হরেক রকম মরিচ তবে ঝাল কম

‘ব্ল্যাক মানি’তে পূজা চেরী ও চিত্রনায়ক রুবেলকোলাজ

নিরুত্তাপ মফস্‌সলের এক হোটেল ‘ঝিলিক’। হঠাৎই এক রাতে জমজমাট হয়ে ওঠে। টাকাভর্তি ট্রাক, সিনেমার উঠতি নায়িকা—সবই হাজির। টাকা লুট আর নায়িকার সান্নিধ্যের আশায় একে একে জড়ো হতে থাকে প্রভাবশালী ব্যক্তিরা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কে পায় টাকার নাগাল? গল্পটা শুনতে খারাপ নয়। ২ জানুয়ারি মুক্তির আগে প্রকাশিত টিজারও ছিল আশাপ্রদ। কিন্তু আদতে টিজার দেখে চড়তে থাকা প্রত্যাশার সঙ্গে কতটা তাল মেলাতে পারল রায়হান রাফীর ‘ব্ল্যাক মানি’?

একনজরে
ওয়েব সিরিজ: ‘ব্ল্যাক মানি’
পরিচালনা: রায়হান রাফী
অভিনয়ে: রুবেল, পূজা চেরী, সুব্রত, সুমন আনোয়ার, সালাউদ্দিন লাভলু
স্ট্রিমিং: বঙ্গ

ওটিটির অনেক গল্পেরই পটভূমি শহর। তাই দেশি-বিদেশি প্ল্যাটফর্মে শহর থেকে বের হতে পারলেই কনটেন্টগুলো আলাদা স্বাদ দেয়। ভারতে যেমনটা করতে পেরেছে ‘পঞ্চায়েত’। দেশেও ‘শাটিকাপ’, ‘সিনপাট’, ‘আধুনিক বাংলা হোটেল’ বা ‘রঙিলা কিতাব’-এ ভিন্নতার স্বাদ পাওয়া গেছে।

‘ব্ল্যাক মানি’র শুরুটাও পেরেছিল। উত্তরবঙ্গের কোনো এক মফস্‌সলের রাস্তা। চারপাশে ফসলের খেত, জলাভূমি, ঢিমেতালে ছুটে চলছে ট্রাক। বয়স্ক চালকের সতর্ক নজর সেখানে হয়ে ওঠে অভিজ্ঞতার সনদ। খামখেয়ালি সহকারী তখন ছাদে গা এলিয়ে দিয়েছে। কেবল এই শুরুর দৃশ্য ছাড়া সিরিজটির কোনো কিছুই সেভাবে জমেনি।
‘ব্ল্যাক মানি’ রায়হান রাফীর প্রথম ওয়েব সিরিজ, দর্শকের প্রত্যাশাও ছিল বেশি। কিন্তু তা আর মিটল কই। রাফী বড় পর্দা তো বটেই, ওটিটিতেও অনেক প্রশংসিত কাজ উপহার দিয়েছেন। ‘জানোয়ার’, ‘খাঁচার ভেতর অচিন পাখি’, ‘টান, ‘ফ্রাইডে’র মতো ওয়েব ফিল্মগুলো মোটাদাগে ভালোই হয়েছে। কিন্তু ‘ব্ল্যাক মানি’তে এসে যেন খেই হারিয়ে ফেললেন নির্মাতা।

‘ব্ল্যাক মানি’ সিনেমার দৃশ্যে পূজা চেরী
ছবি: বঙ্গর সৌজন্যে

হালকা মেজাজের কনটেন্ট ‘ব্ল্যাক মানি’। পরিচালকের দাবি, ‘ডার্ক কমেডি’। কিন্তু কমেডিই হোক বা অ্যাকশন, বিনোদনের তেমন খোরাক নেই। মূল সমস্যা হলো গল্পের দম নেই, চিত্রনাট্যও তথৈবচ। অথচ সিনেমায় যা পারা যায় না, সিরিজে সেটা করা যায়। সেটা হলো চরিত্রগুলো গভীরভাবে নির্মাণ। কিন্তু এ সিরিজে সে চেষ্টাই করেননি নির্মাতা। ‘ব্ল্যাক মানি’তে ভালো অভিনেতারা আছেন, তাঁদের বেশ কায়দা করে উপস্থাপনও করা হয়েছে, কিন্তু চরিত্রে গভীরতা না থাকলে তাঁরা আর কী করবেন। ‘ব্ল্যাক মানি’র দৈর্ঘ্য দুই ঘণ্টার কিছু বেশি, এই সময়ের মধ্যে ঠিকঠাক চরিত্র নির্মাণ করে গল্প বলা প্রায় অসম্ভব।

এটা এক রাতের গল্প। বলা ভালো, এক রাতে হোটেল ঝিলিকের চৌহদ্দিতে বলা গল্প। এমন ওয়ান লোকেশনে বলা গল্পের সঙ্গে দর্শককে পর্দায় ধরে রাখতে যে রোমাঞ্চ লাগে, এ সিরিজে সেটার ঘাটতি আছে। উঠতি নায়িকা ‘শায়লা’র চরিত্রে পূজা চেরীর পারিবারিক দুরবস্থার একটি যোগসূত্র তৈরির চেষ্টা করা হয়েছে, কিন্তু সেটাও দুর্বল।

