আইনের লোক, ক্রসফায়ার আর দুই পরিবারের গল্প
বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘিরে হতে পারত থ্রিলার, পরতে পরতে রোমাঞ্চের স্বাদ হয়তো আরও বেশি দর্শককে আকৃষ্ট করত। ক্রসফায়ার নিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভেতরের গল্প নিয়ে রুদ্ধশ্বাস ইনভেস্টিগেটিভ সিনেমাও হতে পারত। তবে রায়হান রাফী তুলনামূলক সহজ সেসব পথে না হেঁটে বলতে চেয়েছেন দুই পরিবারের গল্প। আক্রান্ত আর আক্রমণকারীকে যেখানে জুড়ে দিয়েছে দুই কন্যাশিশু।
এক নজরে
সিনেমা: ‘আমলনামা’
ধরন: ড্রামা
নির্মাতা: রায়হান রাফী
অভিনয়: জাহিদ হাসান, কামরুজ্জামান কামু, তমা মির্জা ও গাজী রাকায়েত
স্ট্রিমিং: চরকি
দৈর্ঘ্য: ১ ঘণ্টা ৪২ মিনিট
দুই বছর আগে মাদক চোরাচালানের কাজ ছেড়েছে হাসান (কামরুজ্জামান কামু)। স্ত্রী পারভীন (তমা মির্জা) আর সন্তানদের নিয়ে সুখের জীবন। এক রাতে তাদের বাড়িতে হাজির হয় হাসানের সাবেক বস আজিজ ভাই (গাজী রাকায়েত)। তিনি হাসানের উকিল বাবাও বটে। পারিবারিক ডিনারে হাসানকে শেষ একটা কাজের প্রস্তাব দেন। হাসান জানায়, মেয়ে নিশুর মাথায় হাত রেখে সে প্রতিজ্ঞা করেছে, আগের পেশায় আর ফিরবে না। সেদিন রাতেই হাসানকে পরিবারের সামনে থেকে তুলে নিয়ে যায় ‘আইনের লোক’। স্বামীর খোঁজে মরিয়া পারভীন ছোটে থানায়, কিন্তু পুলিশ জানায় তারা হাসানকে ধরেনি। অন্যদিকে মাদক নিয়ন্ত্রণ সংস্থার কর্মকর্তা ইমরান জামান (জাহিদ হাসান) তাঁর অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে (সারিকা সাবরিন) নিয়ে ব্যস্ত। যেকোনো সময় প্রসববেদনা উঠবে, ইমরান চান এই সময়টা ছুটি নিয়ে স্ত্রীর পাশে থাকবেন। তাঁর বস ছুটি মঞ্জুর করেন কিন্তু শর্ত একটাই, আজ রাতে ‘শেষ কাজটা’ সারতে হবে। এই হলো রায়হান রাফীর নতুন ওয়েব সিনেমা ‘আমলনামা’র গল্প।
টিজার, ট্রেলারে যা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, ‘আমলনামা’ তেমনই। হাসানের পরিণতি ট্রেলারেই বুঝিয়ে দেওয়া হয়, শেষটা জেনেই দর্শক সিনেমা দেখতে শুরু করেন। যা যা ঘটবে, তার প্রায় সবই যখন আপনার জানা থাকে, তখন পুরো সিনেমা দেখতে বাধ্য করাই পরিচালকের মুনশিয়ানা। এখানে রায়হান রাফী সফল। চলতি বছরের শুরুতে মুক্তি পাওয়া সিরিজ ‘ব্ল্যাক মানি’তে রাফীকে ঠিক খুঁজে পাওয়া যায়নি, এ সিনেমা দিয়ে আবার নিজের কক্ষপথে ফিরলেন তিনি।
