল্পগুলোতে অতিপ্রাকৃত বিষয়ের সঙ্গে জুড়ে দিয়েছেন দেশের সাম্প্রতিক নানা ঘটনা; যা তৈরি করেছে অদ্ভুত এক ভয়ের মনস্তত্ত্ব। একে একে গল্পগুলোর গভীরে ঢোকার চেষ্টা করা যাক।
প্রথম গল্প ‘ওয়াক্ত’ পাঁচ বন্ধুর গল্প। আমাদের সমাজে পাপ কাজ যেন হয়ে উঠেছে বিনোদনের বিকল্প। কেউ যেন শুধু চাইলেই যেকোনো কিছু করে ফেলছে। ভাবছে না পরিণতি নিয়ে। কিন্তু পাপ কি কখনো পিছু ছাড়ে? নাকি বদলা নিতে ফিরে আসে ভয়ংকর রূপে? ‘ওয়াক্ত’ পাপের ভয়াবহ সেই পরিণতির গল্প।

‘ভাগ্য ভালো’ এক জ্যোতিষীর গল্প। টিয়া পাখি নিয়ে রাস্তায় বসে তিনি মানুষের ভাগ্যগণনা করেন। কিন্তু ঘটনাচক্রে ভাইরাল হয়ে যান তিনি। আর তারপরই তাঁকে পেয়ে বসে লোভ। ভাগ্য নিয়েই জুয়া খেলতে শুরু করেন তিনি। এ গল্পে ভাগ্যের হাতবদলকে দেখানো হয় এক সুবিশাল অট্টালিকার মাধ্যমে, যেন অন্যের ভাগ্য শোষণ করতে করতেই বানানো হয়েছে এ ইমারত। আর শোষক সেই জ্যোতিষী নিজেই। ভাগ্য নিয়ে লোভের খপ্পরে পরে কী পরিণতি হয় তাঁর? এই পর্বে টিয়া পাখি বারবার জ্যোতিষীকে বলে ‘পর্দা সরাইসা না’। কিন্তু ততক্ষণে কী করা যাবে আর যাবে না, সে পর্দা সরিয়ে ফেলেছে সে।

আরও পড়ুন
‘ভাগ্য ভালো’তে মোশাররফ করিম। চরকির সৌজন্যে

শয়তানের সঙ্গে সংসার করার গল্প ‘অন্তরা’। অশুভ শক্তির নেতিবাচক চরিত্ররূপে এখানে খোদ শয়তানকেই দেখানো হয়েছে। অতিপ্রাকৃতিক বিবাহিত জীবন আর শয়তানের জাল ছিন্ন করার গল্প বলে যায় এটিকে। বাস্তব, কল্পনা আর পৌরাণিক কাহিনির মধ্যে ঘোরপাক খাওয়া এক গোলকধাঁধা যেন এ গল্পটি।
‘বেসুরা’ এক আজব গ্রামের গল্প। জাদুর স্পর্শে যে গ্রামের সব লোক মেধাবী হয়ে জন্ম নিয়েছে। কিন্তু তাদের মধ্যে জন্ম নেওয়া একটা ছোট্ট মেয়ের গলায় কোনো সুর নেই। সবাই তাকে অপয়া ভাবতে শুরু করে। গ্রামের মোড়ল গাতক বলেন, সূর্যাস্ত পর্যন্ত গান গাইতে না পারলে বাকি জীবন কসাইর ঘরে কাটাতে হবে। ভাগ্যচক্রে এক ডাইনির দেখা পায় বেসুরা মেয়েটি। আর এর পেছনে লুকিয়ে থাকে বহু বছর আগের এক গল্প, আদি মাতার গল্প।
মোটাদাগে এই চার গল্পের যোগসূত্র নীতিবোধ, শয়তান আর মানুষের টানাপোড়েন। পাপবোধ, বিশ্বাস, বিস্মরণ যেন শিকড় বিস্তার করেছে ‘ওয়াক্ত’, ‘ভাগ্য ভালো’, ‘অন্তরা’ এবং ‘বেসুরা’ নামের চারটি ছবিতে। একই সঙ্গে জড়িয়ে আছে রাজনীতি আর পুঁজিবাদী সমাজকে চপেটাঘাত। প্রথম ছবিতে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা আর সাধারণ মানুষের প্রাণহানির ঘটনা। দ্বিতীয় ছবিতে দেখানো হয়েছে, দেশের সৌভাগ্য শুষে নিচ্ছে এক শয়তান। তৃতীয় ছবিতে শয়তানের শুষে নেওয়া স্মৃতি আর তার পরাজয়। শেষ ছবিতে লোকনাট্যের আঙ্গিকে নুহাশ হাজির করেন আদি মাতাকে। কিন্তু কেন?