‘ব্ল্যাক মানি’ সিনেমার দৃশ্যে রুবেল
ছবি: বঙ্গর সৌজন্যে

কিছু জায়গায় নির্মাতা কমেডি রেখেছেন, সেগুলোর বেশির ভাগই কাজ করে না।
অ্যাকশন আছে প্রচুর কিন্তু কোনোটাই ঠিক পরিকল্পিতভাবে কোরিওগ্রাফি করা নয়। রাফীর কাজের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ওয়ান টেক শট, ওয়ান লোকেশনের গল্পের ক্ষেত্রে যা দুর্দান্তভাবে ব্যবহার করা যেত। তাঁর আগের দুই সিনেমা ‘সুড়ঙ্গ’ ও ‘তুফান’-এ এর ভালো উদাহরণ আছে। কিন্তু এ সিনেমার অ্যাকশনও সেভাবে মনে দাগ কাটে না। পুরো সিরিজজুড়ে পরিকল্পনাহীনতার অনেক ছাপ আছে। ট্রাকচালকের সহকারী চরিত্রটি টাকা পেয়ে পুরো সিরাজগঞ্জ ‘কিনে নেওয়া’র স্বপ্ন দেখলেও তার কথায় শহরটির আঞ্চলিক টান ছিল না।

ইন্তেখাব দিনার, সুমন আনোয়ার, সালাউদ্দিন লাভলু, এরফান মৃধা শিবলু, মুকিত জাকারিয়ার মতো অভিনেতারা থাকলেও তাঁদের সেভাবে ব্যবহার করেননি নির্মাতা। একজনের পর একজন আসেন, কেউই সেভাবে ছাপ রেখে যেতে পারেন না। লুক, অভিনয় মিলিয়ে ‘বাইট্টা মাসুম’ চরিত্রে স্বল্প সময়ের উপস্থিতিতেও নজর কাড়েন ইন্তেখাব দিনার। তবে পরের দিকে তাঁর ‘অসহায় আত্মসমর্পণ’ ছাড়া আর যেন কিছুই করার ছিল না। নির্মাতা পরে এ চরিত্রটিকে নিয়ে স্পিন-অফ সিরিজ করার কথা ভাবতে পারেন।

‘ব্ল্যাক মানি’ সিরিজে সুমন আনোয়ার
বঙ্গর সৌজন্যে

সবচেয়ে হতাশ করেছেন রুবেল। সিরিজটি মুক্তির আগে বাণিজ্যিক সিনেমার এই জনপ্রিয় নায়ককে নিয়ে অনেক কথা হয়েছে, সিরিজের টিজারেও তাঁকে গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র হিসেবে দেখানো হয়েছিল। কিন্তু তাঁর অভিনীত চরিত্রটি খুবই দুর্বল, সিরিজে তাঁকে বড়জোর ‘অতিথি শিল্পী’ বলা যায়। ‘বেনসন জুনায়েদ’ চরিত্রে রুবেলের অভিনয় ছিল বেশ আড়ষ্ট, তাঁর কথা ভেবে আলাদা সংলাপও রাখা হয়নি।

উঠতি নায়িকা ‘শায়লা’র চরিত্রে পূজা চেরী মোটামুটি। ওসি হিসেবে মুকিত জাকারিয়ার চরিত্রটি নির্মাণে সুড়ঙ্গ-তে আলোচিত শহীদুজ্জামান সেলিমের চরিত্রের প্রভাবও চোখে পড়ার মতো। দর্শকও বুঝে গেছেন, রাফীর সিনেমার পুলিশ হয়তো একই ছাঁচে গড়া হবে।

‘ব্ল্যাক মানি’ সিরিজে পূজা চেরী ও সুব্রত
বঙ্গর সৌজন্যে

এ সিনেমায় আলোচিত সংলাপগুলো পেয়েছেন সুমন আনোয়ার। এ ছাড়া ‘হাশেম জাকারিয়া’ চরিত্রে চলচ্চিত্র অভিনেতা সুব্রতর ঝলকও খারাপ ছিল না।

আরও পড়ুন

‘ব্ল্যাক মানি’ মুক্তির পর থেকে ইউটিউব শর্টস আর ফেসবুক রিলসে ছেয়ে গেছে পূজা চেরীর আবেদনময় দৃশ্য আর সুমন আনোয়ার অভিনীত চরিত্রটির সংলাপে। বোঝা যায়, অন্তর্জালে এগুলো নিয়ে বিস্তর চর্চা চলছে। এই ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা’ বাদ দিলে ‘ব্ল্যাক মানি’ রাফীর ক্যারিয়ারের দুর্বল কাজ হয়েই রইল, প্রত্যাশা বেশি বলেই হয়তো।