‘আমলনামা’ ধীরগতির সিনেমা, স্লো বার্ন কাজ যাঁরা দেখতে পছন্দ করেন, তাঁদের ভালো লাগার কথা। এখানে গল্পে কী হচ্ছে, তার চেয়ে কীভাবে হচ্ছে, সেটা গুরুত্বপূর্ণ। গভীর রাতে স্বামীকে তুলে নিয়ে যাওয়ার পর পাগলপ্রায় এক গৃহবধূ আর ‘আততায়ী’ এক মাদক কর্মকর্তার অভিযানের গল্পের অনেক কিছুই আপনার মনে থাকবে।
একটি দৃশ্যে দেখা যায়, অনাগত কন্যাশিশুর নাম ঠিক করতে ব্যস্ত ইমরান ও তাঁর স্ত্রী। একটা নামও মনমতো হচ্ছে না, স্ত্রীর বিশাল নামের ফিরিস্তি শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়েন ইমরান। আরও পরে যখন হাসানকে নিয়ে কথিত অভিযানে যাচ্ছেন ইমরান, তখন আবারও আসে নামের প্রসঙ্গ। হাসানই তখন ইমরানকে তাঁর অনাগত মেয়ের নাম ঠিক করে দেন। ইরমান সঙ্গে সঙ্গে তাঁর স্ত্রী ফোন করেন, তিনিও নাম পছন্দ করেন। দুজনের খুশিমনে ফোনালাপ শুনে হাসান বলে ওঠে, ‘ও বড় হলে বইলেন নামটা তাঁর হাসান চাচা রাখছে।’ মুহূর্তই থমকে যান ইমরান। হাসান না বুঝলেও তাঁর পরিণতি তো জানেন ইমরান! পুরো সিনেমার সিগনেচার দৃশ্য বলা যায় এটিকে; দুই ভিন্ন পরিস্থিতিতে থাকা দুই বাবাকে এক বিন্দুতে দাঁড় করিয়েছেন নির্মাতা।
অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী, চাকরি আর পরিবারের টানাপোড়েনে থাকা মাদক কর্মকর্তা, স্বামীর খোঁজে অসহায় গৃহবধূ, ক্রসফায়ার হতে যাওয়া হাসান—সবাই বিষণ্ন, এক ধূসর সময়ের যাত্রী যেন। সুমন সরকারের ক্যামেরায় পুরো সিনেমায় ছিল এই বিষণ্নতার মেজাজ। তবে ‘আমলনামা’র আবহসংগীত আরও ধারালো হতে পারত, যেমন ক্ষুরধার হতে পারত সংলাপ।
কিছু দুর্বলতা সত্ত্বেও ‘আমলনামা’ সিনেমা হিসেবে উতরে যাওয়ার বড় কারণ অভিনয়। অনেক দিন পর পর্দায় ফিরে দারুণ অভিনয় করেছেন কামরুজ্জামান কামু। তাঁর অভিনয়ের মধ্যে অনায়াস একটা ব্যাপার আছে, যেটা হাসান চরিত্রের সঙ্গে ভালোভাবে মানিয়ে গেছে। এ ধরনের চরিত্রে বরাবরই নিজের সেরাটা দেন তমা মির্জা। দীর্ঘদিন পর জাহিদ হাসানের প্রত্যাবর্তনও হলো মনে রাখার মতো।
স্ত্রীর সঙ্গে খুনসুটি থেকে শুরু করে অন্তিম মুহূর্তগুলোতে তাঁর সংলাপ অভিনেতা হিসেবে জাহিদ হাসানের জাত চিনিয়েছে। গত বছর রাফীর তুফান দিয়েই বলা যায় গাজী রাকায়াতের নতুন করে উত্থান হয়েছে। মাঝখানে কাজী আসাদের ‘আধুনিক বাংলা হোটেল’-এ স্বল্প সময়ের উপস্থিতিতেও নিজের ছাপ রেখেছিলেন—এ সিনেমায়ও সেটা করেছেন। তাঁর কণ্ঠের মধ্যেই একটা ‘দখলদারি’র ব্যাপার আছে, সাধারণ সংলাপও পায় ভিন্ন মাত্রা।
নির্মাতা জানিয়েছেন, সিনেমাটি দিয়ে সব বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছেন। তবে সেটা করতে গিয়ে তিনি যে পর্দায় ক্লিশে ‘লেকচার’ দেওয়ার পথ বেছে নেননি, সে জন্য তাঁকে ধন্যবাদ।