করোনাকালে আবারও ফিরে এল বরেণ্য চলচ্চিত্র অভিনেতা আলমগীর–এর জন্মদিন। বাংলা সিনেমার চিরসবুজ এই নায়কের ৭১তম জন্মদিন ছিল গতকাল। তাঁর বাবা কলিম উদ্দিন আহম্মেদ ওরফে দুদু মিয়া ছিলেন ঢালিউডের প্রথম সবাক চলচ্চিত্র ‘মুখ ও মুখোশ’-এর অন্যতম প্রযোজক। পারিবারিক, সামাজিক, অ্যাকশন, রোমান্টিক, ফোক, ফ্যান্টাসিসহ নানা ধরনের চলচ্চিত্রের একজন সফল অভিনেতা তিনি। প্রযোজক, পরিচালক আর গায়ক হিসেবেও সুনাম কুড়িয়েছেন। জন্মদিনে কথা হলো নানা গুণের অধিকারী এই ব্যক্তিত্বের সঙ্গে।
প্রশ্ন :
আজকাল কীভাবে সময় কাটছে?
অফিস আর বাড়ি—এই দুইয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকছি।
প্রশ্ন :
এবারের জন্মদিনে বিশেষ কোনো আয়োজন ছিল?
গত বছর করিনি, এবারও না। এই মহামারিকালে ছেলেমেয়েরা যে আসবে, সেটা ওদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ আর আমাদের জন্যও। সবকিছু মিলিয়ে দুই বছর ধরে জন্মদিনে আমরা কিছুই করিনি।
প্রশ্ন :
দেশ–বিদেশের বড় বড় তারকার জৌলুশপূর্ণ জন্মোৎসব হয়। আপনি এসব পছন্দ করেন?
কয়েকবার আমার জন্মদিন বড় করে পালিত হয়েছে। আবার ছোট করেও হয়েছে। আমি কিন্তু এসব জানান দিয়ে করি না। নীরবে আমাদের প্রজন্মের সব শিল্পী, পরের প্রজন্মের মৌসুমী, পূর্ণিমা, পপিদের নিয়েও করেছি। জন্মদিন বলে নয়, সবাইকে নিয়ে, বিশেষ করে চলচ্চিত্রের মানুষদের সঙ্গে আড্ডা দিতে, খাওয়াদাওয়া করতে আমার বরাবরই ভালো লাগে।
প্রশ্ন :
আপনি একজন প্রযোজক ও পরিচালক। যৌবনে আপনি যেমন রোমান্টিক নায়ক ছিলেন, তেমন অন্তত একজনকে গড়তে কি ইচ্ছা করে না?
গড়ব কী দিয়ে? গড়তে হলে অনেক ভালো কিছুর দরকার। আমার ভালো একজন চিত্রনাট্যকার কোথায়, পরিচালক কোথায়, সুরকার কোথায়—সবকিছু মিলিয়ে আমার কেন যেন মনে হচ্ছে, আমরা মেধাশূন্য হয়ে যাচ্ছি।
প্রশ্ন :
তাহলে কী করতে ইচ্ছা করে?
চলচ্চিত্রের জন্য ১৯৫৭ সালের ৩ এপ্রিল, আমার জন্মদিনের দিনই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রাদেশিক পরিষদে একটি ‘পূর্ব পাকিস্তান চলচ্চিত্র উন্নয়ন সংস্থা বিল’ পাস করেন। সেই স্বপ্নে উজ্জীবিত হয়ে ২০১২ সালে আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দিনটিকে চলচ্চিত্র দিবস হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন। কিন্তু আমরা যাঁরা প্রথম দিকে ছিলাম, রাজ্জাক ভাই, ফারুক—চলচ্চিত্রকে ভালোবেসে আমরা সবাই চলচ্চিত্রের জন্য কাজ করতাম। চলচ্চিত্র থেকে কিছু নিয়ে ভেগে যাব, এই চিন্তা কখনো করিনি। তাই আমাদের সময়ে বছরে শতাধিক সিনেমা মুক্তি পেত। আমরা যখন সিনেমায় এসেছি, তখন ২০০ থেকে ২৫০টা হল ছিল। বাড়তে বাড়তে তা হয় ১ হাজার ৪০০। সেই ১ হাজার ৪০০ হল থেকে কমতে কমতে এখন ১০০–এর নিচে নেমেছে। এই অবক্ষয় অনেক দিন থেকে শুরু হয়েছে। আমাদের সবকিছু কেমন যেন ট্র্যাক হারিয়ে ফেলল। এরপর আবার অশ্লীলতা জেঁকে বসল। দর্শক হল থেকে চলে গেল। এখানে আমরা সবাই দায়ী, নির্মাতারা থেকে প্রেক্ষাগৃহমালিকেরা—সবাই।
প্রশ্ন :
আপনার মেয়ে আঁখি আলমগীর দেশের একজন নামকরা সংগীতশিল্পী। তাঁকে কি এভাবেই দেখতে চেয়েছিলেন?
