বছরজুড়ে আলোচনায় ছিলেন তাঁরাও
কারও অভিনয়জীবন তিন দশক। কারও মাত্র তিন বছরের। তাঁরা কেউ অভিনয় করেছেন মঞ্চে, কেউ টেলিভিশনে, কেউবা চলচ্চিত্রে। তবে ঠিক জমছিল না যেন! ২০২৩ সালে নাটক ও চলচ্চিত্রে তাঁরা নিজেদের অপরিহার্য করে তুলেছেন। নিজেদের সম্ভাবনার কথাও জানান দিয়েছেন। কেউ এই বছরে অর্জন করেছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারও। পরিচালকেরা তাঁদের নিয়ে এখন বেশি করে ভাবছেন। পর্দায় তুলনামূলক নতুন এসব শিল্পীর অভিনয়ের মুনশিয়ানায় ব্যস্ততাও বাড়ছে পাল্লা দিয়ে। বছরজুড়ে আলোচনায় থাকা এমন চার অভিনয়শিল্পী নিয়ে এই প্রতিবেদন।
বছরটা নাসির উদ্দিনের
শুরুটা আগেই হয়েছিল। টুকটাক কাজ করে যাচ্ছিলেন। তবে এ বছরটা যেন আরও বেশি মাত্রায় নিজের করে নিলেন নাসির উদ্দিন খান। দেশের সিরিজ ও চলচ্চিত্রে যেমন তাঁর অভিনয় প্রশংসিত হয়েছে, তেমনি ‘বলী’র মতো সিনেমা দিয়ে নিজেকে বিশ্ব চলচ্চিত্রের আঙিনায় পৌঁছে দিয়েছেন। এ বছরে তাঁর হাতে উঠেছে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। ২০২২ সালে মুক্তি পাওয়া ‘পরাণ’ ছবির জন্য নাসির পার্শ্বচরিত্রের সেরা অভিনেতা হিসেবে এ পুরস্কার পান। এর বাইরে বছরজুড়ে নতুন সিনেমা ও নতুন সিরিজে যুক্ত হয়ে আলোচনায় ছিলেন নাসির। ‘প্রহেলিকা’ ছবিতে জামশেদ চরিত্রে অভিনয় করে নিজের জাত চিনিয়েছেন। চরকির ‘মাইশেলফ অ্যালেন স্বপন’ সিরিজে তো অভিনয়ের পাশাপাশি গান গেয়েও আলোচনায় আসেন।
এই সিরিজে নাসিরের গাওয়া ‘বৈয়াম পাখি’ গানটি ফেসবুক, টিকটকে ভাইরাল হয়েছে। নাসির বললেন, ‘সত্যি বলতে আমার অভিনয়জীবনের সেরা একটি বছর কাটিয়েছি। দারুণ কাজের জন্য উৎসাহ, অনুপ্রেরণা যেমন পেয়েছি, তেমনি আরও ভালো কিছু কাজের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করেছি। যে স্বপ্নটা অভিনয় নিয়ে দেখেছি, তা এই বছরে আমার জীবনে খুবই অসাধারণভাবে ধরা দিয়েছে।’ নব্বই দশকের মাঝামাঝি চট্টগ্রামে নাসির উদ্দিন খানের থিয়েটারচর্চা শুরু। অভিনয়ের নানা অলিগলি পেরিয়ে ২০১৬ সালে ঢাকায় আসেন। মেলে ধরেন অভিনয়ের আঙিনায়। বাড়তে থাকে পরিচিতি। এই যাত্রায় ‘তাকদীর’, ‘মাইশেলফ অ্যালেন স্বপন’–এর মতো সিরিজ যেমন আছে, তেমনি ‘পরাণ’ এবং ‘হাওয়া’র মতো চলচ্চিত্রও আছে।
এলিনার সৌভাগ্যের বছর
