অস্কারে যত কাণ্ড

গতকাল ভোরে বসেছিল ৯৭তম একাডেমি অ্যাওয়ার্ডসের আসর। গুরুত্বপূর্ণ পুরস্কারের বিস্তারিত ও আলোচিত সাত ঘটনা নিয়ে লিখেছেন লতিফুল হক

অস্কারে বাজিমাত করেছে বাজিমাত করেছে ‘আনোরা’। কোলাজ

শন বেকার
পর্দায় প্রান্তিক মানুষের গল্প
অনেক দিন যৌনকর্মী ও পর্নো তারকাদের নিয়ে গবেষণা করেছেন শন বেকার। তাঁর সিনেমায় তাই বারবার উঠে আসে যৌনকর্মীদের গল্প, আর আসে অভিবাসী মানুষের কথা। এ প্রসঙ্গে গত বছর কানে পুরস্কার জেতার পর শন বলেন, ‘তাঁরা (যৌনকর্মীরা) আমাদের সবাইকে মুগ্ধ করেন।’ ২০০০ সালে ‘ফোর লেটার ওয়ার্ডস’ দিয়ে পরিচালনা শুরু করেন শন, ২৫ বছর পর এসে জিতলেন সেরা নির্মাতার অস্কার। পুরস্কার জয়ের পর প্রেক্ষাগৃহের জন্য আরও সিনেমা নির্মাণের আহ্বান জানিয়ে শন বলেন, ‘আমরা কোথায় সিনেমার প্রেমে পড়ি? অবশ্যই প্রেক্ষাগৃহে।’ শনের হাতে পুরস্কার তুলে দেন নির্মাতা কোয়েন্টিন টারান্টিনো। এই কোয়েন্টিনের সিনেমা ‘ওয়ানস আপন আ টাইম ইন হলিউড’-এ মাইকি ম্যাডিসনকে দেখেই ‘আনোরা’ করার সিদ্ধান্ত নেন শন। তাই নির্মাতার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে শন বলেন, ‘কোয়েন্টিন যদি ছবিতে ম্যাডিসনকে না নিতেন, তাহলে “আনোরা” হতো না।’

অস্কার হাতে মাইকি ম্যাডিসন। রয়টার্স

মাইকি ম্যাডিসন
স্বপ্ন হলো সত্যি
আগে বলার মতো খুব বেশি কিছু করেননি, তবে এক ‘আনোরা’ দিয়েই বলা যায় সারা জীবনের অর্জন হয়ে গেল। সেরা অভিনেত্রী বিভাগে সবচেয়ে ফেবারিট ডেমি মুরকে পেছনে ফেলে পুরস্কার জিতেছেন মাইকি ম্যাডিসন। পুরস্কার জিতে ২৫ বছর বয়সী অভিনেত্রী বলেন, ‘আমার স্বপ্ন সত্যি হলো। যদিও লস অ্যাঞ্জেলেসে বড় হয়েছি, তবু বরাবরই মনে হতো, হলিউড অনেক দূরের স্বপ্ন। সেখান থেকে আজ এই মঞ্চে দাঁড়ানো সত্যিই অবিশ্বাস্য।’ সিনেমায় যৌনকর্মী অ্যানির ভূমিকায় অভিনয় করেছেন তিনি। ক্যারিয়ারের শুরুর দিকেই জটিল একটি চরিত্র পর্দায় সফল রূপায়ণ করে সমালোচকদের প্রিয়পাত্র বনে গেছেন ম্যাডিসন। অ্যানির মধ্যে এক দ্বৈত সত্তা বাস করে। ক্লাবের স্ট্রিপ ড্যান্সার, পরিস্থিতি বুঝে শয্যাসঙ্গিনী, কিন্তু কেউ হুকার বললে রেগে যায়। স্বপ্ন, বাস্তবতা, টানাপোড়েন, মানবিকতা আর অসহায়ত্বের মোড়কে চরিত্রটিকে গড়েছেন নির্মাতা।

অ্যাড্রিয়েন ব্রডি
২২ বছর পর
২০০৩ সালে ‘দ্য পিয়ানিস্ট’-এর জন্য ২৯ বছর বয়সে সর্বকনিষ্ঠ অভিনেতা হিসেবে অস্কার জেতেন অ্যাড্রিয়েন ব্রডি। এবার জিতলেন ‘দ্য ব্রুটালিস্ট’-এর জন্য। দুবার অস্কার জেতা ১০ অভিনেতার একজন এখন ব্রডি।

