কী হয়েছিল ডুমুরঝাঁপিতে

‘ফেউ’-এর দৃশ্যে মোস্তাফিজুর নূর ইমরানচরকি

১৯৭৮ সাল। ঘন কুয়াশা চিরে সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে চলছে একটি নৌকা। সেখানে একটি ক্যামেরা হাতে বনের জীব আর পাখিদের ছবি তুলছে সুনীল। মোংলা থেকে গন্তব্য তার ভারতের ডুমুরঝাঁপি। সেখানে রিফিউজি ক্যাম্পে রয়েছে হাজারো বাঙালি। ২০ বছর বা তারও বেশি সময় ধরে যারা জীবন কাটাচ্ছে রিফিউজি হিসেবে।

ডুমুরঝাঁপিতে এসেছে তারা আট মাস হলো। এখানে এসে ডাঙার মামা অর্থাৎ বাঘের সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার আগেই যাদের পেছনে ওঠে–পড়ে লেগেছে ‘ফেউ’। ফেউ মানে এজেন্ট, সরকারি গোয়েন্দা। শুরু হয় রিফিউজিদের নিয়ে রাজনীতির নোংরা খেলা। রিফিউজিদের জীবন কেমন, তা বোঝা যায় এ আক্ষেপ থেকে, ‘রিফিউজিগো দ্যাশ-জাত বইলে কিছু আছে নাকি! আমরা তো মন্দিরের ঘণ্টার মতো। যে বাজায়, খালি বাইজে যাই।’

একনজরে
ওয়েব সিরিজ: ‘ফেউ’
পর্ব: ৭
জনরা: ড্রামা
স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্ম: চরকি
পরিচালক: সুকর্ণ সাহেদ ধীমান
অভিনয়: চঞ্চল চৌধুরী, মোস্তাফিজুর নূর ইমরান, তানভীর অপূর্ব, হোসাইন জীবন, তাহমিনা অথৈ, রিজভী রিজু, তারিক আনাম খান

সুনীল সরকার মোংলা গির্জার রেভেরেন্ড হিসেবে কাজ করে। মোংলা থেকে প্রায়ই নানা সাহায্য নিয়ে আসে ডুমুরঝাঁপিতে। আর রিফিউজিদের ওপর হওয়া অত্যাচারের কথা জানায় বাইরের দুনিয়ায়। তার শখ ছবি তোলা। আর ঘটনাক্রমে ডুমুরঝাঁপির বাঙালিদের ওপর অত্যাচারের বেশ কিছু ছবি তুলে ফেলে সে। আর সেটাই কাল হয় তার জন্য।

‘ফেউ’ –এ চঞ্চল চৌধুরী
ছবি : চরকির সৌজন্যে

২০০২ সালে মোংলা গির্জায় আসেন এক বিদেশি পাদরি। এসে তিনি সুনীলের খোঁজ করেন। সবাই জানায়, সুনীল মারা গেছে ডুমুরঝাঁপিতে, অনেক আগেই। তবে তিনি এ উত্তরে সন্তুষ্ট হতে পারেন না। সুনীলের ছেলে ড্যানিয়েল আর তার বন্ধু সোহেলকে নিয়ে খোঁজ করতে থাকেন সুনীলের মারা যাওয়ার কারণ। সুনীল কি আসলেই মারা গেছে? ডুমুরঝাঁপিতেই বা কী হয়েছিল ১৯৭৯ সালে যা লুকিয়ে রাখা হয়েছিল সবার থেকে?
ওটিটি প্ল্যাটফর্ম চরকিতে গত ৩০ জানুয়ারি মুক্তি পেয়েছে সাত পর্বের সিরিজ ‘ফেউ’। সত্য ঘটনা অবলম্বনে সিরিজটি নির্মাণ করেছেন নির্মাতা সুকর্ণ সাহেদ ধীমান। চিত্রনাট্য লিখেছেন রোমেল রহমান, সিদ্দিক আহমেদ ও সুকর্ণ সাহেদ ধীমান।