করোনায় যখন সবকিছু স্থবির, ঠিক সেই সময় মানে ২০২১ সালে ‘জানোয়ার’ নামের একটি ওয়েব ফিল্মে অভিনয় করে কিছুটা আলোচনায় আসেন এলিনা শাম্মী। পরিচালক রায়হান রাফীর প্রতি এ জন্য কৃতজ্ঞতা পোষণ করেন এই অভিনয়শিল্পী। এরপর আবার নাটক ও ওয়েবে টুকটাক কাজ করছেন। ২০১১ সালে উপস্থাপনা দিয়ে বিনোদন অঙ্গনে কাজ শুরু করা এলিনা এই বছরে যেন নিজেকে নিজেই ছাড়িয়ে গেলেন। তাই তো বছরটাকে সৌভাগ্যের বছর হিসেবেও মনে করছেন তিনি। কারণ হিসেবে উল্লেখযোগ্য চারটি ছবিতে তাঁর অভিনয়ের কথা বললেন। ‘প্রিয়তমা’, ‘মুজিব একটি জাতির রূপকার’, ‘মুখোশ’ এবং ‘রেডিও’ ছবিতে অভিনয়ের জন্য তাঁকে ঘিরে বছরজুড়ে ছিল আলোচনা। এই বছরে তিনি অভিনয় করেছেন প্যান ইন্ডিয়ান সিনেমা ‘দরদ’–এও।
শিগগিরই ‘অপারেশন জ্যাকপট’ ছবির শুটিং শুরু করবেন। কাজ করবেন আরও তিনটি বড় বাজেটের ছবিতে। আগামী বছরটাও ভালো যাবে মনে মনে করছেন এলিনা শাম্মী। গতকাল সন্ধ্যায় কথা হয় এই অভিনয়শিল্পীর সঙ্গে। তিনি বললেন, ‘এটা বলতে কোনো দ্বিধা নেই, বছরটা আমার অভিনয়জীবনের সৌভাগ্যের বছর। দুহাত ভরে ভালোবাসা পেয়েছি। এ বছর প্রিয়তমা যেমন সব ধরনের রেকর্ড ভেঙেছে, তেমনি আমার পরিচিতি বাড়িয়ে দিয়েছে অনেকখানি।
‘দরদ’ ছবির শুটিংয়ে যখন ভারতের বারানসিতে গিয়েছি, সেখানেও তা টের পেয়েছি। শুটিংয়ে টেকনিক্যাল ক্রুরা আমাকে ‘প্রিয়তমা’র আর্টিস্ট হিসেবে সম্মান দিয়েছেন। ‘প্রিয়তমা’র রেশ কাটতে না কাটতেই একই বছরে প্যান ইন্ডিয়ান ছবিতে অভিনয় করতে পারাটাও অনেক বড় ভাগ্যের। হাতে গোনা কয়েকজন শিল্পীর মধ্যে আমি একজন।’
তামিল ভিলেন সীমান্ত!
ঢালিউডে এল আর খান সীমান্তকে খল চরিত্রের অভিনেতা হিসেবেই দেখা যায়। বছরের শুরুটা হয় ঈদুল ফিতর দিয়ে। এক ঈদে তাঁর পাঁচটি ছবি মুক্তি পায়। একসঙ্গে এত ছবিতে অভিনয় করে নিজেকে আলোচনায় আনেন। এরপর ঈদুল আজহায় ‘প্রিয়তমা’ ছবিতে তাঁর অভিনয় দর্শকনন্দিত হয়। শক্তিমান অভিনেতা শহীদুজ্জামান সেলিমের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অভিনয় নজর কাড়ে সবার। অভিনয়ে আসার আগে একটি পোশাক প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের শুভেচ্ছাদূত ছিলেন। এর আগে ডিফেন্সে চাকরি করতেন। ভালো লাগছিল না চাকরি, তাই ছেড়ে দেন। অভিনয় ভালো লাগত, তাই চাকরি থেকে বের হয়ে অভিনয়ের সুযোগ খোঁজেন।
সৈকত নাসির সেই সুযোগটা করে দেন। ‘ক্যাসিনো’ ছিল তাঁর অভিনীত প্রথম চলচ্চিত্র। ২০১৯ সালে শুটিং করলেও মুক্তি পেয়েছে এ বছর। প্রথম ছবি মুক্তির সময়ে আরও চারটি যোগ হয়। তবে সীমান্ত আলোচনায় আসেন ২০২০ সালের ডিসেম্বরে অনন্য মামুনের ‘নবাব এলএলবি’ ছবিটি দিয়ে। খল অভিনেতা হিসেবে নিজের লুক ও অভিনয় দিয়ে নজর কাড়েন। কিন্তু এরপর করোনার কারণে শুটিং করা অনেক ছবি মুক্তির কথা থাকলেও আটকে থাকে।