পুরস্কার হাতে অ্যাড্রিয়েন ব্রডি। রয়টার্স

রোমান পোলানস্কির দ্য পিয়ানিস্ট-এর মতো ব্র্যাডি করবেটের এ সিনেমাতেও এক ইহুদির চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন, যে গণহত্যা থেকে বাঁচার চেষ্টা করছে! এ ধরনের চরিত্রের সঙ্গে ব্রডি যে এত ভালোভাবে মানিয়ে যান, তার অন্য একটা কারণও আছে। অভিনেতার নিজের মা এবং দাদা-দাদি ১৯৫০-এর দশকে হাঙ্গেরি ছেড়ে পালিয়ে এসেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রে! ‘দ্য ব্রুটালিস্ট’-এর গল্প ব্রডির কাছে তাই ‘একান্তই ব্যক্তিগত’। ‘যুদ্ধ, নিপীড়নের দীর্ঘস্থায়ী ট্রমা, ইহুদিবিদ্বেষ, বর্ণবাদ নিয়ে বলতে আবার আমি এখানে এসেছি। সবাইকে নিয়ে একটি সুখী পৃথিবীর জন্য প্রার্থনা করি। আমি বিশ্বাস করি, ঘৃণা দিয়ে কিছু হয় না; অতীত আমাদের এ শিক্ষাই দেয়,’ পুরস্কার জেতার পর বলেন ব্রডি।

আলোচিত ৭
নতুন সঞ্চালক
প্রথমবারের মতো অস্কার সঞ্চালনা করেন মার্কিন অভিনেতা, সঞ্চালক কোনান ও’ব্রায়েন। সমালোচকদের মতে, তাঁর পারফরম্যান্স ছিল চলনসই।

প্রথমবারের মতো অস্কার সঞ্চালনা করেন মার্কিন অভিনেতা, সঞ্চালক কোনান ও’ব্রায়েন। এএফপি

খুব বেশি রাজনীতির প্রসঙ্গ আনেননি, হালকা রসিকতায় মাতিয়ে রাখার চেষ্টা করেছেন তিনি। দুই সংগীতশিল্পী কেনড্রিক লামার ও ড্রেকের বহুল চর্চিত কাজিয়া নিয়ে ঠাট্টা করেন ব্রায়েন, মিলনায়তনে উপস্থিত দর্শকদের যা আনন্দ দিয়েছে।

কাইল জেনার আর টিমোথি শ্যালামে প্রেম করছেন। প্রায়ই বিভিন্ন অনুষ্ঠানে একসঙ্গে দেখা যায় তাঁদের। অস্কারেও তাঁদের ঘনিষ্ঠ উপস্থিতি আলোচনায় ছিল। রয়টার্স

ফিরে এল চুম্বন
২০০৩ সালের অস্কারের বহুল আলোচিত ঘটনা ছিল অ্যাড্রিয়েন ব্রডি ও হ্যালি বেরির চুম্বন। ২২ বছর পর এবারের অস্কারে যেন সেই চুম্বনেরই পুনরাবৃত্তি হলো। হ্যালি বেরি বলেন, ‘সেবার সে (ব্রডি) শুরু করেছিল। আমাদের দুজনের জন্যই সেটা ছিল খ্যাপাটে মুহূর্ত, এবার আমি ফিরিয়ে দিলাম।’ এ ছাড়া প্রেমিক জুটি টিমোথি শ্যালামে ও কাইলি জেনারের অন্তরঙ্গ উপস্থিতি নিয়েও জোর চর্চা হয়েছে।

ইউভাল আব্রাহাম। এএফপি

পুরস্কার পেল গাজার গল্প
গাজায় চলমান ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে চার ফিলিস্তিনি ও ইসরায়েলি আন্দোলনকর্মী বানিয়েছেন তথ্যচিত্র নো আদার ল্যান্ড। অস্কারে সেরা তথ্যচিত্রের পুরস্কার জিতেছে এটি। পুরস্কার গ্রহণ করে নির্মাতা ইউভাল আব্রাহাম গাজায় ভয়াবহ নৃশংসতার সমালোচনা করেন।

হ্যাকম্যানকে স্মরণ
অস্কারে সদ্য প্রয়াত অভিনেতা জিন হ্যাকম্যানকে স্মরণ করেন অভিনেতা মর্গান ফ্রিম্যান। তিনি বলেন, ‘এই সপ্তাহে আমরা খুব ভালো একজন বন্ধুকে হারিয়েছি। তিনি দুবার অস্কার পেয়েছেন, তবে এর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হলো, তিনি সারা দুনিয়ার সিনেমাপ্রেমীদের ভালোবাসা পেয়েছেন।’

