আব্বা যেভাবে চেয়েছেন, সেভাবেই নিজেকে গড়ার চেষ্টা করেছি: ফেরদৌসী রহমান

২৮ জুন ১৯৪১ সালে ভারতের কোচবিহারে জন্মগ্রহণ করেন দেশের প্রথিতযশা সংগীতশিল্পী ফেরদৌসী রহমান। পল্লিগীতির সম্রাটখ্যাত আব্বাসউদ্দীনকন্যার সংগীতের সঙ্গে বসবাস খুব ছোটবেলা থেকে। ফেরদৌসী রহমানের বাড়িতে জন্মদিন সেভাবে উদ্‌যাপন করা হতো না। বড় ভাই (সাবেক প্রধান বিচারপতি) মোস্তফা কামালের জন্মদিন হইচই করে উদ্‌যাপন করা হতো। গান হতো, কবিতা হতো, খাওয়াদাওয়া হতো। আর ফেরদৌসী রহমানের জন্মদিন প্রথম ১৯৫৬ সালে উদ্‌যাপন করা হয়, যেদিন তিনি মেট্রিকে স্ট্যান্ড করলেন, সারা দেশে মেয়েদের মধ্যে প্রথম হলেন। ২৬ জুন ফল বের হয়, ২৮ জুন ছিল তাঁর জন্মদিন। এবারের জন্মদিন কেমন কাটছে, তা জানতে আজ শুক্রবার সকালে তাঁর সঙ্গে কথা বললেন মনজুর কাদের

প্রথম আলো:

শুভ জন্মদিন

ফেরদৌসী রহমান: ধন্যবাদ।

প্রথম আলো :

এই দিনটিতে কী উপলব্ধি হয়?

মানুষ তো এত বুড়ো বয়স পর্যন্ত বেঁচে থাকে না, তাই না। (হাসি)। এত দিনে অক্কা পেয়ে যাওয়ার কথা! আশির পর এখন প্রতিটি দিন আল্লাহর কাছে বোনাস মনে হয়। আমাদের দেশে একটা সময় গড় আয়ু কত ছিল? আগে তো ৫০–৬০ হলেই মানুষ বুড়ো হয়ে যেত। আমার আব্বা মারা গেছেন ৫৯ বছর বয়সে। সেই তুলনায় আমি ৬৯, ৭৯ পেরিয়ে এখন ৮৪–তে পড়লাম। আব্বার চেয়ে প্রায় ২৫ বছর বেশি জীবন পেলাম, তাই না।  

আরও পড়ুন
ফেরদৌসী রহমান। ছবি: প্রথম আলো
প্রথম আলো:

বলছিলেন, বোনাস লাইফ পেয়েছেন, এই বোনাস লাইফটা কীভাবে উপভোগ করছেন?

ফেরদৌসী রহমান: বোনাস সব সময় উপভোগ করার মতো। আল্লাহর নাম জপে জপে দিনটা কাটে। যেকোনো সময় আল্লাহ বলবে, আসো। এরপর চলে যাব।

প্রথম আলো :

জীবনটা আপনার কাছে কী?

ফেরদৌসী রহমান: যদি এটাকে সুখ হিসেবে মনে করা হয়, তাহলে উদ্‌যাপনের। আবার কেউ যদি ভাবে, এটা পানিশমেন্টের, তাহলে পানিশমেন্টের। পুরোপুরি নির্ভর করছে কীভাবে জীবনটাকে দেখা হচ্ছে। প্রতিটি দিন যদি কারও কাছে সুন্দর হয়, তাহলে এটা অবশ্যই উদ্‌যাপনের। অন্যদিকে প্রতিটি দিন যদি কারও কাছে কষ্টের হয়, তাহলে এটা পানিশমেন্টের। তবে আমি মনে করি জীবনটা হচ্ছে সুখ–দুঃখের একটা মিশ্রণ। ভালো–মন্দ মিলিয়েই জীবন। কারও একটু বেশি ভালো, কারও একটু কম খারাপ।

বাবা বিখ্যাত সংগীতশিল্পী আব্বাসউদ্দীন আহমদ ও মা বেগম লুৎফুন্নেসা আব্বাসের সঙ্গে ফেরদৌসী রহমান। ১৯৫৯ সালে
ছবি: ফেরদৌসী রহমানের ওয়েবসাইট থেকে
আরও পড়ুন
প্রথম আলো:

যে জীবনটা কাটিয়ে এসেছেন, কেমন ছিল? এই জীবন নিয়ে আপনার কোনো অনুশোচনা আছে?

ফেরদৌসী রহমান: আমার জীবন নিয়ে কোনো রিগ্রেটস নেই। আল্লাহর কাছে কোটি শোকর। তবে আবার যদি আল্লাহ এই জীবনটাই দেন, তাহলে কী করব জানি না। তবে তখন হয়তো আরও কিছু মানুষের ভালো করার চেষ্টা করব। হয়তো নিজের ভালো করতে গিয়ে অনেককে মাড়িয়ে গেছি, সেটা হয়তো তখন করব না। তবে তেমন কাউকে মাড়িয়ে যাইনি। যদি গিয়ে থাকি, আল্লাহ তো জানবেন। কিছুই করলাম না মানুষের জন্য। গান গাইলাম, কিছু মানুষ খুশি হলো, দোয়া করল—এই, এমনটা মনে হয়।

প্রথম আলো :

গান গেয়ে তো আপনি মানুষের হাসি, আনন্দ, একাকিত্বের সঙ্গী হয়েছেন—এটাই কয়জন পারে?