আঁখি পেশাদার সংগীতশিল্পী হবে, এটা আমার মাথায় ছিল না। গান করবে, গান শিখবে—এটুকু ঠিক আছে। কারণ, আমার নিজেরও সংগীতশিল্পী হওয়ার স্বপ্ন ছিল। তবে আঁখি চিকিৎসক হোক, এটাই চেয়েছিলাম। পরে দেখলাম, সে নিজেই নিজেই পেশাদার শিল্পী হয়ে গেছে। আমার ছোট মেয়ে তুলতুল এক সময় চাকরি করত, এখন আর করে না। চেয়েছিলাম তুলতুল আইনজীবী হোক। কারণ, ছোটবেলা থেকে সে খুব যুক্তি দিয়ে কথা বলত। ছেলে আমার পড়াশোনা শেষ করে আমার ব্যবসা দেখাশোনা করে।
প্রশ্ন :
অনেকে ভাবে আপনি খুব রাশভারী মানুষ। আসলে আপনি তেমনটা নন। এই ধারণার বিষয়টি কি আপনি ইচ্ছা করেই ধারণ করে রাখেন?
আমি খুব আড্ডাবাজ। আমার ওই আড্ডায় কেউ জয়েন করতে হলে তাঁকে কয়েকটা পর্দা পার হতে হয়। তার আগে পর্দাটা ওঠাই না। আমি যাচাই–বাছাই না করে কারও সঙ্গে মিশি না।আ
প্রশ্ন :
আপনাকে মাঝেমধ্যে গান গাইতে দেখা যায়। আপনার জীবনসঙ্গী উপমহাদেশের প্রখ্যাত সংগীতশিল্পী রুনা লায়লা। চলচ্চিত্রে তাঁর সঙ্গে যৌথভাবে দুই-তিনটি গানে আপনাকে পাওয়া গিয়েছিল। একসঙ্গে নতুন গানের পরিকল্পনা আছে?
একেবারেই নেই। এখন আর ইচ্ছা করে না।
প্রশ্ন :
কেন, তিনি তো সুর করছেন।
না না, অনেক কঠিন গান ওগুলো, আমি পারব না।
প্রশ্ন :
আপনার সর্বশেষ পরিচালিত, প্রযোজিত ও অভিনীত ‘একটি সিনেমার গল্প’ সিনেমায় সুরকার ছিলেন রুনা লায়লা। তাঁর সঙ্গে ভবিষ্যতে আরও কাজ করতে চান?
নতুন যে ছবির পরিকল্পনা করছি, ওটা যদি হয়, তাহলে ওটাতে রুনা সুরকার হবে না। কারণ, রুনা খুব ভালো রোমান্টিক গানের সুর করে। আর আমার নতুন ছবিটার গল্প ভিন্ন রকম। সে জন্য ভিন্ন রকম কিছু ভাবতে হবে।
প্রশ্ন :
বলিউডে যদি তাকাই, অমিতাভ বচ্চন এখনো দাপটের সঙ্গে কাজ করছেন। অসাধারণ সব চরিত্রে তাঁকে পাওয়া যাচ্ছে। অথচ আমাদের দেশে এই চিত্র উল্টো। আপনাদের সেরাটা দেওয়ার সময়েই সমসাময়িক সবাই ঘরে ঢুকে গেলেন...
আমি সিনেমায় অভিনয় করব না, তা তো কোথাও বলিনি। আমাকে একটা ভালো গল্প নিয়ে এসে কোনো পরিচালক যদি বলেন, তাহলে কেন করব না। এর মধ্যে কাজী হায়াৎ সাহেব একটা ভালো গল্পের কথা বলেছিলেন, কেন যেন হলো না কাজটা। একজন পরিচালককে তো বলতে হবে, ‘আলমগীর ভাই, এই গল্প আপনার জন্য লিখেছি, আপনি আসেন।’ সেই একই ধরনের গল্প, আমি বড়লোক, গরিবের মেয়ের সঙ্গে প্রেম—এসব আর কত! পৃথিবী অনেক এগিয়ে গেছে। সবাই নতুন করে ভাবছে। আমাদেরও নতুন করে ভাবতে হবে। ছবি চলল কি চলল না, সেটা ভিন্ন ব্যাপার।
প্রশ্ন :
৭০ বছর পার করেছেন। এক জীবনে আপনার অনেক প্রাপ্তি। অপ্রাপ্তি কী?
