দা হাতে মিমি, কী বার্তা দিল ‘ডাইনি’
আমাদের পরিচিত পরিবেশের বাইরেও কিছু গল্প থাকে। যা খুব নির্মম, মধ্যযুগীয় বর্বরতায় পূর্ণ। দেখার পরও বিশ্বাস হতে চায় না, এমন কিছু এখনো ঘটতে পারে এই সমাজে। তবে এখনো তা ঘটে। আর সে রকম এক অবিশ্বাস্য ঘটনা এবার পর্দায় ফুটিয়ে তুলেছেন নির্ঝর মিত্র। ওটিটি প্ল্যাটফর্ম হইচইতে ১৪ মার্চ মুক্তি পেয়েছে ছয় পর্বের সিরিজ ‘ডাইনি’। সেখানে তিনি তুলে ধরেছেন এমন এক গল্প, যা দেখে অবাক তো হবেনই, আবার চোখও ফেরাতে পারবেন না পর্দা থেকে।
দুই বোন, লতা আর পাতা। লতা অবশ্য পাতার মায়ের পেটের বোন নয়; কিন্তু তারা বড় হয়েছে আপন বোনের মতোই। পাতা স্বাধীনচেতা, দেশের বাইরে পড়তে যেতে চায়; কিন্তু বাবা মানেন না। একসময় ঘর থেকে পালিয়ে বিয়ে করে লন্ডনে চলে যান পাতা। পেছনে থেকে যায় তার ছোট বোন লতা।
একনজরে
ওয়েব সিরিজ: ‘ডাইনি’
পর্ব: ছয়
জনরা: ড্রামা, সারভাইভাল থ্রিলার
স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্ম: হইচই
পরিচালক: নির্ঝর মিত্র
অভিনয়: মিমি চক্রবর্তী, কৌশানি মুখোপাধ্যায়, বিশ্বজিৎ দাস, সুজিত কুমার বর্মণ, সুদীপ মুখার্জি
অনেক দিন পর দেশে ফিরে পাতা জানতে পারে বাবা মারা যাওয়ার আগে দুই বোনকে সম্পত্তি ভাগ করে দিয়েছেন। তবে সে সম্পত্তি পেতে গেলে দুই বোনকে একসঙ্গে উপস্থিত থাকতে হবে। পাতা ঘর থেকে পালানোর পর আর যোগাযোগ রাখেনি পরিবারের সঙ্গে। জানে না কোথায় আছে তার ছোট বোন লতা। তাই অনেকটা নিজের স্বার্থের জন্যই ছোট বোনকে খুঁজতে বের হয় সে। খুঁজতে গিয়ে সে পৌঁছায় এক ডুয়ার্সের প্রত্যন্ত পাহাড়ি গ্রামে। যেখানে মানুষ দেবতাদের মানে না। তবে বিশ্বাস করে ভূতে, ডাইনিতে। আর সেই ফায়দা নিতে পিছপা হয় না মানুষরূপী কিছু পিশাচ। ক্ষমতা ব্যবহার করে তারা যা খুশি তা–ই করে যায়। আর কেউ প্রতিবাদ করলে তার জীবনে নেমে আসে ভয়াবহ দুর্যোগ।
লতাকে খুঁজতে বের হয়ে পাতা দেখতে পায় মৃত্যুর দুয়ারে দাঁড়িয়ে আছে সে। তারই বোনকে মেরে ফেলা হচ্ছে ‘ডাইনি’ সন্দেহে! এরপর বোনকে বাঁচাতে ঝাঁপিয়ে পড়ে পাতা। পাতা কি পারে লতাকে বাঁচাতে? নাকি সেই মানুষরূপী শয়তানদের কাছে হার মানতে হয় তাকে?