ফেরদৌসী রহমান: যদি এমনটা করে থাকি, তাহলে তো ভালো। তবে এটাও মনে হয়, অজান্তে কারও মন ভালো করে দিয়েছি। কারও আবার মন খারাপের সঙ্গীও হয়েছি।

স্বামী রেজাউর রহমানের সঙ্গে ফেরদৌসী রহমান
ছবি : সংগৃহীত

প্রথম আলো :

শিল্পী হয়ে যে জন্ম নিয়েছেন...এই জীবনটা নিয়ে আপনি কতটা সুখী?


ফেরদৌসী রহমান: আব্বা যেভাবে চেয়েছেন, সেভাবেই নিজেকে গড়ার চেষ্টা করেছি। ইনফ্যাক্ট একটা সময় আমার নিজের কোনো চাওয়াই ছিল না। এখনো মনে হয়, আব্বা এটা করলে খুশি হতেন, তাই করি। আব্বা ওইটা করলে খুশি হতেন, তা করি—আব্বা তিন ভাইবোনকে এত বেশি প্রভাবিত করেছেন। আম্মার দ্বারাও প্রভাবিত হয়েছি। তাঁর, তাঁদের ভালো লাগাই প্রাধান্য পেয়েছে। তবে আব্বার এই ভালো লাগার ব্যাপারটা যে সচেতনভাবে ভাবি, তা কিন্তু না। এটা হয়ে যায়।

আরও পড়ুন
প্রথম আলো:

এটা কবে থেকে?

ফেরদৌসী রহমান: একদম ছোটবেলা থেকেই। আব্বা খুশি হবেন এটা করলে, আনন্দিত হবেন ওটা করলে। আব্বা যা ইচ্ছা করেছেন, তা–ই করেছি, তাতে ভালো হয়েছে না খারাপ হয়েছে, সেটাও আল্লাহ বলতে পারবেন।

প্রথম আলো :

আপনার আব্বা সবচেয়ে বেশি কী চাইতেন?

ফেরদৌসী রহমান: আব্বার চাওয়ার কোনো শেষ ছিল না। একটা চাওয়া নয়—আব্বা চাইতেন ওরা এভাবে জীবনটা গড়ুক। আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে তুলুক নিজেদের। সময়মতো খাবে, পড়বে, গান করবে। নিয়মমাফিক একটা সুশৃঙ্খল জীবন গড়ে তুলব। শরীর ভালো থাকবে। এসব মনের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন। ৬০–৭০ বছর আগে যেসব কথা বলেছিলেন, তা একজন আধুনিক মানুষ এখন যেভাবে বলছেন, তাই–ই। আমার আব্বা তো ভীষণ আধুনিক ছিলেন। মা–ও। আমাদের আধুনিক চিন্তাভাবনায় গড়ে তুলতে চেয়েছেন। সব যে পেরেছি তা কিন্তু না।

প্রথম আলো :

একটা সময় অনেক ব্যস্ততায় কেটেছে, এখনকার সময়টা কাটে কীভাবে?

ফেরদৌসী রহমান: লেখালেখি করা হয়। কিন্তু শরীরটা ভালো থাকে না বলে সেভাবে মনোযোগ দিতে পারি না। এরপরও আমি খুব সহজ করে নিই। এই যেমন গান শুনলাম, টিভি দেখলাম। পড়লাম একুট। লিখলামও। বইটাও প্রায় শেষের দিকে।

প্রথম আলো:

জন্মের পাশাপাশি মৃত্যুচিন্তাও মানুষকে ভাবায়। এই মৃত্যুর চিন্তাটা কী?

ফেরদৌসী রহমান: আমার লেখালেখির মধ্যে মৃত্যুর পরের বিষয়ও উঠে এসেছে। তবে মৃত্যুকে আমি মেনে নিয়েছি। খুব কষ্ট হয়, সবাইকে ছেড়ে চলে যাব, কিন্তু যেতে যে হবে এটা তো বাস্তব, সত্য। অনেকে দেখি হাহুতাশও করে মৃত্যু নিয়ে। আমি মারা যাব, ভালো কাজ করেছি অনেক, আবার অনেক ভালো কাজ করিওনি। জ্ঞানত আমি খারাপ কাজ করিনি। কিন্তু ভালো কাজ আরও করতে পারতাম, আমার মনে হয়। আমি ইতিবাচকভাবে সব চিন্তা করি। যেটা আসলে হবেই, সেটা মেনে নেওয়াটাই ভালো। আল্লাহর কাছে বলি, যেগুলো আমি করিনি, অজ্ঞানতাবশত করিনি, সেগুলো মাথায় ছিলও না। এখন হয়তো পড়ছি, জানছি বলে মনে হচ্ছে—এই কাজগুলোও চাইলে করতে পারতাম। করলে ভালো হতো। কিন্তু সেগুলো নিশ্চয় আল্লাহ জানেন।

প্রথম আলো :

আমরা গানে, কবিতায় বলে থাকি, ‘আরেক জনম পাই গো যদি...’ এমনটা যদি হয়, তাহলে কী হতে চান।

ফেরদৌসী রহমান: আমি আব্বা–আম্মার মেয়ে হয়ে জন্মাতে চাই। সত্যি সত্যি আমি খুবই খুশি, যা আমি হয়েছি। যেভাবে আমার জীবনটা কাটিয়ে এসেছি। আমি বলেছি না আমার কোনো অনুশোচনা নেই। তবে এটা ঠিক, কিছু ছোট ছোট অনুশোচনা আছে, যেমন এটা করতে পারতাম। সুতরাং এই জীবনটাই যদি আল্লাহ দেন—এই আব্বা, এই আম্মা, ভাইবোন, এই সংসার—এটাই আমি চাইব। এটাতে হয়তো বোঝাতে পেরেছি, আমি কতটা সন্তুষ্ট একজন মানুষ।