সিরিজটি ১৯৭৯ সালের একটি ঐতিহাসিক ঘটনা নিয়ে নির্মিত। সিরিজটি মরিচঝাঁপি গণহত্যার ঘটনার ছায়া অবলম্বনে নির্মিত। নির্মাতা জানিয়েছেন, সত্য ঘটনা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি সিরিজটি বানিয়েছেন যেখানে আন্তর্জাতিক রাজনীতির সঙ্গে স্থানীয় রাজনীতি ও সংস্কৃতি তুলে ধরেছেন।

‘ফেউ’–এর একটি দৃশ্যে
চরকি

সুন্দরবনের অনেক গল্পের কথা আমরা জানি। কিন্তু সেখানেও যে রয়েছে শরণার্থীদের নিয়ে মর্মান্তিক এক রাজনীতির গল্প, তা হয়তো জানেন না খুব বেশি মানুষ। আর পরিচালক সুকর্ণ সাহেদ এ কাজই করতে চেয়েছেন। আর এ জন্য যতটা পারা যায় সবকিছু বাস্তব ঘটনার মতো করেই উপস্থাপন করতে চেয়েছেন তিনি। সুন্দরবনের গহিন জঙ্গলে এই সিরিজের বেশির ভাগ দৃশ্য ধারণ করা হয়েছে। ২০১৬ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে সংগ্রহ করেছেন নানা তথ্য, এগিয়েছেন গল্প বুননের কাজ। আর এর প্রমাণ পাওয়া যায় গল্পের চিত্রায়ণে। সুন্দরবনের বিপৎসংকুল পরিবেশকে তিনি যেভাবে পর্দায় ফুটিয়ে তুলেছেন, তা প্রশংসনীয়। গভীর বনের ভেতর দিয়ে নৌকায় ভেসে চলা, বন্য প্রাণীদের চলাফেরা, কাদা মাড়িয়ে বনের ভেতর থেকে মধু সংগ্রহ করা কিংবা কাদার ভেতর মারামারির দৃশ্য, প্রতিটি দৃশ্যই ফুটিয়ে তোলে বনজীবী মানুষের সংগ্রাম।

দুটি ভিন্ন সময়ের পটভূমির গল্প একসঙ্গে এগিয়ে যায় ‘ফেউ’-এ। সিরিজটিতে সুনীলের চরিত্রে অভিনয় করেছেন চঞ্চল চৌধুরী। তিনি বরাবরের মতোই চরিত্রের ভেতর ঢুকে নিজের সেরাটা দিয়েছেন। তবে মোস্তাফিজুর নূর ইমরান খ্যাপাটে মার্শালকে ফুটিয়ে তুলেছেন দারুণভাবে। যদিও পাগলাটে চরিত্রের মার্শালের শেষ দিকে রহস্যময় আচরণের জবাব পাওয়া যায় না। মনে হয়, গল্পের মাঝখানে হঠাৎ যেন খেই হারিয়ে গেছে।
‘ফেউ’ সিরিজের দুটি অন্যতম প্রধান চরিত্র ড্যানিয়েল ও সোহেল।

‘ফেউ’–এর দৃশ্য। চরকির সৌজন্যে

এ দুটি চরিত্রে অভিনয় করেছেন তানভীর অপূর্ব ও হোসাইন জীবন। বখে যাওয়া ভবঘুরে হিসেবে এ দুই তরুণ অভিনেতা ভালো অভিনয় করেছেন। তবে তাঁদের জীবনযাপন দেখাতে গিয়ে নির্মাতা বারবার সরে গেছেন মূল গল্প থেকে। এতে গল্প অনেকটা মূল ভাব হারিয়েছে। সেই সঙ্গে কিছু দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি গল্পে যোগ করেছে দীর্ঘসূত্রতা।
১৯৭৯ সালে ঠিক কী ঘটেছিল, তা প্রথম মৌসুমে প্রকাশ পায়নি। শেষে কী হয়, তা জানতে হয়তো দর্শকদের অপেক্ষা করতে হবে পরের মৌসুমের জন্য। পরের মৌসুম নিয়ে অবশ্য আনুষ্ঠানিকভাবে এখনো জানা যায়নি। তবে ইতিহাসের ধুলা সরিয়ে অজানা গল্প তুলে আনার জন্য নির্মাতাকে ধন্যবাদ দেওয়াই যায়।