‘ডাইনি’ সিরিজের প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেছেন মিমি চক্রবর্তী। বোনের প্রতি হিংসা, বোনকে বাঁচানোর চেষ্টা, অপরাধবোধে ভোগা চরিত্রের এ দ্বিমুখী দিককে তিনি খুব ভালোভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। অ্যাকশন দৃশ্যেও তাঁর অভিনয় ছিল দুর্দান্ত। তবে সিরিজটি শুধু মিমি চক্রবর্তীকে ঘিরে নয়। লতা হিসেবে অসাধারণ অভিনয় করেছেন কৌশানি মুখোপাধ্যায়। তাঁর সংগ্রাম, তাঁকে অত্যাচারিত হওয়ার দৃশ্যগুলো চোখে লেগে থাকে। পর্দায় উপস্থিতি কম সময়ের হলেও তাঁর চরিত্রটি বহুমাত্রিক। নতুন জীবনের স্বপ্ন নিয়ে প্রেমিকের হাত ধরে বাড়ি থেকে পালানো, এরপর কুসংস্কারাচ্ছন্ন এক গ্রামের গৃহবধূ হিসেবে জীবনে বিপর্যয় নেমে আসা; নানা উত্থান-পতনের গল্প দারুণভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন তিনি।
সিরিজটিতে পার্শ্ব চরিত্ররা সবাই খুব ভালো অভিনয় করেছেন। তবে এখানে খলনায়কের কথা আলাদাভাবে বলতেই হয়। জানগুরুর ভূমিকায় বিশ্বজিৎ দাসের অভিনয় ছিল অনবদ্য। জানগুরুকে তিনি যেভাবে অসাধারণ উপস্থাপন করেছেন তা সিরিজটিকে এক নতুন মাত্রা দিয়েছে। নির্দয়তা ও ক্রূর শয়তানি শরীরী ভাষায় তিনি চমকে দিতে থাকেন শুরু থেকেই।
‘ডাইনি’ সিরিজের সবচেয়ে ভালো দিক এর সাবলীল উপস্থাপনা। কোনো দৃশ্যে অহেতুক কোনো অ্যাকশন দৃশ্য দেখানো হয়নি। এমনকি অ্যাকশনের দৃশ্য দেখানো হয়েছে খুব বিশ্বাসযোগ্যভাবে। মারতে গিয়ে মিমি চক্রবর্তী ব্যথা পেয়ে তীব্র আর্তনাদ করে ওঠেন, বোঝাই যায় তিনি মারামারিতে অভ্যস্ত নন; সেটাকে পর্দায় দারুণভাবে হাজির করেছেন নির্মাতা। টাইগার শ্রফের ভক্ত মাইঠাল, তাঁর র্যাপার বন্ধুকে মনে থাকে। অন্তঃসত্ত্বা নারী চরিত্র, চিকিৎসক কিংবা দুই পুলিশের মধ্যের রসায়ন—সবকিছুই ছিল পরিমিত।
‘ডাইনি’ সিরিজটির সিনেমাটোগ্রাফির কাজ করেছেন তূর্য ঘোষ। জঙ্গলের ভেতরে ওয়াইড অ্যাঙ্গেল শটগুলো দারুণ ছিল। এই দৃশ্যগুলোর কারণে খুনিয়াবাড়ি জায়গাটি কতটা অজপাড়াগাঁয়ে তা দর্শক সহজেই বুঝতে পারেন। তবে সিরিজটির আবহ সংগীতে দুর্দান্ত কাজ করেছেন মৈনাক মজুমদার। রোমাঞ্চ, ভয় কিংবা শয়তানের উস্ফালন, প্রতিটি দৃশ্যের সঙ্গে আবহ সংগীতের মিশ্রণ ছিল দারুণ।
অনেক বাংলা সিরিজেই দেখা যায়, গল্প খেই হারিয়েছে, কিংবা গল্প অহেতুক টেনে নিয়ে গেছেন পরিচালক। তবে ‘ডাইনি’ শেষ হওয়ার পর মনে হয়েছে, কলেবরে আরেকটু বড় করাই যেত সিরিজটিকে। বিশেষ করে লতা-পাতার সম্পর্ক কিংবা তাদের মা-বাবার গল্প পরিচালক একটু সময় নিয়ে বলতে পারতেন। তবে মূল গল্প বা সেটার ভাব অক্ষুণ্ন রাখার জন্য হয়তো অন্য কোনো দিকে দর্শকের মন ফেরাতে চাননি তিনি। এমন ভালো একটা কাজ উপহার দেওয়ার জন্য পরিচালকের ছোটখাটো খামতিকে ছাড় দেওয়াই যায়!
‘ডাইনি’ সিরিজটা এতটাই ভালো বানিয়েছেন পরিচালক নির্ঝর যে দেখার পরে মনেই হয় না এটি পশ্চিমবঙ্গের কোনো কাজ। নির্মাণের গুণে এটি টেক্কা দিতে সক্ষম যেকোনো মূলধারার থ্রিলার সিনেমাকে। এটি নিঃসন্দেহে হইচইয়ের অন্যতম সেরা সিরিজ। নির্মাতা নির্ঝর মিত্র পশ্চিমবঙ্গের উত্তরবঙ্গের বাসিন্দা। ‘ডাইনি’র গল্পও ফেঁদেছেন নিজের এলাকাকে কেন্দ্র করে। সেটাই হয়তো সিরিজটাকে এতটা বিশ্বাসযোগ্য করে তুলেছে। ‘শিকারপুর’-এর পরিচালক এই সিরিজেও নিজেকে প্রমাণ করেছেন। তাঁর পরের কাজ নিয়ে দর্শকদের প্রত্যাশা জাগতে বাধ্য।
সিরিজ শেষ হয় কিছু খবরের শিরোনাম দিয়ে। যেখানে দেখানো হয়, এখনো ভারতের নানা প্রান্তে কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানুষ ডাইনি সন্দেহে নারীদের পিটিয়ে মারে। সিরিজটি দিয়ে নারী নির্যাতন, পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা, কুসংস্কারকে থাপ্পড় কষেছেন নির্মাতা। সিরিজের পোস্টারে থাকা দা হাতে মিমি চক্রবর্তীকে এ ক্ষেত্রে প্রতীকী অর্থে ধরে নিতে পারেন।
তবে ‘ডাইনি’র বেশ কিছু দৃশ্যে সহিংসতা আছে। পর্দায় এ ধরনের দৃশ্যে দেখতে যাঁরা অস্বস্তিবোধ করেন তাঁদের সিরিজটি না দেখাই ভালো।