সবকিছু যেন সুদে আসলে এ বছর পুষিয়ে দিয়েছে সীমান্তকে। ছয়টি ছবির মুক্তি এবং একই সঙ্গে প্রতিটি ছবিতে তাঁর উপস্থিতি বেশ আলোচনায় এসেছে। তাঁকে দেখে অনেকে ভাবেন তামিল ভিলেন। আগামী বছরের তালিকায় এরই মধ্যে পাঁচটি ছবি যুক্ত হয়েছে বলে জানালেন। সীমান্ত বললেন, ‘করোনার আগে কাজ শুরু করলেও সবকিছু যখন থমকে যায়, কিছুটা হতাশ হয়ে পড়ি। সৃষ্টিকর্তা আমাকে এ বছরটায় দুহাত ভরে দিয়েছেন। যেখানেই যাই, সবাই আমার সঙ্গে সেলফি তোলেন, কথা বলেন। আগামী বছরের কাজগুলো দিয়ে আরও ভালো কিছু করার চেষ্টা থাকবে।’ সীমান্ত অভিনীত ‘প্রেম পুরান’, ‘রিভেঞ্জ’, ‘মায়া দ্য লাভ’, ‘বকুলকথা’, ‘মাসুদ রানা’র মতো ছবি মুক্তির অপেক্ষায়।
মিলেছে জাতীয় পুরস্কার
মঞ্চ, টিভি ও চলচ্চিত্র অভিনেতা দীপু ইমামের এ বছর নতুন কোনো চলচ্চিত্র মুক্তি না পেলেও টেলিভিশন নাটক দিয়ে আলোচনায় ছিলেন। তাঁর অভিনীত কয়েকটি নাটক প্রশংসিত হয়েছে। এর মধ্যে ‘হৃদয়ে হৃদয়’ নাটকে শিক্ষকের চরিত্রে অভিনয় করে নজর কেড়েছেন।
এর বাইরে ‘বালিঘর’, ‘সুইট হোম’, ‘সব দোষ হোসেন আলীর’, ‘রিটার্ন অব লাভ’, ‘বেকারত্বের সৌরভ’, ‘স্বপ্নঘুড়ি’র মতো নাটকও রয়েছে। ঢাকা অ্যাটাক ছবি দিয়ে বড় পর্দায় যাত্রা শুরু করা এই অভিনয়শিল্পী অপারেশন সুন্দরবন ছবিতে ‘টাই হারুন’ চরিত্রে অভিনয় করে বেশ আলোচিত হন। তাঁর অভিনয় এতটাই প্রশংসিত হয় যে ছবিটির জন্য তাঁর হাতে সেরা কৌতুক অভিনেতার পুরস্কার ওঠে। নতুন কয়েকটি ছবি মুক্তির অপেক্ষায় আছে, এসবের মধ্যে ঢাকা ২০২৪, গিরগিটি, ডি ঢাকা ড্রাগ ডিলারস। দীপু জানান, নতুন একাধিক ছবিতে অভিনয়ের জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়েছেন, পরিচালকের নিষেধ থাকায় আপাতত নাম প্রকাশ করতে পারছেন না। দীপু ইমাম মঞ্চে কাজ করছেন নব্বই দশক থেকে। সুবচন নাট্য সংসদের জনপ্রিয় প্রযোজনা মহাজনের নাও–এ যেমন ছিলেন, তেমনি কাজ করেছেন ‘খান্দানি কিচ্ছা’, ‘তীর্থংকর’, ‘ক্ষুধিত পাষাণ’, ‘রূপবতী’সহ বেশ কিছু নাটকে। মঞ্চে কাজ শুরুর ১৭-১৮ বছর পরে গোলাম সোহরাব দোদুলের ‘সুলতানা বিবিয়ানা’ নাটকের মাধ্যমে টিভি নাটক শুরু করেন। মনেপ্রাণে চাইতেন ছবিতে কাজ করার। অভিনয়ের সেই সেরা সময়টা পার করছেন তিনি। দীপু বলেন, ‘ঢাকা অ্যাটাক দিয়ে আমার সিনেমায় অভিনয় শুরু। মানুষ চিনতে শুরু করে। এ বছর নতুন ছবিতে যেমন কাজ করেছি, নাটকেও অভিনয় করেছি। সব মিলিয়ে বছরটা আমার অভিনয়জীবনে সবচেয়ে সেরা সময়। জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারটাও পেয়েছি এ বছরে।’