একটা কথা আমি সব সময় বলি, আজও বলব—আমার একটা অতৃপ্তি রয়ে গেছে, আমি ভালো অভিনেতা হতে পারলাম না। এটা আমার অন্তরের ভেতরকার কথা।
প্রশ্ন :
আপনার দৃষ্টিতে ভালো অভিনেতার সংজ্ঞা কি?
অভিনয়ের যে বিশালতা ও গভীরতা—একজনমে তা আয়ত্ব করে শেষ করা যায় না। কোনো অভিনেতাই একজীবনে অভিনয়ে তৃপ্ত হতে পারেন না।
প্রশ্ন :
কাদের অভিনয় আপনার ভালো লাগে?
দেশের মধ্যে গোলাম মুস্তাফা, খলিলউল্লাহ খান, রাজ্জাক। বাইরে উত্তম কুমার, দিলীপ কুমারের অভিনয় ভালো লাগে।
প্রশ্ন :
নায়িকাদের কথা শুনতে চাই...
বাংলাদেশের কথা যদি বলি, আমার দৃষ্টিতে সুমিতা দেবী ওয়ান অব দ্য ফাইনেস্ট অ্যাকট্রেস। এরপর শাবানা, ববিতা ও কবরী—এই তিনজন। তাঁদের সঙ্গে আমার অভিনয় হয়েছে।
প্রশ্ন :
দেশের বাইরে থেকে কারও নাম যদি শুনতে চাই...
আমি সুচিত্রা সেনের ভক্ত। এমনিতে ভারতের দেবশ্রী, ঋতুপর্ণা, জয়াপ্রদাসহ আরও অনেকে আমার সঙ্গে অভিনয় করেছে।
প্রশ্ন :
পশ্চিমা বিশ্বের কেউ আপনার মনে জায়গা করেনি?
পশ্চিমা বিশ্ব দ্বারা আমি খুব একটা প্রভাবিত নই। এই উপমহাদেশের ছবি নিয়ে আমি বেশি ভাবি। আমি মনে করি, এখান থেকে যদি কিছুটা শিখতে পারি, তাহলে কাজে দেবে। পশ্চিমা বিশ্বের অভিনয় আমাদের এখানে খুব একটা কাজে দেয় না। আমরা যে মেথড অ্যাক্টিংয়ের কথা বলি, সেখানে মারলন ব্রান্ডোকে এই অভিনয়ের জনক বলা হয়। তিনি অভিনয় শুরু করেছেন ১৯৫২ বা ১৯৫৩ সালে। দিলীপ কুমারকেও কিন্তু মেথড অ্যাক্টিংয়ের গুরু বলা হয়। তিনি কিন্তু শুরু করেছেন ১৯৪৬–এ, তাহলে মেথড অ্যাক্টিংয়ের আসল আবিষ্কারক কে?
প্রশ্ন :
আপনার সমসাময়িক আকবর হোসেন পাঠান ফারুক এখন সাংসদ। আপনারও নির্বাচন করে জনপ্রতিনিধি হওয়ার ইচ্ছা আছে?
রাজনীতি আমি একটু কম বুঝি। নির্বাচন করার কোনো ইচ্ছাই আমার নেই। তবে অবশ্যই আমার রাজনৈতিক আদর্শ আছে। আমার আদর্শ ওয়ান অ্যান্ড অনলি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৬৯ থেকে আমি তাঁর আদর্শে বিশ্বাসী। চলচ্চিত্র নিয়েই আমার সব ভাবনা। চলচ্চিত্রে যার যা কিছু প্রয়োজন, এগিয়ে যাই, কাজ করতে চেষ্টা করি।
প্রশ্ন :
স্বাধীনতার ৫০ বছরে আমাদের চলচ্চিত্র কতটা এগিয়েছে, কতটা পিছিয়েছে?
অবশ্যই পিছিয়েছে। চলচ্চিত্রেও একটা খারাপ সময় আসে। সেটাই এখন চলছে। আমাদের সিনেমাও কিন্তু চক্রাকার পদ্ধতিতে চলে। ঘড়ির কাঁটায় যেমন দিনের পর রাত্রি, রাত্রির পর দিন আসে। কিন্তু আমাদের চলচ্চিত্রের রাত্রিটা বোধ হয় একটু বেশিই লম্বা হয়ে যাচ্ছে। আবার ভোরের সূর্য দেখার জন্য সবাই একসঙ্গে সৎ উদ্দেশ্যে কাজ করতে হবে। একটি ভালো নেতৃত্বে, সুন্দর নীতিমালা, ফেডারেশন দিয়ে চলচ্চিত্রের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া সম্ভব।