এ–ই শেষ নয়
‘এমিলিয়া পেরেজ’ সিনেমায় আইনজীবীর চরিত্রে অভিনয় করে সেরা পার্শ্ব অভিনেত্রীর পুরস্কার জিতেছেন জোয়ি সালডানা। পুরস্কার পরিবারকে উৎসর্গ করে জোয়ি বলেন, ‘আমার দাদি ১৯৬১ সালে এই দেশে এসেছিলেন। অভিবাসীর সন্তান হিসেবে আমি গর্বিত। অস্কার পাওয়া ডমিনিকান বংশোদ্ভূত প্রথম আমেরিকান আমি, আশা করি আমিই শেষ নই।’

বন্ডের থিমের সঙ্গে মঞ্চে কোয়ালির নাচ শুরুতেই জমিয়ে দেয় অস্কার অনুষ্ঠান। এএফপি

জেমস বন্ডকে শ্রদ্ধার্ঘ্য
দীর্ঘদিন ইয়ন ফিল্মসের নিয়ন্ত্রণে ছিল ‘জেমস বন্ড’ সিরিজ। তবে গত মাসে নতুন চুক্তির ফলে জেমস বন্ডের সৃজনশীল নিয়ন্ত্রণ আর উইলসন ও ব্রোকলির হাতে থাকছে না। অ্যামাজন এমজিএম স্টুডিও ও ইয়ন ফিল্মসের মধ্যে চুক্তির আওতায় জেমস বন্ডের সৃজনশীল সব বিষয় নিয়ন্ত্রণ করবে এমজিএম। অস্কারের সঙ্গে ছয় দশকের সম্পর্ক জেমস বন্ডের। তাই ৯৭তম একাডেমি অ্যাওয়ার্ডসের শুরুতেই গানে গানে জেমস বন্ডকে সম্মাননা জানান দোজা ক্যাট, লিসা ও রে। সঙ্গে ছিল এ সময়ের আলোচিত অভিনেত্রী মার্গারেট কোয়ালির নাচ। বন্ডের থিমের সঙ্গে মঞ্চে কোয়ালির নাচ শুরুতেই জমিয়ে দেয় অস্কার অনুষ্ঠান।

আরও পড়ুন

এর আগে জেমস বন্ড ট্রিবিউট পারফরম্যান্সের সূচনা করেন ‘ডাই অ্যানাদার ডে’ অভিনেত্রী হ্যালি বেরি।

সন্তানের জন্য
দুই সন্তানের বাবা কিরান কালকিন। ‘আ রিয়েল পেইন’ সিনেমার জন্য সেরা পার্শ্ব অভিনেতার পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। পুরস্কার গ্রহণ করে অভিনেতা জানান, শুরুতে তিনি সিনেমার প্রস্তাব ফিরিয়ে দেওয়ার কথা ভেবেছিলেন। কারণ, শুটিং হবে যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে, দীর্ঘদিন পরিবার থেকে দূরে থাকতে হবে।

স্ত্রীর সঙ্গে কিরান কালকিন। এএফপি

তবে স্ত্রীর উৎসাহে পরে রাজি হন। অস্কারের মঞ্চে পুরস্কার উঁচিয়ে ধরে কিরান বলেন, ‘আমার স্ত্রী বলেছিল, অস্কার জিতলে চতুর্থ সন্তান উপহার দেবে।’ মুহূর্তেই হাসির রোল ওঠে। অনুষ্ঠানে কিরানের সঙ্গে তাঁর স্ত্রী জ্যাজ শার্টনও হাজির ছিলেন। অনুষ্ঠানজুড়ে ছবির জন্য বেশ অন্তরঙ্গভাবে পোজ দেন তাঁরা।

আরও পুরস্কার
পার্শ্ব অভিনেত্রী: জোয়ি সালডানা, ‘এমিলিয়া পেরেজ’
পার্শ্ব অভিনেতা: কিরান কালকিন, ‘আ রিয়েল পেইন’
আন্তর্জাতিক সিনেমা: ‘আই অ্যাম স্টিল হেয়ার, ব্রাজিল
তথ্যচিত্র: ‘নো আদার ল্যান্ড’
স্বল্পদৈর্ঘ্য তথ্যচিত্র: ‘দ্য অনলি গার্ল ইন দ্য অর্কেস্ট্রা’
মৌলিক গান: ‘ই! মাল’, ‘এমিলিয়া পেরেজ’
মৌলিক আবহ সংগীত: ড্যানিয়েল ব্লুমবার্গ, ‘দ্য ব্রুটালিস্ট’
অ্যানিমেশন ছবি: ‘ফ্লো’
মৌলিক চিত্রনাট্য: শন বেকার, ‘আনোরা’
অনুপ্রাণিত চিত্রনাট্য: পিটার স্ট্রগান, ‘কনক্লেভ’
কস্টিউম ডিজাইন: পল ট্যাজেওয়েল, ‘উইকেড’
সম্পাদনা: শন বেকার, ‘আনোরা’

তথ্যসূত্র: এএফপি, বিবিসি, ভ্যারাইটি