আরও পড়ুন
‘বেসুরা’র দৃশ্য। চরকির সৌজন্যে

সেটা বুঝতে আগের তিন সিনেমার যোগসূত্র মেলাতে হবে। যে মুখোশ পরে পাঁচ যুবক পার্টি অফিসে আগুন লাগাতে গিয়েছিল, সেই মুখোশগুলোই কয়েকটি শিশুকে পরতে দেখা যায় দ্বিতীয় পর্বে। আবার সেই মুখোশ ফিরে আসে তৃতীয় ছবিতে শয়তানের ব্যক্তিগত আসরে, বাদকদের মুখে। তৃতীয় পর্ব ‘অন্তরা’য় অশুভ শক্তি বা শয়তানের চরিত্রে অভিনয় করেন আফজাল হোসেন। পর্বটিতে তিনি যখন ডিনারে টেবিলে, তখন তিনি ‘অন্তরা’ চরিত্রের অভিনেত্রী নওশাবাকে তাঁর প্রথম প্রেমের গল্প বলেন। একটা বাগানে তিনি ঘুরছিলেন। সেখানেই প্রথম প্রেমিকার সঙ্গে দেখা। কিন্তু প্রথম সেই নারী আসলে কে? সেটা কিন্তু কেউ জানে না। পরের পর্ব ‘বেসুরা’য় সে উত্তর লুকানো আছে। আফজাল হোসেনের সেই প্রেমিকা আর কেউ নন, শেষ পর্বে ডাইনির চরিত্রে অভিনয় করা জয়া আহসান!
‘ভাগ্য ভালো’তে জ্যোতিষীর চরিত্রে অভিনয় করা মোশাররফ করিম যখন একটি শিশুর হাত দেখে বলেন, ‘ভাগ্য ভালো না। অল্প বয়সেই তোমার ওপর শয়তানের ভর করবে। কানের কাছে শয়তান ফিসফিসানি করবে। এক কান দিয়ে শুনে অন্য কান দিয়ে বের করে দিবা।’

পরের পর্বে দেখা যায় রাতের খাবারের দৃশ্যে সেই শিশুটি রান্না করা আস্ত খাসির মাথা কেটে নওশাবার সামনে রাখছে। বোঝা যায়, শিশুটি শয়তান ফিসফিসানি এক কান দিয়ে শুনে অন্য কান দিয়ে বের করে দিতে পারেনি। রাতের খাবারের সময় মুখোশ পরে যারা বাদ্যযন্ত্র বাজাচ্ছিল, একই মুখোশ ছিল সিরিজজুড়ে। আফজাল হোসেন বলেন, ‘অনেক দূরের গ্রাম থেকে গানের মানুষদের নিয়ে এসেছি।’ আসলে এই গানের দলটি ‘বেসুরা’ পর্বে দেখানো সেই গ্রামের। নুহাশ বলা যায়, রাতের খাবারের দৃশ্যটি দিয়েই পুরো সিরিজের যোগসূত্র স্থাপন করেছেন।

আরও পড়ুন
‘২ষ’–এর প্রথম পর্ব ‘ওয়াক্ত’–এর দৃশ্য। ছবি: চরকির সৌজন্যে

‘২ষ’-এ নুহাশের সঙ্গে সহ–লেখক ছিলেন তাঁর মা গুলতেকিন খান। সে কারণেই কিনা পারিবারিক নির্যাতন, নারীদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির বিষয়গুলো জোরালোভাবে এসেছে সিরিজটিতে। পুরো সিরিজে আবহসংগীত আর সম্পাদনা ছিল দুর্দান্ত। ‘অন্তরা’ পর্বে চায়ের কাপ দেওয়ার দৃশ্য যেভাবে সম্পাদনা করা হয়েছে, সেটা এককথায় জাদুকরি। হারমোনিয়মের সুরের সঙ্গে যে ভয় আর সাসপেন্সের মিশ্রণে আবহসংগীতকে অন্য মাত্রা দিয়েছেন অভিষেক ভট্টাচার্য। অভিনয়ের দিক থেকেও দুর্দান্ত সিরিজটি। ‘

‘আধুনিক বাংলা হোটেল’–এর পোস্টার। চরকির সৌজন্যে

‘আধুনিক বাংলা হোটেল’ দেখার পর মনে হয়েছিল, ‘মোশাররফ করিম ইজ ব্যাক’। এই সিরিজে তিনি নিজেকেই যেন ছাড়িয়ে গেছেন। জ্যোতিষী চরিত্রে তাঁর যা এক্সপ্রেশন, ভয় ধরিয়ে দেয়। আফজাল হোসেন, কাজী নওশাবা আহমেদ, সুমাইয়া শিমু, জয়া আহসান থেকে শুরু করে সবাই স্বল্প উপস্থিতিতেও নিজের জাত চিনিয়েছেন। প্রথম পর্বে মায়ের সঙ্গে আব্দুল্লাহ আল সেন্টুর খাওয়ার দৃশ্যটি তো ভোলার নয়; রীতিমতো গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। তবে অভিনয়, দৃশ্যকল্প, আবহসংগীত ছাপিয়ে উঠে আসে ভূত। তবে এই ভূত সেই ভূত নয়, মুখোশের আড়ালে থাকা ভূত!