জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্তদের তালিকা কীভাবে বারবার ফাঁস হচ্ছে
৫ জানুয়ারি সন্ধ্যায় হঠাৎ প্রকাশ্যে আসে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ২০২১–এর চূড়ান্ত মনোনীতদের তালিকা। মুহূর্তে সেই তালিকা নেট–দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে। ২৭টি শাখায় জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারজয়ী তারকা ও কলাকুশলীদের শুভকামনা জানান সহকর্মী, শুভাকাঙ্ক্ষী ও ভক্তরা। তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের চলচ্চিত্র শাখায় দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তাঁরা জানান, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার বিজয়ীদের তালিকার কোনো প্রজ্ঞাপন তাঁরা দেননি, প্রকাশিত তালিকা সম্পর্কে কিছুই জানেন না। পরদিন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পাওয়া কয়েকজন এই প্রতিবেদকের কাছে প্রকাশিত তালিকা চূড়ান্ত কি না, জানতে চান। পরে বিষয়টি নিয়ে দায়িত্বরত ব্যক্তিরাও মুখ খুলছিলেন না। অবশেষে প্রায় তিন সপ্তাহ পর গত রোববার তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে ২৭টি শাখার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ২০২১ ঘোষণা করে। সেই তালিকার সঙ্গে ৫ জানুয়ারি প্রকাশিত তালিকার শতভাগ মিল রয়েছে।
জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ঘোষণার আগেই চূড়ান্ত তালিকা ফাঁস হওয়া অবশ্য নতুন কিছু নয়। কয়েক বছর ধরেই তালিকা ফাঁস হচ্ছে। ২০১৯ ও ২০২০ সালেও প্রজ্ঞাপন জারির আগেই তালিকা ফাঁস হয়। প্রতিবারই ফাঁস হওয়া তালিকা নিয়ে তর্কবিতর্ক হয়, তবে অবস্থা তাতে বদলায়নি। আনুষ্ঠানিক ঘোষণার আগেই ফাঁস হওয়ায় জাতীয় পুরস্কারের মতো বিষয় নিয়েও বিব্রতকর পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হয় বিজয়ীদের। কীভাবে কারা গোপনীয় এই তালিকা ফাঁস করছেন, সেটা নিয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা নিজেদের দুর্বলতার কথা স্বীকার করছেন।
জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের জন্য প্রতিবছর আবেদনপত্র আহ্বান করে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়। আগ্রহী প্রযোজকেরা মন্ত্রণালয় নির্দেশিত প্রক্রিয়া অনুসরণ করে জমা দেন। এরপর সিনেমাগুলো দেখেন জুরিবোর্ডের সদস্যরা। নির্ধারিত ২৭টি শাখায় আলাদা আলাদা নম্বর দিয়ে মূল্যায়ন করেন জুরিরা। পরে সবার নম্বর যোগ হয়। সেই নম্বরের তালিকা সুপারিশ করে পাঠানো হয় তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ে। জুড়িবোর্ডের সদস্য অভিনেতা জাহিদ হাসান বলেন, ‘তালিকা ফাঁস হওয়ার কথা জেনেছি। আমি বলব, দুই জায়গা থেকে এটা ফাঁস হতে পারে—এক সেন্সর বোর্ড, আরেকটা মন্ত্রণালয় থেকে। কিন্তু কীভাবে হয়েছে, সেটা তো আর জানি না। আমরা জুরিরা উপস্থাপক। সিনেমা দেখে একধরনের প্রস্তাবনা দিই। মূল অথরিটি কিন্তু আমরা নই, মন্ত্রণালয়। যে কারণে হয়তো অনেক সময় প্রস্তাবনায় উনিশ বিশ হয়। কিন্তু আমাদের কাছ থেকে ফাঁস হয় না।’
নাম প্রকাশ না করা শর্তে জুরিবোর্ডের আরেক সদস্য বলেন, ‘আমরা যে তালিকা সুপারিশ করে মিনিস্ট্রি বা ক্যাবিনেট মিনিস্ট্রিতে পাঠাই, সেখানে থেকে দু-একটা পরিবর্তিত হয় বা হতে পারে। সেই পরিবর্তনের কথা আমরা কিন্তু জানি না। ফাঁস হওয়ার পরে জানতে পারি। আমাদের কাছ থেকে যদি ফাঁস হতো, তখন ফল অন্যটা আসত। কীভাবে এটা হয়, সেটা আমাদের জানার বিষয় না। আমরা স্বচ্ছতা বজায় রাখি।’
তবে মন্ত্রণালয়ে জুরিবোর্ডের প্রস্তাবনা পরিবর্তনের সুযোগ নেই বলে দাবি করলেন তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের উপসচিব (চলচ্চিত্র-১, ২) সাইফুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘আমাদের এখান থেকে জাতীয় চলচ্চিত্রের কোনো ফাইল ফাঁস হওয়ার মতো ঘটনা ঘটে না। আমাদের এখান থেকে ফাঁস হওয়া সম্ভব নয়। আমি বলব, তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় থেকে লিক হওয়ার কোনো প্রশ্ন আসে না।’ ভবিষ্যতে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার তালিকা ফাঁস এড়াতে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় কোনো ব্যবস্থা নিতে পারে কি না, এমন প্রশ্নে তিনি আরও বলেন, ‘জুরিবোর্ড থেকে শুরু করে অনেকগুলো মাধ্যমের ব্যক্তিদের হাতে তালিকাটা যায়। ধারাবাহিকভাবে বলতে গেলে, তথ্য মন্ত্রণালয়ে প্রথম প্রস্তাবটা আসে সেন্সর বোর্ড থেকে। সেই তালিকা আমরা ক্যাবিনেটে পাঠাই। সেখানে মিটিং হয়, সুপারিশ করা তালিকা নিয়ে সিদ্ধান্ত হয়। পরে সেটা আবার তথ্য মন্ত্রণালয়ে আসে। আমরা সেটা ঘোষণা করি। এই যে প্রক্রিয়ায় হাতবদল হয়ে আমাদের কাছে আসে, এখান থেকে কীভাবে, কোন মাধ্যমে থেকে ফাঁস হয়। এই ঘটনায় আমরা নিজেরাই হতাশ।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে সরকারের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, ‘এই তালিকা ফাঁস করার জন্য অনেকেই তক্কে তক্কে থাকেন। এটা যাঁরা ফাঁস করেন, প্রকাশ করেন, তাঁদের সক্ষমতা আর মন্ত্রণালয়ের জন্য দুর্বলতা। এখানে নির্দিষ্ট কাউকে দোষারোপ করা যাবে না। কারণ, তালিকাটা অনেকগুলো ডেস্কে ঘোরে। চূড়ান্ত পর্যায়ে তালিকা মন্ত্রিপরিষদ কমিটিতে যায়। সেখান থেকে চূড়ান্ত হয়। যেদিন মন্ত্রিপরিষদ কমিটিতে তালিকা চূড়ান্ত হয়েছে, সেই দিনই তালিকাটি অনলাইন খবরে ও পরদিন পত্রিকায় এসেছে। কাউকে দোষ দিচ্ছি না। তবে এর মধ্যে একটি বিতর্ক তৈরি হয়, অনেক সময় তালিকার পরিবর্তন হলে ফাঁস হওয়া তালিকার ব্যক্তিদের সামাজিকভাবে ছোট হতে হয়, এমন খবরও আছে। সে ক্ষেত্রে সরাসরি তালিকা প্রকাশ করলে বিতর্কের সুযোগ থাকে না।’